কুয়াকাটা সৈকতের কোলঘেঁষা সবুজের দীর্ঘ আস্তরণ এখন আর নেই। সব যেন ধূসর, বিবর্ণ হয়ে রয়েছে। অসংখ্য মরা গাছের গোড়া স্বাক্ষী হয়ে পড়ে আছে। খাজুরা থেকে গঙ্গামতি ও কাউয়ার চর পর্যন্ত এমন অবস্থা। একদিকে সাগর পাড়ে যেমন প্রকৃতির রোষানল।
অন্যদিকে বনদস্যুদের তাণ্ডবে সবুজ প্রকৃতি বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সমুদ্রের পানিতে মাত্রাতিরিক্ত লবণাক্ততার পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে সাগর পার ঘেঁষা প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বনাঞ্চল ও বন বিভাগের বাগান নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ফলে লাল কাঁকড়াসহ জীববৈচিত্র রয়েছে চরম হুমকিতে। দুর্যোগকালীন জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটা প্রতিরোধে সবুজ দেয়ালখ্যাত বনাঞ্চল ও সৈকতের বালুক্ষয় রক্ষায় এখন পর্যন্ত স্থায়ী কোন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়নি বলে জানিয়েছেন পরিবেশকর্মীরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেড়িবাঁধের বাইরে কুয়াকাটা সৈকতের দীর্ঘ ১৮কিলোমিটার এলাকার দেড় সহস্রাধিক একর বনভূমিসহ সংরক্ষিত বনাঞ্চল সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের তাণ্ডবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পাশাপাশি চরগঙ্গামতি সংরক্ষিত বনে চলছে বনখোকো চক্রের আগ্রাসী তাণ্ডব। এতে যেমন উজাড় হচ্ছে ম্যানগ্রোভ-ননম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল, তেমনি পরিবেশের ভারসাম্য মারাত্মক হুমকির মুখে পড়ছে। এদিকে সংঘবদ্ধ একটি চক্র কখনো দিনের আলোয়, আবার কখনো রাতের অন্ধকারে নির্বিচারে বনের গাছসহ সৈকতে উপরে পড়া গাছপালা কাটছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ রয়েছে। মূলত ২০০৭ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে সিডর, আইলা, মহাসেন, নার্গিস ও মোরাসহ একাধিক প্রাকৃতি দুর্যোগ পাল্টে দিয়েছে উপকূলের চিত্র।
তবে বনাঞ্চল যেটুকু অবশিষ্ট আছে তাও আগামী দুই এক বছরে প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা অমাবস্যা-পূর্ণিমার অস্বাভাবিক জোয়ারের উত্তাল ঢেউয়ের তান্ডবে বিলীন হওয়ার শঙ্কায় রয়েছে। তাই দ্রুত সময়ে এসব রক্ষায় কার্যকরী পদক্ষেপের দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের মতে, বন উজাড় হলে উপকূল আরও ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। গাছের শেকড় শুধু ভূমি ধরে রাখে না,বরং জলোচ্ছ্বাসের সময় প্রাকৃতিক প্রতিরক্ষা দেয়। নির্বিচারে ম্যানগ্রোভ-ননম্যানগ্রোভ গাছ ধংস করার ফলে উপকূলীয় ভাঙন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি বহুগুণে বাড়বে এমনটাই মনে করছেন তারা।
পরিবেশকর্মী আবুল হোসেন রাজু বলেন, ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় এ প্রাকৃতির সবুজ দেয়াল উপকূলের রক্ষা কবজ হিসেবে কাজ করে। তাই এ বনাঞ্চল আমাদেরই রক্ষা করা উচিৎ বলে তিনি জানান।
উপকূল পরিবেশ রক্ষা আন্দোলন উপরা’র সদস্য সচিব মো.আসাদুজ্জামান মিরাজ বলেন, সৈকতের অধিকাংশ বনাঞ্চল সাগরে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। এছাড়া পরিবেশ রক্ষায় উপক‚লীয় গুরুত্বপূর্ণ বন হিসেব খ্যাত গঙ্গামতির এই বনাঞ্চল। এই বনের উপর নির্ভর করে টিকে আছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। রক্ষা হচ্ছে উপক‚লের লাখো মানুষের জীবন। বন্যপ্রাণীর অভয়াশ্রম হচ্ছে এই বন। বনাঞ্চল প্রাকৃতিক দুর্যোগের ছোবল থেকে উপকূলের মানুষের রক্ষাকবচ হিসেবেও বেশ ভূমিকা রাখে।
বন বিভাগ মহিপুর রেঞ্জ কর্মকর্তা কে এম মনিরুজ্জামান বলেন, প্রচণ্ড লবণাক্ততায় এসব গাছ মরে যাচ্ছে। এছাড়া কোনো প্রটেকশন না থাকায় ধারাবাহিক জলোচ্ছ্বাসের ঝাপটায় বালুর স্তর ধুইয়ে প্রতিদিনই উপরে পড়েছে এসব গাছপালা। যে সমস্ত গাছপালা উপরে পড়ে আছে অথবা জীবিত গাছগুলো রক্ষায় নিয়মিত টহল কার্যক্রম জোরদার করা হয়েছে। একই সাথে বনাঞ্চল পরিদর্শন করে বন বিভাগের গাছ কাটার দায়ে ৪টি মামলা করা হয়েছে বলে তিনি জানান।
বিডি প্রতিদিন/নাজমুল