কুমিল্লার মুরাদনগর উপজেলার কড়ইবাড়িতে মা, ছেলে ও মেয়েসহ তিনজনকে প্রকাশ্যে পিটিয়ে হত্যার ২ দিনেও মামলা কিংবা ঘটনার সঙ্গে জড়িত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। ঘটনার পর থেকে পুরো এলাকা পুরুষশূন্য হয়ে পড়েছে। এখনো এলাকায় থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে গ্রামে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়ন রয়েছে।
এদিকে মোবাইল ফোন চুরির ঘটনায় সমাজপতিদের অপমান করা নিয়ে এই ঘটনা ঘটে। এছাড়া মাদক ব্যবসা ও চুরি ছিনতাই নিয়ে স্থানীয়রাও দীর্ঘ দিন ধরে তাদের প্রতি অতিষ্ঠ ছিল।
এর আগে স্থানীয় বাজারে এক স্কুল শিক্ষকের মোবাইল ফোন চুরির জের ধরে বৃহস্পতিবার (৩ জুলাই) সকাল সাড়ে ৯টার দিকে উপজেলার আকবপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামবাসী একত্রিত হয়ে খলিলুর রহমানের স্ত্রী মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা আক্তার রুবি (৫৫), তাঁর ছেলে রাসেল মিয়া (৩৮) ও মেয়ে জোনাকীকে (৩২) পিটিয়ে হত্যা করে। এ সময় তাদের পিটুনিতে গুরুতর আহত হন নিহত রুবির মেয়ে রুমা আক্তার (২৪)। তিনি বর্তমানে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
পুলিশ জানিয়েছে, নিহত পরিবারের পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে ৫০টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে নিহত রুবিসহ তিনজনের বিরুদ্ধে ৩০টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই মাদক কেনাবেচা এবং মারামরির ঘটনা।
বাঙ্গরা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাহফুজুর রহমান বলেন, ঘটনার পরপরই পুলিশ অভিযানে নামে। শুক্রবার বিকাল পর্যন্ত পুলিশসহ একাধিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী অভিযান চালিয়েছে, এখনও কাউকে গ্রেফতার করা যায়নি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে কড়ইবাড়িতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নিহত পরিবারের সঙ্গে কথা হয়েছে। তারা মামলা দায়েরের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আমাদের গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
হত্যার নেপথ্যে :
নিহত রুবিসহ তার পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত থাকলেও হত্যার নেপথ্যে মিলেছে ভিন্ন তথ্য। গত মঙ্গলবার (১ জুলাই) সকালে কড়ইবাড়ি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রুহুল আমীন কড়ইবাড়ি বাজারে স্কুলের কাগজপত্র ফটোকপি করতে যান। ওই সময় এক কিশোর কৌশলে শিক্ষকের মোবাইল ফোনটি চুরি করে নিয়ে যায়। তাৎক্ষণিক ওই শিক্ষক মোবাইল ফোন চুরির বিষয়টি সবাইকে জানালে হায়দরাবাদ সড়কের মাথা থেকে ওই কিশোরকে ধরে মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করা হয়।
ফোন চুরি করে নেয়া কিশোর ছিল নিহত রোখসানা আক্তার রুবির আত্মীয়। খবর পেয়ে রুবি, তার মেয়ে জোনাকীর স্বামী মনির ও ছেলে রাসেল শিক্ষক রুহুল আমীন ও স্থানীয় ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়ার সঙ্গে বাগবিতন্ডায় জড়ান। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারা শিক্ষক রুহুল আমীন ও বাচ্চু মিয়াকে মারধর করেন। ঘটনা জানতে পেরে রুহুল আমীনের ভাতিজা রবিউল ও ফয়েজ এগিয়ে এলে তাকেও মারধর করা হয়। ওই দিন বাড়ি গিয়ে বাচ্চু মিয়া, রবিউল ও ফয়েজকে দ্বিতীয় দফায় মারধর করেন রুবির পরিবারের সদস্যরা।
পরিবারটির এমন বেপরোয়া আচরণে এলাকাবাসী ক্ষিপ্ত হয়। এনিয়ে বুধবার (২ জুলাই) বিকেলে কড়ইবাড়ি তিন রাস্তার মোড়ে এলাকাবাসী একত্রিত হয়। সেখানে উপস্থিত হন আকবপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শিমুল বিল্লাহও। এ সময় বিক্ষুব্ধ এলাকাবাসী নিহত মাদক ব্যবসায়ী রুবি ও তার পরিবারকে আর ছাড় দেওয়া হবে না বলে যৌথ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সকাল সাড়ে ৮টা থেকে এলাকাবাসী জড়ো হতে থাকেন। পরে সকাল সাড়ে ৯টার দিকে পরিকল্পিতভাবে নিহত রুবির বাড়িতে যান। এ সময় স্থানীয়দের দেখে রুবি ক্ষিপ্ত হয়ে কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে ইউপি সদস্য বাচ্চু মিয়াকে চড়-থাপ্পড় দেন। সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত গ্রামবাসী রুবি ও তার মেয়ে জোনাকিকে পিটিয়ে মেরে ফেলে। খবর পেয়ে শ্বশুরবাড়ি বেড়াতে যাওয়া রুবির ছেলে রাসেল মোটরসাইকেল নিয়ে ছুটে আসেন। বাড়ির গেটে আসার পরপরই উত্তেজিত জনতা রাসেলকেও পিটিয়ে হত্যা করেন। এ সময় অপর মেয়ে রুমা আক্তার মুমূর্ষু অবস্থায় পড়ে ছিল। পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করে মুরাদনগর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে পাঠান।
আকবপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান শাহ আলম জানান, নিহত পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে মাদক কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। কিছু হলেই গ্রামের মানুষের সঙ্গে উগ্র ভাষা ব্যবহার করতেন। মোবাইল ফোন চুরির ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিবারের চার সদস্যকে গণপিটুনি দেয়।
নিহত রাসেল মিয়ার স্ত্রী মীম আক্তার বলেন, আমার শ্বশুর খলিলুর রহমান ও ননদ রিক্তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। তিনি ভেবে পাচ্ছিলেন না কেন এমন নির্মম ঘটনা ঘটেছে। তিনি দায়ীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেছেন।
নিহত ৩ জনের যত মামলা:
নিহত চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ী রোকসানা আক্তার রুবির বিরুদ্ধে ১৬টি মামলা রয়েছে, তাঁর ছেলে রাসেল মিয়ার বিরুদ্ধে ৯টা, মেয়ে জোনাকীর বিরুদ্ধে ৫টি। এছাড়াও নিহত রুবির মেয়ে আহত রুমার বিরুদ্ধে ২টি এবং নিহত জোনাকীর স্বামী মনিরের বিরুদ্ধে ১১টি মামলা রয়েছে। রুবির স্বামীর বিরুদ্ধে ৭টি মামলা রয়েছে। এসব মামলার অধিকাংশই মাদক কেনাবেচার অভিযোগে দায়ের করা।
বিডি প্রতিদিন/হিমেল