ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে নদী। তখনো সূর্য জাগেনি। রমনা পার্কের উল্টোদিকে একটি যাত্রী ছাউনির নিচে থাকে নদী। নদী একা থাকে না। সাথে তার ছোটভাই আর মা। এই ফুটপাতেই বেড়ে উঠছে নদী। নদীর বাবা নেই। মায়ের সাথেই থাকে তারা। আগে তারা থাকত শিল্পকলার ভেতরে। এখন সেখানে থাকা যায় না। শিল্পকলায় পিঠা উৎসব হবে। সেখানে বিশাল মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। মাঠে অনেকগুলো স্টল। মন্ত্রী আসবেন তাই সেখানে বাইরের কাউকে থাকতে দেওয়া হচ্ছে না। বাইরে প্রচ- কুয়াশা। কুয়াশা ভেদ করে সূর্য ওঠে না দুদিন। নদী ফুল আর ফুলের মালা বিক্রি করে শাহবাগে। রমনা থেকে শাহবাগ পর্যন্ত তার সীমানা। এখানে তার মতো দশ-বারোজন ছেলেমেয়ে ফুল বিক্রি করে।
দুদিন ভালো বিক্রি হয়নি। প্রচ- শীতে মানুষ কম বের হয়। যারা অফিসে কাজকর্ম করে তারা দ্রুত বাসায় ফিরে যায়। এই ঠান্ডায় কি আর ঘুম হয়? নদীদের মতো অনেক পরিবারই ফুটপাতে ঘুমায়। নদীর বাবা নাকি গাড়ি দুর্ঘটনায় মারা গেছে। নদীর বয়স তখন তিন বছর আর ভাইটির দুই বছর। বাবার কথা তার একটুও মনে নেই। ঝাপসা চেহারাও ভাসে না চোখে। বাবার কোনো ছবিও নেই। এখন নদীর বয়স আট বছর। মায়ের সাথেই বসবাস তার। দাদিবাড়ি কোথায় সেটাও জানে না সে। মায়ের কাছে শুনেছে দাদারবাড়ি মুন্সিগঞ্জে। একবার নাকি বাবা নিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর সেই বাড়ি নেই। নদীতে ভেঙে গেছে। দাদা-দাদি নেই। চাচারা কে কোথায় কে জানে?
মাঝে মাঝে মন খারাপ হয়ে যায় নদীর। যখন কাউকে দেখে বাবার হাত ধরে স্কুলে যাচ্ছে। কেউ পার্কে বেড়াতে এসেছে। তখন ভাবতে থাকে আমারও তো বাবা ছিল। সবারই বাবা থাকে। কারো বাবা অনেক দিন বাঁচে। কারো বাবা হারিয়ে যায়। কোথায় যায় বাবারা?
নদী ভাবে। এক দিন সে বাবার কাছে যাবে। মা বলেছে বাবা নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে। নদীও আকাশে চলে যাবে। এই কুয়াশা ভেদ করে এক দিন সে পৌঁছে যাবে বাবার কাছে। মাঝরাতে কে বা কারা যেন গায়ের ওপর কম্বল দিয়ে গেছে। ঢাকা শহরে এরকম অনেকে শীতের সময় কম্বল বিতরণ করে। ঠকঠক করে কাঁপছিল নদী। কম্বল পেয়ে বেশ ভালো একটা ঘুম হলো। সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় যখন শীতের সময় বৃষ্টি নামে। বর্ষাকালে তো কষ্ট হয়ই। ভোররাতে নদীর সাথে কে যেন দেখা করতে এলো। সুন্দর ধবধবে শাদা ফ্রক পরা। ডানা আছে তার। তারা দুজন রমনার ভেতর খেলছে।
নাম কী তোমার?
ফুলপরি।
তুমি কি আমাকে চেনো?
হ্যাঁ চিনি তো।
তুমি তো নদী তাই না?
হুম।
কিন্তু তুমি আমাকে কেমনে চেনো?
আমি তোমার আশপাশেই থাকি।
তাই বুঝি?
আমি তো দেখতে পাই না।
আরে বোকা আমি তো দিনের বেলায় দেখা দিতে পারি না।
কী বলো?
সত্যি তাই নদী। আমি রাতের অন্ধকারেই বের হই। শুধু আমি একা বের হই না। আমার সাথে আমার সইও থাকে।
কী নাম তোমার সইয়ের?
লীলাবতী।
তাকে তো দেখছি না।
লীলাবতী আজ ঢাকার বাইরে গেছে তার মায়ের সাথে দেখা করতে।
কোথায় থাকো তোমরা?
আমরা থাকি বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
এটা তো মিরপুরে।
হ্যাঁ ঠিক ধরেছো।
আমাকে নিয়ে যাবে?
চলো যাই। বলেই ফুলপরি তার ডানা মেলে ধরল। নদী সেই ডানায় চড়ে বসল। ফুলপরি উড়তে উড়তে চলল.. কোথায় চলল? সেটা নদীও জানে না। নদী দেখছে বড় বড় বিল্ডিংয়ের ওপর দিয়ে উড়ে চলেছে। হাতিরঝিলের ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে ফুলপরি। মেট্রোরেল স্টেশন পার হয়ে উড়ছে তো উড়ছেই। ভারী মজা পাচ্ছে নদী। নদী আর ফিরে যাবে না। নদী ফুলপরির সাথে তাদের রাজ্যে হারিয়ে যাবে। আর ভালো লাগে না এই ফুল বিক্রি। কতজনের গলাধাক্কা খায় সে। এক দিন তো এক লোক ফুল নিয়ে টাকা দিচ্ছিল না। হঠাৎ করে জ্যাম ছুটে গেলে গাড়ি দিলো টান। একটু হলেই চাকার নিচে পড়ে যেত নদী। ভাগ্যিস তার ছোটভাই তাকে টেনে দূরে সরিয়ে নিয়েছিল। মানুষ কত খারাপ। আবার কত ভালো মানুষ আছে এই শহরে। নদী তো ফুলপরির দেশে থেকে যাবে। কিন্তু তার মা আর ছোটভাইয়ের কী হবে? কী করবে তারা? নদীর ছোটভাই সিয়াম নদীকে খুব ভালোবাসে। কোনো দিন ফুল বিক্রি কম হলে তাদের ভাগ্যে খাবারও জোটে না। কতদিন যে না খেয়ে থেকেছে। নদীর মা ছেলেমেয়ের মুখে খাবার জোটাতে মানুষের কাছে হাত পেতেছে। অনেকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিয়েছে। কেউ বলেছে-জোয়ান মানুষ কাম করে খা।
আবার কেউ দয়া করে দু-চার টাকা হাতে দিয়েছে। নদীর মা দু-টুকরো পাউরুটি কিনে নিয়ে এসে খেতে দিয়েছে। শুকনো পাউরুটি খেতে কার ভালো লাগে? করোনার সময়ে তো অনেক দিন না খেয়ে শিল্পকলায় থেকেছে। এক দিন শিল্পকলার ডিজি লিয়াকত আলী লাকী নদীর মাকে ডেকে নিয়ে ১ হাজার টাকা আর খাবারের একটা প্যাকেট দিলেন। চাল-ডাল-চিনি আর তেলও ছিল সেই প্যাকেটে। এটা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার। এই খাবারের প্যাকেট পেয়ে তাদের কষ্ট দূর হয়।
ফুলপরি আস্তে আস্তে তার ডানা নামিয়ে নিলো। একটা বাগানে গিয়ে তারা নামল। কী সুন্দর সেই বাগান। বাগানে নানারকম ফুল আর ফলের গাছ। মিষ্টি মিষ্টি ফল। ফুলপরি কিছু ফল ছিঁড়ে এনে দিলো নদীর হাতে। নদী খেতে থাকল। প্রচ- খিদে পেয়েছিল তার। বাগানে ফুলের ঘ্রাণ।
তুমি কোথায় নিয়ে এলে বন্ধু?
এটা আমাদের রাজ্য। এখানে শুধু ফুলপরিরাই থাকে।
বাহ কী সুন্দর!
পাশেই একটা লেক। সেই লেকে নেমে নদী সাঁতার কাটছে। রমনা পার্কের যে লেক আছে সেখানে নদী সাঁতার কাটা শিখেছে। নদীর মা সাঁতার কাটা শিখিয়েছে। নদী দেখল লেকের পানি কুসুম কুসুম গরম। এই লেকের পানি শীতকালে গরম থাকে আর গরমকালে ঠান্ডা থাকে। এটা পরির লেক নামে পরিচিত। এই লেকে পরিরা গোসল করে। তারা এই লেকের পানি পান করে। বাগানের ফল আর ফুলই তাদের প্রধান খাদ্য। ছোট্ট একটা পার্ক আছে ভেতরে। সেখানে ছোট্ট ছোট্ট পরি খেলছে। নাচছে। দোলনায় দোল খাচ্ছে। বাচ্চা পরিগুলো উড়ে উড়ে ফুলের ঘ্রাণ নিচ্ছে। ফুলপরি কোথায় যেন উড়ে চলে গিয়েছিল। খানিক পরে সে ফিরে এলো।
বলল, বন্ধু এখানে তো আর থাকা যাবে না। ভোর হয়ে যাবে। আমাদের রাজ্যে মানুষের প্রবেশ নিষেধ। আমি তোমাকে এনে অপরাধ করেছি। এই অপরাধে আমাকে পরিরাজ্য থেকে বেরও করে দিতে পারে। চলো বন্ধু তোমাকে তোমার মায়ের কাছে দিয়ে আসি।
চলো বন্ধু। আমার জন্য তোমাকে তোমার রাজ্য হারাতে হবে না।
হ্যাঁ বন্ধু। আবার তোমাকে আরেক দিন আমাদের রাজ্য ঘুরিয়ে দেখাবো।
ঠিক আছে বন্ধু তাই হবে।
বন্ধু এবার তুমি চোখ বন্ধু করো।
নদী চোখ বন্ধ করল। চোখে কীসের যেন স্পর্শ পেলো। আর সে ঘুমিয়ে গেল। ঘুম ভেঙে দেখে সে বিছানায় আছে। নদী ভাবছে সে কি স্বপ্ন দেখেছে? নাকি আসলেই পরি এসে তাকে নিয়ে গিয়েছিল? ভাবতে ভাবতেই সকাল হয়ে গেল।