নাটোরের বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ হচ্ছে। প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। ঈদের পর থেকে এখন পযন্ত প্রায় অর্ধ শতাধিক মানুষ প্রাণ হারিয়েছে সড়ক দুর্ঘটনায়।
সর্বশেষ শনিবার সকাল ১১টার দিকে মহিষভাঙ্গা এলাকায় অটো রাইস মিলের সামনে মহাসড়কে রাজশাহীগামী ন্যাশনাল পরিবহন ও ঢাকাগামী সিয়াম পরিবহনের মধ্যে সংঘর্ষ ঘটে। এতে প্রাণ যায় সাত যাত্রীর। তাদের মধ্যে পাঁচজন পুরুষ ও তিন জন নারী।
ইতিপূর্বে ২০১৪ সালের ২০ অক্টোবর বড়াইগ্রামের রেজুর মোড়ে বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে ঘটে যাওয়া দেশের সবচেয়ে মর্মান্তিক বাস দুর্ঘটনায় ৩৭ জনের অকাল মৃত্যু হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কে দুর্ঘটনার পরিসংখ্যান আশংকাজনক হলেও তা রোধে কার্যকর কোন উদ্যোগ নেই। বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিম গোলচত্বর থেকে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল মোড় পর্যন্ত উত্তরাঞ্চল মহাসড়কটি এখন মরণ ফাঁদে পরিণত হয়েছে। এই মহাসড়ক পথে প্রতিদিন ঘটছে অহরহ দুর্ঘটনা। এ কারণে অসংখ্য মানুষের প্রাণহানির পাশাপাশি পঙ্গুত্ব বরণ করে মানবেতর জীবনযাপন করছে অনেকে। স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ ও মহাসড়কটি চার লেনে রুপান্তরের দাবি-দুর্ঘটনার দিনই সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের দুর্ঘটনাস্থলে এসে সারা দেশের মহাসড়কের তালিকাভূক্ত ১৭২টি বিপদজনক মোড়ের পাশাপাশি এ মোড়টিও সম্প্রসারণের প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু গত দুই বছরে জেলার কয়েকটি মোড় সম্প্রসারণ কাজ শুরু হলেও এ মোড়টি সম্প্রসারণের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি। দক্ষিণবঙ্গ ও বৃহত্তর রাজশাহীর প্রবেশদ্বার খ্যাত দেশের ব্যস্ততম ৫৫ কিলোমটিার দীর্ঘ এ মহাসড়কটি আরো প্রশস্ত করে রাস্তার মাঝখানে ডিভাইডার দিয়ে চার লেনবিশিষ্ট করাসহ মহাসড়কে গাড়ি দাঁড়ানো ও হাইওয়ে পুলিশের মাধ্যমে গতি নিয়ন্ত্রণ করা হলে দুর্ঘটনা অনেক কম হবে বলে মনে করেন স্থানীয়রা। দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ বাস দুর্ঘটনার স্থানটিতে স্মৃতি হিসাবে কোন নিদর্শন তৈরি করা হয়নি। এখানে একটি স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণের দাবি ছিল শুরু থেকেই।
হাইওয়ে বনপাড়া ও সলঙ্গা থানা সুত্র জানায়, উত্তরাঞ্চলের প্রবেশদ্বার সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর পশ্চিম এলাকা থেকে সলঙ্গা থানার হাটিকুমরুল গোলচত্বর পর্যন্ত দীঘ ১৮ কিলোমিটার এলাকা হাইওয়ে পুলিশের আওতায় রয়েছে এবং বনপাড়া হাইওয়ে থানার অধিনে ২৬ কিলোমিটার। মহাসড়কের আরোও প্রায় ১১০ কিলোমিটার পথ।
গত জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত মহাসড়কে দুর্ঘটনায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ নিহত ৫০ ও আহত হয়েছে কমপক্ষে ১৬০ জন। এই মহাসড়কের চিহ্নিত স্থান কড্ডার মোড়, ঝাঐল ওভারব্রিজ,নলকা মোড়,পাঁচলিয়া,হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের গোজাব্রীজ, সাতর্টিরী, নাইমুরী, হরিণচরা, দবিরগঞ্জ, মহিষলুটি, মান্নাননগর, হামকুড়িয়া এবং নাটোর অংশে আগ্রান বাজার, কাছিকাটা, বিলবিলাস, রাজাকার মোড়, রেজুর মোড়, নয়াবাজার, সুতিরপাড়, চলনবিল ফিলিং ষ্টেশন অধিক দুর্ঘটনাপ্রবণ এলাকা। দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসাবে মহাসড়কে রোড ডিভাইডার না থাকা, ওভারব্রিজ না থাকা, চলাচলকারী যানবাহনের অধিক গতিবেগ, বাসের ছাদে যাত্রী উঠানো ,অবৈধ ভটভটির চলাচল আর চালকদের অর্সতকতা বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। এলাকাবাসীর র্দীঘদিনের দাবি রোড ডিভাইডার ও ওভারব্রিজের।
সরকার দ্রত এ দাবি বাস্তবায়নের আশ্বাস দিলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। এ অবস্থায় দুর্ঘটনা দিনে দিনে বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে যমুনা সেতুর পশ্চিম সংযোগ সড়ক থেকে হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের দুর্ঘটনা রোধ করা যাচ্ছে না। প্রাথমিকভাবে চালকদের অনিয়ন্ত্রিত আর বেপরোয়া গতি, অতিরিক্ত যাত্রী বহন, দূর্বল ট্রাফিক সিগনাল পদ্ধতি এই দূর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত করা হলেও সেদিকে নজর দেওয়া হয়নি। সরকার ২০১৪ সালে যমুনা সেতুর দুই প্রান্তের সড়কগুলোকে ৪ লেনে উন্নতি করার ঘোষণা দিলেও তা আজও পর্যন্ত বাস্তবায়ন হয়নি।
বড়াইগ্রাম উন্নয়ন সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক ডিএম আলম বলেন, এই সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ গাড়ির বেপরোয়া গতি। সড়ক ও মহাসড়কগুলোতে যদিও গাড়ি দ্রুত চালানোর মত অবস্থা নেই তথাপিও চালকরা বেপরোয়া গতিতে চালান। আর এ কারণে তারা গাড়ির উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনায় পড়েন।
তিনি বলেন, গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণে রাখলে, মদ্যপান অবস্থায় গাড়ি না চালালে, মোটরসাইকেল চালকরা হেলমেট পরলে, গাড়ি চালানোর সময় সিলবেল্ট পরলে দুর্ঘটনা কমে আসবে।
উপজেলা চেয়ারম্যান ও স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা ডা. সিদ্দিকুর রহমান পাটোয়ারী বলেন, গাড়ির গতিসীমা নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন প্রণয়ন জরুরি। পাশাপাশি মহাসড়কগুলোতে দুর্ঘটনা রোধে বিভিন্ন ধরনের সাংকেতিক চিহ্ন ব্যবহারের বোর্ড দিতে পারলে দুর্ঘটনা রোধ হয়।
বনপাড়া হাইওয়ে থানার ওসি মশিউর রহমান বলেন, যদি দুর্ঘটনাকবলিত স্থানগুলোতে ফুট ওভারব্রিজ দেওয়া হয় তবে দুর্ঘটনা ৮০ ভাগই কমানো সম্ভব।
বগুড়ার (হাইওয়ে) পুলিশ সুপার মুন্সি শাহাবুদ্দিন বলেন, মহাসড়কগুলোতে বাসসহ অন্যান্য যানবাহন যেন পাল্লা দিয়ে না চলে, নির্দিষ্ট গতি সীমার মধ্যে থাকে, পাশাপাশি ট্রাফিক আইন মেনে চলে সে সকল বিষয়ে কাজ করে হাইওয়ে পুলিশ। যাতে করে কোনো গাড়ি এ সকল কারণে দুর্ঘটনায় না পড়ে- সে ব্যাপারে আমরা সচেতন থাকি। সড়কে দুর্ঘটনায় যেভাবে প্রাণ যাচ্ছে তাতে মানুষ আর সড়ককে নিরাপদ ভাবতে পারছে না। এ কারণে সড়ককে যাতায়াতের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে সরকারের প্রতি দাবি এখন সবার।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল