ক্রীড়া জগতের ইতিহাসে এমন কিছু নাম আছে যাদের উপস্থিতিই পুরো খেলাকে অন্য উচ্চতায় নিয়ে যায়। বাস্কেটবলের ক্ষেত্রে সেই নামটি নিঃসন্দেহে মাইকেল জর্ডান। তাকে বলা হয় সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাস্কেটবল খেলোয়াড়। তবে জর্ডানের সাফল্যের গল্প কেবল দক্ষতা নয়, বরং বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হয়ে সেখান থেকেই অনুপ্রেরণা নেওয়ার এক দুর্লভ কাহিনি। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ব্যর্থতার মুখোমুখি হওয়ার পর, সেটা আমাকে আরও কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করে।’ মাইকেল জর্ডানের জীবনের শুরুর দিকের বড় ধাক্কা এসেছিল হাইস্কুলে। বাস্কেটবল দলে জায়গা করে নেওয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন তিনি। কিন্তু নির্বাচনের দিন যখন তালিকা প্রকাশ করা হলো, সেখানে নিজের নাম খুঁজে পাননি। সেই মুহূর্তে হতাশায় ভেঙে পড়েছিলেন জর্ডান। বাড়ি ফিরে দরজা বন্ধ করে অঝোরে কেঁদেছিলেন। অনেকেই হয়তো সেই ব্যর্থতার পর হাল ছেড়ে দিত, কিন্তু জর্ডান ঠিক করলেন তিনি ভিন্ন পথে হাঁটবেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন- এই ব্যর্থতা তার ক্যারিয়ারের শেষ নয়, বরং নতুন শুরুর সূত্রপাত। দিনের পর দিন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি অনুশীলন করতে লাগলেন।
জর্ডান এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, যখন ক্লান্ত হয়ে পড়তেন তখন চোখ বন্ধ করে কল্পনা করতেন যে দলের তালিকায় তার নাম আছে। সেই স্বপ্নই তাকে আবার অনুশীলনে ফিরিয়ে আনত। এই কল্পনার শক্তি তার জন্য হয়ে উঠেছিল বাস্তব পরিবর্তনের চালিকাশক্তি। পরের বছর তিনি দলের হয়ে খেলার সুযোগ পেলেন এবং তখন থেকেই তার ভিতরের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। প্রতি ম্যাচে অন্যদের তুলনায় গড়ে ২০ পয়েন্ট বেশি অর্জন করেছিলেন তিনি। ধীরে ধীরে হাইস্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়, তারপর পেশাদার লিগ- প্রতিটি স্তরে নিজের অবস্থান দৃঢ় করে তুললেন। নর্থ ক্যারোলাইনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই জর্ডান নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন এক অনন্য প্রতিভা হিসেবে। সিনিয়র ইয়ারে তার গড় পয়েন্ট ‘ট্রিপল-ডাবল’-এরও ওপরে চলে যায়। সেই পারফরম্যান্সই তাকে এনবিএ-তে প্রবেশের দরজা খুলে দেয়। শিকাগো বুলসের হয়ে খেলার সুযোগ পাওয়ার পর শুরু হলো তার প্রকৃত উত্থান। দ্রুতই তিনি দলের ভরসার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হন। তার গতি, নিখুঁত শট এবং অদম্য মানসিকতা তাকে আলাদা করে তোলে অন্যদের থেকে। জর্ডান এনবিএ-তে ছয়বার চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন। প্রতিটি ফাইনাল সিরিজে তার উপস্থিতিই খেলার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ছয়বারেরও বেশি তিনি পেয়েছেন Most Valuable Player (MVP)-এর খেতাব। শুধু পরিসংখ্যান নয়, দর্শক ও সমালোচকদের চোখে তিনি হয়ে উঠেছিলেন বাস্কেটবলের জীবন্ত কিংবদন্তি। কিন্তু এই সাফল্যের পেছনে আছে অগণিত ব্যর্থতা। নিজেই একবার বলেছেন- ‘আমার ক্যারিয়ারে আমি ৯০০০-এর বেশি শট মিস করেছি। প্রায় ৩০০টা খেলা হেরেছি। ২৬ বার আমাকে শেষ মুহূর্তের শট নিতে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমি সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারিনি। আমি বারবার ব্যর্থ হয়েছি। আর সেই ব্যর্থতাই আমাকে সফল করেছে।’ জর্ডানের মতে, ব্যর্থতা কখনো ভয় পাওয়ার বিষয় নয়। বরং ব্যর্থতা হলো শেখার সুযোগ। হেরে গেলে বোঝা যায় কোথায় ভুল হলো, কোন জায়গায় উন্নতি করতে হবে। তার কথায়, ‘ব্যর্থতা আমি মেনে নিতে পারি, কারণ সবাই কিছু না কিছুতে ব্যর্থ হয়ই। কিন্তু চেষ্টা না করে বসে থাকাটা আমি মানতে পারি না।’ এই দৃষ্টিভঙ্গি তাকে কেবল বাস্কেটবলে নয়, পুরো জীবনের জন্য অনন্য করে তুলেছে। জর্ডানের গল্প আমাদের শেখায়, জীবন যতই কঠিন হোক না কেন, চেষ্টা চালিয়ে গেলে ব্যর্থতা একসময় সফলতার সোপান হয়ে দাঁড়ায়।