শুক্রবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৩ ০০:০০ টা

পিকসিওলা

মূল : জেমস বাল্ডউইন - অনুবাদ : আকতার জামিল

পিকসিওলা

বহু বছর আগে ফ্রান্সের এক বৃহৎ কারাগারে চার্নি নামে এক গরিব লোককে বন্দি করে রাখা হয়েছিল। সে অত্যন্ত দুঃখী ও অসুখী ছিল। ভুলক্রমে তাকে কারাগারে বন্দি করা হয়। তার কাছে মনে হতো পৃথিবীতে তাকে দেখার কেউ নেই।

কারাগারে কোনো বই না থাকায় সে পড়তে পারত না। কলম বা কাগজ রাখার অনুমতি না থাকায় সে লিখতেও পারত না। দিন বয়ে যেতে লাগল। কিন্তু সময় পার করার মতো তেমন কিছুই ছিল না তার। কারাগারের পাকা উঠানে ঘুরে বেড়ানোই ছিল তার একমাত্র বিনোদন। করার মতো কোনো কাজও ছিল না, কথা বলার মতো লোক ছিল না।

বসন্তের এক চমৎকার সকালে চার্নি কারাগারের আঙিনায় হাঁটছিল আর পাথর গুনছিল, যেমনটি সে এর আগে হাজারবার করেছে। হঠাৎ বিস্ময়ে সে থেমে গেল। দুটি পাথরের মাঝে মাটির ছোট্ট ঢিবিটি কী তৈরি করেছে?

দেখার জন্য সে নিচু হলো। দুটি পাথরের মাঝে একটা বীজ। অঙ্কুরিত হয়ে একটি ছোট সবুজ পাতা সেখান হতে ওপরে উঠে এসেছে। পাতার ওপরে এক ধরনের নরম প্রলেপ থাকায় চার্নি পা দিয়ে এটিকে পিষে ফেলতে যাচ্ছিল।

কিন্তু পরক্ষণেই সে ‘আহ!’ করে উঠল। ‘আবরণটি এটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য। আমি অবশ্যই এটির ক্ষতি করব না।’ আর এই বলে সে হাঁটতে থাকল।

পরের দিন কোনো কিছু না ভেবেই গাছটির দিকে সে পা বাড়াল। এরপর নিচু হয়ে দেখল গাছটিতে এখন দুটি পাতা গজিয়েছে। আর গাছটি আগের দিনের চেয়ে অনেক শক্ত এবং সবুজ। সে দীর্ঘক্ষণ দাঁড়িয়ে এটিকে দেখতে লাগল।

প্রচণ্ড ঠান্ডায় গাছটি জমে গেছে কি না বা প্রখর রোদে ঝলসে গেছে কি না তা দেখার জন্য এরপর রোজ সকালে চার্নি ছোট্ট গাছটির কাছে যেত। সে দেখতে যেত গাছটি কতটুকু বড় হয়েছে।

এক দিন সে জানালা দিয়ে তাকিয়েছিল। হঠাৎ জেলরকে উঠান পেরিয়ে যেতে দেখল। লোকটি ছোট্ট গাছটির এত কাছে যেয়ে ব্রাশ করছিল যে, মনে হচ্ছিল গাছটিকে সে পিষে ফেলবে। চার্নির পা থেকে মাথা পর্যন্ত কেঁপে উঠল।

‘ও আমার পিকসিওলা!’ সে চিৎকার করে উঠল।

জেলর তার খাবার আনতে এলে সে তার ছোট্ট গাছটিকে বাঁচানোর জন্য অনুরোধ করল। সে ভেবেছিল জেলর তার কথায় হাসবে; কিন্তু একজন জেলর হলেও তার হৃদয় ছিল কোমল।

‘তুমি কি ভেবেছ আমি তোমার ছোট্ট গাছটিকে আঘাত করব?’ জেলর বলল। ‘একদমই না। অনেক আগেই হয়ত উপড়ে ফেলতাম, যদি না দেখতাম যে তুমি গাছটিকে নিয়ে এত ভাবছ।’

‘সত্যিই আপনি খুব ভাল,’ চার্নি বলল। জেলরকে নির্দয় ভেবে সে লজ্জা পেল।

সে তার পিকসিওলা নাম রাখা গাছটিকে প্রতিদিন দেখতে যেত। দিনে দিনে এটি বড় এবং আরও সুন্দর হয়ে উঠছিল। কিন্তু এক দিন জেলরের কুকুরের বিশাল পায়ের নিচে পড়ে গাছটি প্রায় ভেঙে পড়ার উপক্রম হলো। এটি দেখে চার্নি মনে খুব কষ্ট পেল।

‘পিকসিওলাকে বেড়া দিয়ে ঘিরে দিতে হবে,’ সে বলল। ‘দেখি আমি এটি করতে পারি কি না।’

রাতে অনেক ঠান্ডা পড়ত। তবুও অনুমতি নিয়ে কাঠের কিছু কিছু অংশ সংগ্রহ করে গাছটির চারপাশে সে বেড়া দিয়ে দিল।

গাছটির হাজারো সৌন্দর্য তার নজরে এলো। সে দেখত গাছটি কীভাবে সবসময় সূর্যের দিকে একটু বেঁকে থাকে; ঝড়ের আগে গাছের ফুলগুলো কীভাবে তাদের পাপড়ি গুটিয়ে নেয়।

এর আগে এ বিষয়গুলো নিয়ে সে কখনো ভাবেনি। কিন্তু প্রায়শই তার কল্পনায়  ফুলে ভরা বাগান উঁকি দিত।

এক দিন ঝুল ও পানি দিয়ে সে কিছু কালি তৈরি করল; কাগজ হিসেবে রুমাল এবং কলম হিসেবে একটি ধারালো লাঠি বেছে নিল। সে ভাবল কারাগারে সবটুকু সময় সে গাছের সঙ্গে কাটাচ্ছে। তাকে অবশ্যই তার ছোট্ট গাছটির কথা লিখে রাখতে হবে।

‘এই দেখুন আমার প্রভু এবং আমার ভদ্রমহিলা!’ চার্নি ও গাছটিকে দেখলেই জেলর বলে উঠত।

গ্রীষ্ম চলে যেতেই পিকসিওলা আরও সুন্দর হয়ে উঠল। এর ডালে কমপক্ষে ত্রিশটির মতো ফুল ছিল।

কিন্তু এক বিষণœ সকালে ফুলগুলো ঝরে পড়তে লাগল। চার্নি কী করবে বুঝে উঠতে পারল না। সে গাছে পানি দিল, কিন্তু তবুও ফুলগুলো ঝরে গেল। পাতাগুলো শুকিয়ে যাচ্ছিল। চার্নি বুঝতে পারল জেলখানার পাথরগুলো গাছটিকে আর বাঁচতে দেবে না।

চার্নি জানত যে, তার এ অমূল্য সম্পদ বাঁচানোর একটিই মাত্র উপায়। হায়রে! কিন্তু সে কীভাবে আশা করতে পারে, এটা করা সম্ভব? পাথরগুলো একবারে তুলে নিতে হবে।

কিন্তু পাথরগুলো তুলে ফেলতে জেলর সাহস পাননি। কারাগারের নিয়ম কঠোর ছিল এবং কারও পক্ষে পাথর সরানো সম্ভব ছিল না। দেশের সর্বোচ্চ কর্মকর্তারাই কেবল এটা করতে পারতেন।

পিকসিওলাকে মরতে হবে এই চিন্তায় বেচারা চার্নি সারারাত ঘুমাতে পারেনি। ইতোমধ্যে ফুল শুকিয়ে গেছে; শিগগিরই ডাল থেকে পাতা ঝরে পড়বে।

তখন চার্নির মাথায় নতুন ভাবনা এলো। সে নেপোলিয়ন, স্বয়ং মহান সম্রাটকে তার গাছটিকে বাঁচাতে বলবে।

কিন্তু যাকে সে ঘৃণা করে, যে লোকটি তাকে এই কারাগারে আটকে রেখেছে তার অনুগ্রহ চাওয়া চার্নির পক্ষে কঠিন কাজ ছিল।

সে তার রুমালে গাছের কথাগুলো লিখল। তারপর একটি মেয়ের হাতে ধরিয়ে দিল যে, এটি সম্রাট নেপোলিয়নের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল।

কী দীর্ঘ যাত্রা ছিল সেই তরুণীর জন্য! চার্নি এবং পিকসিওলার জন্যও কত দীর্ঘ, ভীষণ অপেক্ষা!

অবশেষে খবর এলো কারাগারে। পাথরগুলো তুলে নেওয়া হবে। পিকসিওলা রক্ষা পাবে!

সম্রাটের দয়ালু স্ত্রী চার্নির গাছের যত্ন নেওয়ার গল্প শুনেছিলেন। তিনি সেই রুমালটি দেখেছিলেন যার ওপর সে গাছটিকে বাঁচানোর সুন্দর উপায়গুলো লিখেছিল।

‘অবশ্যই এমন একজন মানুষকে কারাগারে রাখা আমাদের কোনো উপকার বয়ে আনতে পারে না,’ তিনি বললেন।

তাই শেষ পর্যন্ত চার্নিকে জেলখানা হতে মুক্তি দেওয়া হলো। সে আর দুঃখী এবং প্রেমহীন রইল না। সে দেখল ঈশ্বর কীভাবে তার এবং ছোট্ট গাছটির যত্ন নিয়েছেন। এমনকি রুক্ষ মানুষের হৃদয় কতটা দয়ালু এবং সত্য হতে পারে। সে পিকসিওলাকে একজন প্রিয় বন্ধু হিসেবে লালন করেছিল যাকে সে কখনই ভুলতে পারবে না।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর