উত্তরবঙ্গের মানুষের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের এক জীবন্ত দলিল ‘ঢেমঢেমিয়া কালিমেলা’। দেড়শ বছর ধরে টিকে থাকা এই মেলা আজও স্মরণ করিয়ে দেয় গ্রামবাংলার প্রাণচাঞ্চল্য ও মানুষের উৎসবপ্রাণতা। তবে এই মেলা শুধুই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের শ্যামাপূজাকে কেন্দ্র করে সীমাবদ্ধ নয়, বরং উত্তরবঙ্গের লাখো মানুষের অন্যতম বিনোদন ও অর্থনৈতিক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে।
দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সীমান্তঘেষা পলাশবাড়ী ইউনিয়নের বৈরবাড়ী, চাপাপাড়া ও হিরামণি মৌজার বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে সোমবার বিকেলে শুরু হয়েছে এই প্রাণচঞ্চল ঐতিহ্যবাহী মেলা। বাংলা ১২৮০ সাল থেকে শুরু হওয়া এই কালিমেলায় প্রতি বছর কার্তিক মাসের আমাবস্যা তিথিতে পূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। সাত দিনব্যাপী পূজা হলেও মেলার প্রাণ প্রায় মাসজুড়ে টিকে থাকে। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষ এখানে মিলিত হন।
মেলার সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ঘোড়া ও মহিষের হাট। মেলা শুরুর আগেই দেশজুড়ে আলোচনায় আসে এই মেলা। মূলত ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, নীলফামারী, জামালপুর, নেত্রকোনা, রাজশাহী, নওগাঁ, রংপুরসহ আশপাশের জেলার ক্রেতা-বিক্রেতারা নিজেদের পছন্দের ঘোড়া ও মহিষ নিয়ে হাজির হন। মাঠজুড়ে ঘোড়ার দৌড়ঝাঁপ, বিক্রেতাদের আহ্বান ও ক্রেতাদের দরদাম মিলিয়ে এক অন্যরকম দৃশ্য সৃষ্টি হয়।
ঘোড়ার কর্মদক্ষতা ও চেহারার ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয় বাহারি নাম, যেমন - পারলে ঠেকাও, কিরণমালা, পঙ্খিরাজ, মায়াবতী, বাহাদুর রাণী, সম্রাট। বিক্রেতারা ঘোড়া বিক্রির আগে খোলা মাঠে তার দৌড়, বুদ্ধি, কর্মদক্ষতা ও গতি প্রদর্শন করেন, এরপর দরদাম ঠিক হয়। এ বছর মেলায় ছোট জাতের ঘোড়ার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি। দাম ৫ হাজার থেকে ৪ লাখ টাকার মধ্যে পরিবর্তিত হচ্ছে।
নওগাঁ জেলার ধামরহাট থেকে মেলায় এসেছেন ঘোড়া বিক্রেতা শামসুল আলম। তিনি বলেন, ‘আমি ছোট-বড় বিভিন্ন জাতের ঘোড়া নিয়ে মেলায় এসেছি। সাতটি বিক্রি করেছি, বাকিগুলো বিক্রি হবে আশা করছি। দাম পেয়েছি ভালো, তবে মেলায় ছোট ঘোড়ার চাহিদাই সবচেয়ে বেশি এবং ক্রেতাদের সমাগমও ভালো।’
ঘোড়ার পাশে সারি সারি মহিষ। শতশত মহিষ বাঁধা মাঠজুড়ে ক্রেতাদের দরদাম ও দৌড়ঝাঁপ চলছে। জামালপুর থেকে আসা মহিষ ক্রেতা শাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমি এই মেলায় দুই জোড়া মহিষ কিনেছি ১০ লাখ ৪০ হাজার টাকায়। এবার মহিষ আমদানি বেশি হলেও বাজার একটু বেশি।’
ঘোড়া-মহিষের হাট ছাড়াও মেলায় রয়েছে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী পণ্যের দোকান। ঘোড়ার গাড়ি, লাগাম, জোয়াল, লাঙ্গলসহ কৃষি কাজে ব্যবহৃত নানা সরঞ্জামের পাশাপাশি পাওয়া যাচ্ছে খেলনাসামগ্রী, মিঠাই-মিষ্টান্ন, হাতে তৈরি অলঙ্কার ও নাগরদোলাসহ শিশুদের বিনোদনের নানা আয়োজন।
বিডি-প্রতিদিন/মাইনুল