বুধবার, ৯ নভেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

প্লাস্টিক শিল্প : অর্থনীতির বিকাশমান খাত

মুহাম্মদ ফারুক খান এমপি

প্লাস্টিক শিল্প : অর্থনীতির বিকাশমান খাত

নব্বই দশক থেকে পোশাক শিল্পের পাশাপাশি প্লাস্টিক শিল্পেও নীরব বিপ্লব ঘটেছে বাংলাদেশে। তৈরি পোশাক শিল্পের সাফল্য তো রূপকথার কাহিনীকেও হার মানায়। নিঃস্বজনের রাজা হয়ে ওঠার উপমাই এক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায়। নব্বই দশকের আগে বংলাদেশের মানুষ পশ্চিমা বিশ্বের পুরনো পোশাকের ওপর অনেকাংশে নির্ভরশীল ছিল। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, বুড়িগঙ্গা পাড়ের সেই দেশই এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ। এ দেশে প্লাস্টিক শিল্পের যাত্রা শুরু সেই পঞ্চাশ দশকের শুরুতে। হাঁটি হাঁটি পা পা করে এ শিল্প এতটাই এগিয়েছে যে, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের ১২তম প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। উদ্যোক্তারা বলছেন, পোশাক শিল্পের মতো আনুকূল্য পেলে প্লাস্টিক পণ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রপ্তানি খাতে পরিণত হবে। পঞ্চাশ দশকের শুরুতে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামে গড়ে ওঠে প্লাস্টিক শিল্প। নব্বই দশক পর্যন্ত এ দেশে নিম্নমানের প্লাস্টিক পণ্যই উৎপাদিত হতো। বিদেশি প্লাস্টিক পণ্যের জন্য দেশীয় বাজার ছিল অবারিত। এখন মানে ও বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের প্লাস্টিক শিল্প এতটাই এগিয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশে এ দেশে তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। চীন, ভারতেও তা সমাদৃত হচ্ছে। এ শিল্পের উদ্যোক্তারা ২০২১ সাল নাগাদ রপ্তানি বাবদ ১০ হাজার কোটি টাকা আয়ের আশা করছেন। এ মুহূর্তে দেশে ২০ হাজার কোটি টাকার প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদন ও বিপণন হচ্ছে। এ শিল্পের সঙ্গে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে ১২ লাখ মানুষ জড়িত। সরকার শিল্পোদ্যোক্তাদের দাবির মুখে ধলেশ্বরী পাড়ে প্লাস্টিক শিল্পনগরী স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছে। যেখানে ৩৪৮টি প্লাস্টিক শিল্প স্থাপন করা সম্ভব হবে।

প্লাস্টিক সামগ্রী দিয়ে এখন দেশে কাঠের বিকল্প ফার্নিচার, টেবিল-চেয়ার থেকে শুরু করে গৃহসামগ্রী উৎপাদিত হচ্ছে। দিন দিন এর ব্যাপক ব্যবহার ও জনপ্রিয়তা বাড়ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে রপ্তানি আয়ের দিক দিয়ে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি খাতের স্থান হচ্ছে ১২তম। আশা করা হচ্ছে, ২০২০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক পণ্য অন্যতম শীর্ষ রপ্তানি খাতে পরিণত হবে। সে সময় এ খাতে রপ্তানি দাঁড়াবে ৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। প্লাস্টিক পণ্য দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে- মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত বিভিন্ন দেশসহ সমগ্র ইউরোপে এবং এশিয়ার চীন, ভারত, নেপালসহ অন্যান্য দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশ থেকে প্লাস্টিকের তৈরি পণ্য রপ্তানির পরিমাণ বছরে প্রায় তিন হাজার ৭০০ কোটি টাকা। দেশে ছোট, বড়, মাঝারি মিলিয়ে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৫ হাজারের বেশি। এসব কারখানা বা প্রতিষ্ঠানে প্রায় ৫ লাখ লোক তাদের জীবন-জীবিকা নির্বাহ করে থাকে। প্রায় সাড়ে ৪০০ প্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী রপ্তানি করে। এসব প্লাস্টিক কারখানার বেশির ভাগই গড়ে উঠেছে রাজধানী শহর ঢাকায়। কিছু রয়েছে চট্টগ্রাম ও নারায়ণগঞ্জে। প্রায় ৫ লাখ লোক এ কাজের সঙ্গে সরাসরি জড়িত থাকলেও, এ শিল্পের ওপর নির্ভরশীল এখন ২৫-৩০ লাখ লোক। পুরান ঢাকার অসংখ্য ঘরেই গড়ে উঠেছে প্লাস্টিক কারখানা। এসব কারখানায় যারা কাজ করেন, তাদের অনেকেই এক সময় নিজেরাই কারখানার মালিক হয়ে যান। অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে স্বল্প পুঁজি নিয়েই এক সময় তারা কারখানা খুলে বসেন। এভাবে এরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়েও যান! প্লাস্টিক সামগ্রী উৎপাদনকারীদের কাছ থেকে সরকারি কোষাগারে প্রতি বছর জমা হচ্ছে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা।

বিভিন্ন ধরনের প্লাস্টিক পণ্যের চাহিদা মিটিয়ে তবেই বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে আমাদের প্লাস্টিক পণ্য। তবে কিছু অপূর্ণতার জন্য এখনো সম্পূর্ণতা পায়নি প্লাস্টিক খেলনা সামগ্রীর ব্যাপারটি। এক সময় আমাদের দেশের প্লাস্টিক খেলনার প্রায় সবই আসত চীন থেকে। এখন ৬০ শতাংশ প্লাস্টিকের খেলনা তৈরি হচ্ছে দেশেই। আর একটু সহযোগিতা পেলে ৬০ শতাংশকে শত ভাগে পৌঁছে দেবে নিশ্চয়ই। প্রযুক্তিগত দিক থেকে যদি এ সহযোগিতার হাতটি সম্প্রসারিত হয়, তো আমরা শুধু চীন নয়, অনেক উন্নত দেশকেও পেছনে ফেলে এগিয়ে যেতে পারব। উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের মোট ২৩টি দেশে প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট এক্সেসরিজ হিসেবে প্রধানত আমেরিকা, কানাডা ও রাশিয়ায় রপ্তানি হচ্ছে বেশি। উৎপাদনমুখী এসব কারখানা থেকে হ্যাঙ্গার, বোতাম, পলিব্যাগ, ফিল্ম ব্যাগ, ক্লিপ ইত্যাদি গার্মেন্ট এক্সেসরিজ উৎপাদন করে। তৈরি পোশাক সংশ্লিষ্ট আইটেম হিসেবে বছরে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার ওপর প্লাস্টিক পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। এ ছাড়াও আরও প্রায় ১৫০ কোটি টাকার ওপর প্লাস্টিকের খেলনা, ফার্নিচার, ক্রোকারিজ সামগ্রী সরাসরি রপ্তানি হচ্ছে। আমাদের দেশে প্রধানত ভারত, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, জাপান, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব ইত্যাদি দেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করা হয়ে থাকে। প্লাস্টিক সামগ্রী তৈরির কাঁচামাল তৈরি হয়ে থাকে পেট্রোলের বর্জ্য থেকে। অভিজ্ঞ মহলের মতে, সরকার বিশেষ উদ্যোগ নিলে চট্টগ্রাম বন্দরে পেট্রোকেমিক্যাল কমপ্লেক্স নির্মাণ করা যেতে পারে। আমরা নিজেরা যদি কাঁচামাল উৎপাদন করতে পারি, তবে একদিকে আমদানি ব্যয় হ্রাস পাবে, পাশাপাশি উৎপাদন ব্যয় কমবে। পরনির্ভরতা কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থানেরও সুযোগ সৃষ্টি হবে। দেশের অর্থনীতির এ সম্ভাবনাময় খাতকে এগিয়ে নিতে সরকারি পর্যায়েও নানামুখী উদ্যোগ নিতে হবে। প্লাস্টিক পণ্যে বৈচিত্র্য এনে দেশি-বিদেশি ভোক্তাদের মন কীভাবে জয় করা যায় তা নিয়ে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণাও প্রয়োজন। এ শিল্পের উন্নয়নে ব্যাপকভিত্তিক পরিকল্পনা নেওয়া হলে দেশ যেমন বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হবে তেমনি কর্মসংস্থানেও রাখতে পারবে কার্যকর অবদান।

লেখক : প্রেসিডিয়াম সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, সাবেক মন্ত্রী বাণিজ্য, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়

সর্বশেষ খবর