২০২৫-২৬ অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেট এমন একসময় এসেছে, যখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে এবং দেশীয় অর্থনীতি বহুমাত্রিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। যার মধ্যে রয়েছে মূল্যস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, বৈশ্বিক বাণিজ্য স্থবিরতা এবং অভ্যন্তরীণ বিনিয়োগে ভাটা।
এই প্রেক্ষাপটে বাজেট ঘোষণার সময় সরকার মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা এবং রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিয়েছে। ঢাকা চেম্বার বাজেটের এই উদ্দেশ্যকে সাধুবাদ জানায়।
তবে একটি টেকসই, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও উৎপাদননির্ভর অর্থনীতি গড়তে হলে বেসরকারি খাত ও দেশীয় শিল্পের প্রতি আরো সুস্পষ্ট অঙ্গীকার প্রয়োজন ছিল, যা আমরা এই বাজেটে পর্যাপ্তভাবে প্রতিফলিত হতে দেখিনি।
আমরা লক্ষ করেছি, সরকার রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ধরেছে পাঁচ লাখ ৬৪ হাজার কোটি টাকা, যার বেশির ভাগই কর রাজস্ব থেকে সংগ্রহের পরিকল্পনা রয়েছে। করজাল সম্প্রসারণ এবং অনলাইনে কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করার পদক্ষেপ ব্যবসাবান্ধব অর্থনীতির পথে একটি ইতিবাচক সূচনা হলেও, তা যেন হয় বাস্তবভিত্তিক এবং করদাতাবান্ধব।
এ ছাড়া টার্নওভার করের হার ০.৬% থেকে ১% করার প্রস্তাব আমরা পুনর্বিবেচনার দাবি জানাই।
কারণ এটি ছোট ও মাঝারি ব্যবসার জন্য করের বোঝা বাড়াবে এবং স্বল্প মূলধনী উদ্যোক্তাদের অসুবিধায় ফেলবে।
দেশীয় শিল্প ও উৎপাদনের বিষয়ে আমরা দেখতে পাই, ইলেকট্রনিকস, মোবাইল ফোন ও প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধির প্রস্তাব এসেছে। পাশাপাশি দেশীয় টেক্সটাইল মিলে উৎপাদিত কটন সুতা ও ম্যান-মেইড ফাইবারের ওপর সুনির্দিষ্ট কর তিন টাকা থেকে বাড়িয়ে পাঁচ টাকা করা হয়েছে। এ ধরনের কর বৃদ্ধি স্থানীয় উৎপাদকদের জন্য প্রতিযোগিতা কঠিন করে তুলবে এবং দীর্ঘমেয়াদে আমদানি নির্ভরতা বাড়াবে, যা ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ভিত্তিক শিল্পায়নের লক্ষ্যের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
দেশীয় শিল্পের সক্ষমতা বাড়াতে হলে তাদের উৎপাদন খরচ হ্রাসে প্রণোদনা দিতে হবে, বাজারে প্রবেশ সহজ করতে হবে এবং গবেষণা ও উদ্ভাবনে উৎসাহ দিতে হবে।
বাজেট বক্তৃতায় সিএমএসএমই খাত নিয়ে সরাসরি কোনো কাঠামোগত রূপরেখা বা প্রণোদনার উল্লেখ আমরা পাইনি, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। দেশের কর্মসংস্থানের প্রায় ৮৭ শতাংশ এই খাত থেকে আসে। অথচ আইএমএফের নির্দেশনা অনুযায়ী যেসব কর অব্যাহতি প্রত্যাহার করা হয়েছে, তার বিরূপ প্রভাব প্রথমে গিয়ে পড়বে এই খাতের ওপরই। উৎপাদনশীলতা বাড়াতে, ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জন করতে এবং অর্থায়ন সহজ করতে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের জন্য স্বল্পসুদে ঋণ, কর অব্যাহতি এবং প্রশিক্ষণভিত্তিক উন্নয়ন কার্যক্রম দরকার, যার জন্য বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ থাকা উচিত ছিল।
এডিপি বাস্তবায়নের হার এ বছর করোনা-পরবর্তী সময়ে সর্বনিম্ন পর্যায়ে এসে দাঁড়িয়েছে—৪১.৩১%। আমরা লক্ষ করি, যখন রাজস্ব সংকট দেখা দেয়, তখন বার্ষিক উন্নয়ন খাতের ব্যয় হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়, যা অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। আমরা চাই, পরিচালন ব্যয় কমিয়ে উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ ও বাস্তবায়ন জোরদার করা হোক। একইভাবে শিক্ষা খাতের বরাদ্দ কমিয়ে ২৮ হাজার ৫৫৭ কোটি টাকা করা হয়েছে, যা জিডিপির মাত্র ১.৭৫ শতাংশ। একটি দক্ষ ও উৎপাদনমুখী মানবসম্পদ গঠনে শিক্ষা খাতে গবেষণা ও কারিগরি শিক্ষায় বরাদ্দ বাড়ানো জরুরি ছিল।
জ্বালানি খাতে গ্যাসের উৎস কর কমানো এবং এলএনজি আমদানিতে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, যা খরচ কমাতে সহায়ক হলেও এটি স্থায়ী সমাধান নয়। আমাদের চাওয়া, দেশীয় জ্বালানি অনুসন্ধান ও উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো, যাতে করে শিল্প খাতে স্থিতিশীল গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হয়। দীর্ঘমেয়াদি উৎপাদন সক্ষমতা গড়তে হলে গ্যাস, বিদ্যুৎ এবং লজিস্টিক খাতে সমন্বিত ও টেকসই অবকাঠামো বিনির্মাণ অপরিহার্য।
এই বাজেটে কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে অনলাইন কর রিটার্ন বাধ্যতামূলক করা, অনুমোদনযোগ্য বিয়োজনের আওতা বৃদ্ধি, এলএনজি আমদানিতে কর ছাড় এবং আমদানি শুল্ক যৌক্তিকীকরণ। আমরা সরকারের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানাই এবং তার কার্যকর বাস্তবায়ন কামনা করি। তবে আমরা আশা করি, বাজেট বাস্তবায়নের পরবর্তী পর্যায়ে বিনিয়োগবান্ধব নীতিমালা, সিএমএসএমই খাতের জন্য পৃথক সহায়তা প্যাকেজ এবং Doing Business সূচকে অগ্রগতি আনতে প্রশাসনিক সংস্কার অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
বেসরকারি খাত হলো জাতীয় প্রবৃদ্ধির ইঞ্জিন, আর সরকার হলো নীতিনির্ধারণকারী। এই দুইয়ের মাঝে কার্যকর সহযোগিতা ছাড়া টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। সুতরাং বাজেট বাস্তবায়নে অংশীদারি, স্বচ্ছতা এবং ব্যবসাবান্ধব চিন্তা-ভাবনা অব্যাহত রাখতে হবে। তাহলেই বাজেটে একটি ইতিবাচক পরিবর্তনের সূচনা ঘটবে।
লেখক : সভাপতি, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)