২৭ মার্চ, ২০২৪ ১৫:০৮

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ৩০০ কোটি টাকা বিক্রির আশা

মো. নাসির উদ্দিন, টাঙ্গাইল

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি ৩০০ কোটি টাকা বিক্রির আশা

ঈদ, পয়লা বৈশাখসহ যেকোনো অনুষ্ঠানে অনেক নারী পছন্দ করে থাকেন টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। ঈদে তাঁতের শাড়ির বেচাকেনা এখনো তেমন জমে ওঠেনি। রোজার শেষ ১০ দিনের মধ্যেই শাড়ি বেচাকেনা জমে উঠবে। ঈদ ও পয়লা বৈশাখ একসঙ্গে ও কাছাকাছি হওয়ায় তাঁতের শাড়ি ভালো বিক্রি হবে। এবার দুই উৎসবকে ঘিরে অনন্ত ৩০০ কোটি টাকার তাঁতের শাড়ি বিক্রির আশা করছে তাঁত মালিকরা ও ব্যবসায়ীরা।

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক, মালিক ও ব্যবসায়ীদের সবাই আশা করছেন, রোজার শেষ ১০ দিন ঈদের ভালো বেচাকেনা হবে ও পয়লা বৈশাখের উৎসব সামনে রেখে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক মন্দা কাটিয়ে উঠতে পারবেন তারা। এ দুই উৎসবে এবার প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার শাড়ি ও তাঁতের নানা পোশাক বিক্রির আশা করছে টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স। দেশের পাশাপাশি অন্য দেশেও রপ্তানি হচ্ছে টাঙ্গাইলের শাড়ি। গত বছর ঈদ ও পূজা উপলক্ষে ভারতে রপ্তানি হয়েছিল টাঙ্গাইলের ৭৪ লাখ পিস শাড়ি। এবার রপ্তানি হয়েছে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি।

আর এ কারণেই ব্যস্ততা বেড়েছে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীতে। আলো-আঁধারময় ছোট-বড় তাঁত শাড়ির কারখানায় দিনরাত বুননের কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন নানা ধাপের কারিগররা। ভোর থেকে গভীর রাত অবধি চলছে মাকু আর শানার শব্দ। তাঁতির হাত ও পায়ের ছন্দে তৈরি হচ্ছে এক একটি বর্ণিল শাড়ি। গরমের কথা বিবেচনায় রেখে এবার শাড়িতে এসেছে বৈচিত্র্য আর নতুনত্ব। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তাঁত পল্লীতে আসা-যাওয়া করছেন ক্রেতা-ব্যবসায়ীরা।

সরেজমিন দেখা যায়, এখানে তাঁত পল্লীগুলোতে ৬০০ থেকে ২৫ হাজার টাকা দামের সুতি শাড়ি বিক্রি হচ্ছে। জামদানি, হাফ সিল্ক, মসলিন, অ্যান্ডি সিল্ক ও সফট সিল্ক বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার টাকা থেকে শুরু করে এক লাখ টাকা পর্যন্ত।

তাঁত শ্রমিক গোর সেন জানালেন, একটা শাড়ি তৈরিতে দুই দিন সময় লাগে। আমরা বর্তমানে পৌনে ৭০০ টাকা মজুরি পাচ্ছি। এ দিয়ে আর সংসার চলে না। এ পেশা যে ছেড়ে দেব, তাও তো সম্ভব না। অন্য কোনো কাজ পারি না। পেটের তাগিদে এ পেশা ধরে রেখেছি। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না। এভাবেই চলছে।

রঞ্জন বসাক বললেন, ‘আমি এ পেশায় কাজ করি ৩৫ বছর ধরে। আমাদের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয়। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। মজুরি দেয় মাত্র এক হাজার টাকা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। বেশিরভাগই এ পেশা থেকে চলে গেছেন। আমি অন্য কোনো কাজ আর শিখি নাই। এজন্য আমি যেতে পারি নাই। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারব।’

তাঁত পল্লীতে কথা হলো রাহেলা বেগমের সঙ্গে। ঢাকা থেকে তিনি শাড়ি কিনতে এসেছেন টাঙ্গাইলে। তিনি বললেন, ‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কোয়ালিটি ভালো। গতবারের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বেশি। তারপরও টাঙ্গাইলের শাড়ি অনেক ভালো মানের। সেজন্য নিয়ে যাচ্ছি।’

আরেক ক্রেতা সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘ঈদ ও পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে দুটি তাঁতের শাড়ি নিয়ে গেলাম। পরিবারের জন্যও তিনটি নিয়েছি। শাড়ির মান ও ডিজাইন অনেক ভালো। এজন্য প্রতি বছর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনতে আসি। আগের থেকে এবার দাম বেশি রাখছে। দাম একটু কম হলে ভালো হতো।’

পাথরাইল এলাকার তাঁতশিল্পের মালিক গোবিন্দ সূত্রধর বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। পাওয়ার লুমের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে ৫০০ থেকে ৭০০ টাকায়। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি করতেই মজুরি দিতে হয় ৫০০ থেকে ৭০০ টাকা। এজন্য আমাদের শাড়ি কম চলে। তারপরও আশা করছি এবার ঈদ ও পয়লা বৈশাখ পাশাপাশি হওয়ায় এবার আমাদের বিক্রি ভালো হবে। গতবারের থেকে এবার বেশি বিক্রি হবে।’

টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক বলেন, ‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এবার নতুনত্ব এসছে। বর্তমান বাজারদর অনুযায়ী এবার প্রায় ৩০০ থেকে ৪০০ কোটি টাকার টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে বলে আশা করছি। এবার মোটামুটি সবাই ঘুরে দাঁড়াতে পারব।’ 

জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক বলেন, ‘এ বছর ঈদে ও পয়লা বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা যা উৎপাদন করেছি, বাজারে তা ছেড়ে দিয়েছি। পাইকারি বিক্রিও মোটামুটি শেষ হয়ে গেছে। আমরা আশাবাদী, গত বছরের চেয়ে এবার বিক্রি ভালো হবে। রাজনৈতিক অস্থিরতা নেই। এদিকে মানুষের মধ্যে ক্রয় ক্ষমতাও বেড়েছে। সে কারণে আশাবাদী আমরা।’

তিনি বলেন, ‘এ বছর আমাদের রপ্তানিও বেশি হয়েছে। এবার বাংলাদেশ থেকে ঈদ ও পূজা উপলক্ষে ভারতে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। গত বছর যা ছিল ৭৪ লাখ পিস। এ রপ্তানি আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ শুধু আমাদের দেশের বাজার দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। এ শিল্পকে এগিয়ে নিতে সরকারের সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার।’

বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, তাঁতিদের আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ দিয়ে থাকি। প্রণোদনামূলক ঋণ হিসেবে ৫ শতাংশ ঋণ সার্ভিস চার্জে আমরা তাঁতিদের সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ দিতে পারি।

বিডি প্রতিদিন/এমআই

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর