শুকনো মৌসুমের আগেই শুকিয়ে গেছে চলন বিলের নদ-নদী, খাল-বিলসহ সব ধরনের জলাশয়। বিলের পানি স্থবির হয়ে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে মাছ উৎপাদন। বন্ধ হয়ে গেছে কৃষকের ডিঙি, মাঝির নৌকা। ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়া ও যত্রতত্র অবকাঠামো নির্মাণের ফলে এই বিপর্যয় নেমে এসেছে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। পানিশূন্যতায় পড়ে প্রায় মরতে বসেছে চলন বিল অঞ্চলের নদী ও খাল-বিল। চলনবিল যেন পরিণত হয়েছে মরা বিলে। ফলে নদীগুলোতেও এখন হচ্ছে ফসলের চাষ।
এখানকার প্রায় ১৬টি নদী ও অসংখ্য খাল-বিল নাব্য সংকটে অর্থনীতিতে বিপর্যয় নেমে এসেছে এলাকায়। ফলে সেচকার্য ব্যাহত হওয়ায় এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতিতে। খনন কাজ না করায় চলন বিলের খাল-বিল-নদীনালা তথা পরিবেশ আজ বিপর্যয়ের মুখে। তবে গুমানী-আত্রাইয়ের কিছু অংশে খনন কাজ চলছে। ফসলি জমিতে পরিণত হয়েছে নদীগুলো। ফলে এ অঞ্চলের প্রায় সব নৌপথ এখন বন্ধ হয়ে গেছে। এতে ব্যবসা-বাণিজ্য ও কৃষিকাজে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। কালের বিবর্তনে শত বছরের ঐতিহ্য হারাতে বসেছে চলনবিল। চলন বিলের মাঝ দিয়ে মহাসড়ক নির্মাণ, অপরিকল্পিতভাবে বাঁধ, কালভার্ট, স্লুইসগেট, ক্রসবাঁধ ও দখল-দূষণসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণের কারণে ক্রমশ ছোট হয়ে যাচ্ছে এ বিল ও অঞ্চলের নদী। শুকিয়ে গেছে প্রবাহমান খরস্রোতা নদীগুলো। প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও নানা প্রতিক‚ল পরিবেশের কারণে দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এর আয়তন।
ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া বই থেকে জানা যায়, নাটোর, পাবনা, সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, নওগাঁ ও রাজশাহী জেলার ৭৭ হাজার ৭৩৩ হেক্টর আয়তনের প্লাবনভূমির চলন বিলে রয়েছে ১৬টি নদী, ২২টি খাল ও অসংখ্য পুকুর। একসময় এসব নদ-নদী ও খাল-বিলের পানি চলমান থাকত বলেই এই বিশাল জলরাশির নামকরণ হয় চলনবিল। এখানে এপ্রিল থেকে শুকনো মৌসুম শুরু হওয়ার কথা।
চলনবিলের বিস্তীর্ণ এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখানকার নদ-নদী, খাল-বিল ও পুকুরে পানি নেই। নদ-নদীর মধ্যে আত্রাই, গুড়, করতোয়া, বড়াল, তুলসী, চেচুয়া, ভাদাই, চিকনাই, বানগঙ্গা, খুবজীপুর, তেলকুপি ও বারনইয়ের অবস্থা খুবই শোচনীয়। এসব নদ-নদীর মধ্যে চর জেগে ওঠায় পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। খালগুলোর মধ্যে হক সাহেবের খাল, নিমাইচরা বেশানী খাল, বেশানী-গুমানী খাল, উলিপুর, সাক্সগুয়া খাল, দোবিলা খাল, কিশোরখালী খাল, বেহুলার খাড়া, বাঁকাই খাড়া, গোহালা খাল, গাড়াবাড়ী-দারুখালী খাল, বিলসূর্য খাল, কুমারডাঙ্গা খাল, জানিগাছার জোলা, সাত্তার সাহেবের খাল, কিনু সরকারের ধর, পানাউল্লাহ খাল ও নবীর হাজরা জোলা পানিশূন্য হয়ে পড়েছে। ছোট বিলগুলোর মধ্যে হালতিবিল, বড়বিল, খলিশাগাড়ী বিল, ধনাইর বিল, ছয় আনি বিল, বাইডার বিল, সাধুগাড়ী বিল ও মহিষা হালট বিল শুকিয়ে গেছে।
হালতিবিলের কৃষক রফিকুল ইসলাম বলেন, আগে আমরা শুকনার সময় বিল থেকে ডিঙি দিয়ে পানি উঠায়ে ফসলে সেচ দিতাম। এখন আর তা করা যাচ্ছে না। সাধারণ নলকূপেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। গভীর নলকূপ দিয়ে সেচ দিতে হচ্ছে। ফসল উৎপাদনে অনেক খরচ হচ্ছে।
গুরুদাসপুরের ধান ব্যবসায়ী চাঁদ মিয়া বলেন, অন্য বছরের এ সময় গ্রাম থেকে ধান কিনে নৌকায় করে বাজারে আনা যেত। এখন খাল শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকা চলে না। ধানের বস্তা মাথায় করে বাজারে আনতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় অনেকে ব্যবসা বন্ধ করে দিচ্ছে। সিংড়া ও গুরুদাসপুরের শতাধিক ধানের চাতাল ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে।
সিংড়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান শফিকুর রহমান শফিক বলেন, জলবায়ুর এই পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র কৃষকেরা। তারা আগে বিনা খরচে ধান চাষ করতে পারতেন। এখন উচ্চমূল্য দিয়ে সেচযন্ত্র ও জ্বালানি কেনা অনেকের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে তারা কৃষিকাজ ছেড়ে দিচ্ছেন।
চলনবিলে পানি না থাকায় মাছ উৎপাদনে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রাকৃতিক নিয়মে আর কদিন বাদেই দেশীয় মাছের ডিম পাড়ার কথা। কিন্তু পানি শুকিয়ে যাওয়ায় এসব মাছ জেলেরা ধরে নিচ্ছে। প্রজনন ব্যাহত হওয়ায় আগামী বছর বাজারে এসব মাছের ঘাটতি দেখা দেবে। চলনবিলের বুকজুড়ে থাকা অধিকাংশ পুকুরে পানি নেই। ডোবা-নালাগুলো শুকিয়ে গেছে। অনেকের পক্ষে ভূগর্ভস্থ পানি উঠিয়ে মাছ চাষ করা সম্ভব হচ্ছে না। নাটোর জেলার ৯২২টি বাণিজ্যিক মৎস্য খামার ও শতাধিক মৎস্য হ্যাচারি রয়েছে। পুকুরে মাছ চাষ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় পোনা উৎপাদনকারীরাও বিপাকে পড়েছেন। অধিকাংশ হ্যাচারি-মালিক ইতিমধ্যে পোনা উৎপাদন সীমিত করেছেন।
নাটোর সরকারি কলেজের ভূগোলের শিক্ষক রোকেয়া বেগম বলেন, আগে চলন বিল উন্মুক্ত ছিল। সারা বছর পানির প্রবাহ থাকত। এখন চলন বিলের বুক চিরে যত্রতত্র রেলপথ, সড়কপথ, সেতু-কালভার্ট ও রেগুলেটরসহ অসংখ্য অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। ফলে পানির প্রবাহ বন্ধ হয়ে গেছে। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর অনেক নিচে নেমে গেছে। তাপমাত্রা বেড়ে গেছে। ফলে শুকনো মৌসুম শুরুর আগেই পানিশূন্যতা সৃষ্টি হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড নাটোর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান বলেন, মানুষের প্রয়োজনেই চলন বিলে অবকাঠামো নির্মিত হয়েছে। তবে এগুলো পরিবেশের জন্য যেন হুমকি না হয়, এদিকে নজর রাখা হচ্ছে।
তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী নাটোর-৩ (সিংড়া) আসনের সাংসদ জুনায়েদ আহম্মেদ পলক বলেন, সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়েছে। চলন বিল উন্নয়নের জন্য একটি প্রকল্প অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। এ ছাড়া চলন বিল অঞ্চলের সাংসদদের নিয়ে একটি ফোরাম গঠনের চেষ্টা চলছে। এই ফোরাম চলন বিলের সুনির্দিষ্ট সমস্যা নিয়ে কাজ করবে।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা