জলবায়ুর প্রভাবে ‘সয়াল্যান্ড’ এর ব্রান্ডিং জেলা লক্ষ্মীপুরে এবার ৩শ’কোটি টাকার সয়াবিন হুমকির মুখে পড়েছে। দেশে উৎপাদনের ৭০ ভাগ সয়াবিন এ জেলায় উৎপাদন হলেও এবার লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। অসময়ে বৃষ্টিপাত হওয়ায় জেলার ২০ ভাগ কৃষক সয়াবিনের আবাদ করতে পারেনি চলতি মৌসুমে। আর যারা করেছেন তারাও লোকসানের আশঙ্কা করছেন। কৃষি গবেষকরা বলছেন, কৃষিতে জলবায়ুর প্রভাবে সয়াবিনের উৎপাদন কমেছে। তবে এ সঙ্কট মোকাবেলায় স্বল্প দিনের সয়াবিনের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে বলে জানান তারা।
এদিকে কৃষি অধিদপ্তর বলেছেন, উৎপাদন বাড়িয়ে ভৌজ্য তেল হিসেবে সয়াবিন তেল ব্যবহার করা হলে বাংলাদেশে যে ২০ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করা হয় সে আমদানির প্রায় অর্ধেক টাকা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঁচানো সম্ভব।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, গত ১০ বছরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশে উৎপাদিত সয়াবিনের মধ্যে লক্ষ্মীপুর জেলায় উৎপাদন হচ্ছে প্রায় ৭০ ভাগ সয়াবিন। গত বছর ৪৮ হাজার ৫৪৫ হেক্টর জমিতে সয়াবিন আবাদ হয়েছে, উৎপাদন হয়েছে ৮৬ হাজার ৪১০ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য প্রায় সোয়া ৩০০ কোটি টাকা। চলতি মৌসুমে সয়াবিন আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৫৩ হাজার ২৩৭ হেক্টর জমিতে। কিন্তু আবাদ হয়েছে ৪০ হাজার ৯১০ হেক্টর জমিতে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ১ লাখ ৯১৭ মেট্রিক টন। কিন্তু আবাদকৃত জমি অনুযায়ী সম্ভাব্য উৎপাদন ৭৭ হাজার ৭৩০ মেট্রিক টন।
কম খরচে বেশি লাভবান হওয়ায় জেলার ৫টি উপজেলার মধ্যে রামগতি, কমলনগর, সদর ও রায়পুরে কৃষকদের আগ্রহ বেশি সয়াবিন চাষে। জেলার প্রায় ৭৫ হাজার কৃষক সয়াবিন চাষ করে থাকেন। কিন্তু পরিসংখ্যান বলছে, লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদন ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। চলতি মৌসুমে জানুয়ারির শুরুতে একাধিকবার বৃষ্টি হওয়ায় সয়াবিন চাষীরা সময়মতো জমি প্রস্তুত ও বীজ রোপণ করতে পারেনি। জেলার ২০ ভাগ চাষী তাদের জমি রেখেছেন অনাবাদী। কেউ কেউ আবার আবাদ করেছেন বোরো ধান। অনেকে আবার দেরিতে হলেও সয়াবিন আবাদ করেছেন। তবে এসব চাষীরা বলছেন বিপুল সম্ভাবনা থাকলেও এবার বৃষ্টি হওয়ায় বীজ রোপণে দেরি হয়েছে তাদের। প্রতিবছর যেখানে এসময়ে ফল আসা শুরু করতো সেসময়ে অপরিপক্ক রয়ে গেছে সয়াবিন গাছ। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের আশঙ্কা করছেন চাষীরা।
এছাড়া প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে করে সয়াবিনে পচন ধরে চাষীরা ক্ষতিগ্রস্থ হন বলে জানান। কৃষি অধিদপ্তরের হিসাব মতে, গত ৩ বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় ২০০ কোটি টাকার সয়াবিন নষ্ট হয়েছে চাষীদের।
এদিকে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনষ্টিটিউট নোয়াখালী অঞ্চলের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মুহাম্মদ মহী উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, জলবায়ুর প্রভাব পড়েছে কৃষিতে। ২০১৪ সাল থেকে জলবায়ু সঙ্কটের আবর্তে আবর্তিত হচ্ছে সয়াবিন। এতে করে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সঙ্কট মোকাবেলায় স্বল্পদিনের সয়াবিনের জাত উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। এতে লক্ষ্মীপুরে সয়াবিন উৎপাদন আরও সমৃদ্ধি লাভ করবে বলে মতপ্রকাশ করেন এ কৃষি গবেষক।
লক্ষ্মীপুরে কৃষি অধিদপ্তরে উপ-পরিচালক কৃষিবিদ মোহাম্মদ বেলাল হোসেন খান বলেন, চলতি মৌসুমে সয়াবিন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি। এর কারণ হিসেবে অসময়ে বৃষ্টিপাত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগকে চিহ্নিত করে নতুন উদ্ভাবিত বীজ সরবরাহে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানান। এখানে সোহাগ, বারী-৬, বিনা-১ ও ভ্যারাইটি-১ জাতের সয়াবিন চাষ হচ্ছে। সয়াবিনের উৎপাদন আরও বাড়িয়ে তোলার প্রক্রিয়া চলছে। এর ফলে সয়াবিন তেল ভৌজ্য তেল হিসেবে ব্যাবহার করা হলে বাংলাদেশে যে ২০ হাজার কোটি টাকার ভৌজ্য তেল আমদানি করা হয় সেখানে কয়েক হাজার কোটি টাকা রাষ্ট্রীয়ভাবে বাঁচানো সম্ভব হবে বলে মত প্রকাশ করেন তিনি।
বিডি প্রতিদিন/ফারজানা