নাটোর ডিগ্রি কলেজের সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহারের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এই শিক্ষিকার মরদেহ রবিবার ভোরে নাটোর শহরের বলারীপাড়ার ভাড়া বাসা থেকে উদ্ধার করা হয়।
তবে হত্যা নাকি আত্মহত্যা বিষয়টি নিশ্চিত হতে বাসা থেকে আটক স্বামী কলেজছাত্র মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ। প্রায় ৪৭ বছর বয়সী শিক্ষিকা খায়রুন নাহার তার ২২ বছর বয়সী স্বামী মামুনকে নিয়ে নাটোর শহরের বলারীপাড়ার হাজী নান্নু মোল্লা ম্যানশনের চারতলায় ভাড়া থাকতেন।
পুলিশ, ভবনের পাহারাদার ও নিহতের স্বজনরা জানায়, নাটোরের বলারীপাড়ার হাজী নান্নু মোল্লা ম্যানশনের ফটক নিয়মিত রাত ১০টায় বন্ধ করে দেওয়া হয়। শনিবার রাত ১১টার পর খায়রুন নাহারের স্বামী মামুন বাসায় আসেন। আবার রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে পাহারাদারকে দিয়ে গেট খুলে মোটরসাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে যান। এ সময় বাসার পাহারাদার নাজিম উদ্দিন তাকে এতো রাতে বাইরে যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে অসুস্থতার জন্য হাসপাতালে যাওয়ার কথা বলেন।
পরে রবিবার সকাল ৬টার দিকে মামুন বাসায় ফিরে আসেন। একটু পরেই তিনি বাসার পাহারাদারকে জানান তার স্ত্রী খায়রুন নাহার সিলিং ফ্যানের সাথে গলায় ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। সাথে সাথে তিনি ওই বাসায় গিয়ে দেখতে পান ঘরের মেঝেতে অধ্যাপিকার লাশ পড়ে আছে। বিষয়টি তার সন্দেহ হওয়ায় তিনি মামুনসহ কক্ষের দরজা বাইর থেকে আটকে দিয়ে বাসার মালিক নান্নু হাজীকে বিষয়টি জানান। এরপর বাসা মালিক নাটোর থানায় ফোন করে পুলিশকে বিষয়টি জানান।
খায়রুন নাহার গুরুদাসপুর উপজেলার চাঁচকৈড় পৌর এলাকার মো. খয়ের উদ্দিনের মেয়ে। তার স্বামী মামুন হোসেন একই উপজেলার ধারাবারিষা ইউনিয়নের পাটপাড়া গ্রামের মোহাম্মদ আলীর ছেলে ও নাটোর নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা সরকারি কলেজের ডিগ্রি দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। খায়রুন নাহার ছাত্রজীবনেই রাজশাহীর বাঘা উপজেলার আড়ানী এলাকায় বিয়ে করেন। সেই স্বামীর সাথে তালাকের এক বছর পর ফেসবুকের মাধ্যমে মামুনের সাথে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের ছয় মাস পর গত বছরের ১২ ডিসেম্বর কাজী অফিসে গিয়ে দুজন গোপনে বিয়ে করেন।
বিয়ের প্রায় ৬ মাস পর গত জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ঘটনাটি এলাকায় জানাজানি হলে বেশ আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সারাদেশের সচেতন মানুষ ছাত্রকে শিক্ষিকার বিয়ের পক্ষে ও বিপক্ষে দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে হাজারো মন্তব্য করেন।
তার ঘনিষ্ঠজনরা জানিয়েছেন, বিয়ের পর নিজের কর্মস্থলের কোনো সহকর্মী খায়রুন নাহারের সাথে কথা বলতেন না। আত্মীয়স্বজনরাও তাকে ত্যাগ করেছিলেন। এর মধ্যে অসম বয়সের বিয়ে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নানা কটূক্তি তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তুলেছিল।
রবিবার সকালে পুলিশ আটকের সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনে মামুন বলেন, খায়রুন নাহারের বিভিন্ন ব্যাংক ও এনিজও’তে ১৬ লাখ টাকার বেশি ঋণ রয়েছে। এর মধ্যে তার ছেলে ৬ লাখ টাকা দামের একটি মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য চাপ দিচ্ছিলেন। এসব বিষয়ে খায়রুন নাহার মানসিকভাবে খুবই চাপে ছিলেন। তাই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
নিহত সহকারী অধ্যাপক খায়রুন নাহারের ভাতিজা নাহিদ হাসান বলেন, নতুন এই বিয়ের পর থেকেই মামুন তার স্ত্রীর কাছে পালসার মোটরসাইকেলসহ প্রায় পাঁচ লাখ টাকা নিয়েছে। নতুন করে আবার আর ওয়ান-৫ মোটরসাইকেল কিনে দেওয়ার জন্য বউকে চাপ দিচ্ছিলেন। মামুন নেশা করতেন। তার চাপেই তিনি আত্মহত্যা করেছেন।
খায়রুন নাহারের চাচাতো ভাই সাবির উদ্দিন বলেন, অসম বয়সের বিয়ে হওয়ায় খায়রুন নাহারের কলেজের কোনো সহকর্মী তার সাথে কথা বলতেন না। বাবা-মাসহ আত্মীয়স্বজনরা যোগাযোগ রাখতেন না। বিয়ের বিষয়টি গণমাধ্যমে আসার পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে ব্যাপক সমালোচনা হওয়ায় খাযরুন নাহার মানসিকভাবে বিপর্যস্ত ছিলেন।
এ বিষয়ে কথা বলার জন্য মামুনের কোনো স্বজনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তার বাবা মোহাম্মদ আলীর মোবাইল ফোন বন্ধ। তার চাচা আহম্মদ আলী মেম্বারকেও মোবাইল ফোনে পাওয়া যায়নি।
এদিকে, ঘটনার পর নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা, পিবিআই পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিন ও সহকারী পুলিশ সুপার মহসিনসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
পিবিআই পুলিশ সুপার শরিফ উদ্দিন বলেছেন, সব আলামত সংগ্রহ করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট ও তদন্ত অগ্রসর হলে এ বিষয়ে পরিষ্কার কিছু বলা যাবে।
নাটোরের পুলিশ সুপার লিটন কুমার সাহা বলেছেন, বিষয়টি আত্মহত্যার মতোই মনে হচ্ছে। সিলিং ফ্যানে ওড়না দিয়ে ঝুলন্ত অবস্থা থেকে যেভাবে ওড়না আগুন দিয়ে পুড়িয়ে খায়রুন নাহারকে তার স্বামী নামিয়েছেন, এটা বিশ্বাসযোগ্য। কাপড় এবং ফ্যানের কিছু অংশ পোড়া অবস্থায় দেখা গেছে। তারপরও মধ্যরাত থেকে সকাল পর্যন্ত স্বামী মামুন বাইরে থাকাসহ সবগুলো পয়েন্ট মাথায় রেখেই পুলিশ তদন্ত কাজ শুরু করেছে। মামুনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেলে এবং পুলিশের প্রাথমিক তদন্ত শেষ হলে এ বিষয়ে বিস্তারিত বলা যাবে।
বিডি প্রতিদিন/এমআই