সোমবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০১৬ ০০:০০ টা

ফিদেল কাস্ত্রোর ভবিষ্যৎ

আবু তাহের

ফিদেল কাস্ত্রোর ভবিষ্যৎ

এরকম খুব কমই ঘটে যে, কোনো নেতার ভবিষ্যৎ নিয়ে জল্পনা চলছে তার জীবদ্দশায় এবং মৃত্যুর পরও। ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৫৯ সালে তার গেরিলা বাহিনী নিয়ে যখন কিউবার রাজধানী হাভানায় ঢুকলেন, সরকার গঠন করলেন তখন জল্পনা শুরু হয়, ‘কদিন টিকবে এরা! নাহ্, ফিদেলের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

অন্ধকারটা কেউ দেখেছিল তীব্র দুশ্চিন্তায়। কেউ দেখেছিল চাপা উল্লাসে। ক্যারিবিয়ান সাগরের বুকে উল্টানো হাঙর-সদৃশ ছোট দ্বীপরাষ্ট্র কিউবার মাত্র ৯৩ মাইল উত্তরে মহাশক্তিধর যুক্তরাষ্ট্র, যার পরম মিত্র জেনারেল ফুলজেনসিয়ো বাতিস্তার স্বৈরাচারী সরকারকে উচ্ছেদ করে ক্ষমতায় আসেন ফিদেল। রেগে কুঁদে যুক্তরাষ্ট্র তো বৃদ্ধাঙ্গুলি আর তর্জনীর ডগায় পিঁপড়ে পিষে মারার মতোই দশা করতে পারে কিউবার। ফিদেলের জন্য অন্ধকার অপেক্ষা করছে এমন চিন্তা বাতিস্তা-বান্ধবদের আমোদিত করাটাই স্বাভাবিক। এই চিন্তাই আবার উদ্বেগাকুল করে ফিদেলের বিপ্লবী অভিযানের অনুরাগীদের। এখন, কিউবান বিপ্লবের ৫৭ বছর পর, ফিদেলের দেহভস্ম তার মানসগুরু ঊনবিংশ শতকের মহান বিপ্লবী হোসে মার্তির কবরের পাশে সমাহিত হয়ে যাওয়ার পরও বিশ্বের পণ্ডিতরা ভাবছেন : ফিদেলের ভবিষ্যৎ কী? তিনি কি অভাবনীয় দ্রুততায় বিস্মৃত হয়ে যাবেন?

নানা কারণেই প্রশ্ন উদ্রেককারী আর বিস্ময় জাগানিয়া বিপ্লবী হয়ে উঠেছিলেন ফিদেল। তিনি এমন দক্ষতায় সমমনা সাম্যবাদী তরুণদের সংগঠিত করেছিলেন কিউবার শাসকগোষ্ঠী এর প্রতিকারে কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ তো দূর কথা, বিপ্লব আসছে এমন সম্ভাবনা নিয়ে বাতিস্তা বা তার মুরব্বি যুক্তরাষ্ট্র কেউই আঁচ করতে পারেনি। ল্যাটিন আমেরিকার সমাজতন্ত্রীরা এ জন্য ফিদেলকে ‘ভাগ্যবান’ বলেন। কেননা, যুক্তরাষ্ট্র টের পেলে ‘২৬ জুলাই আন্দোলন’-এর জনক ফিদেলের অগ্রযাত্রাকে পদে পদে বাধাগ্রস্ত করতে পারত। রক্তক্ষয় হতো বেশি। বিজয় হতো বিলম্বিত।

অস্ত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে সান্তিয়াগো শহরের মনকাড়া সেনা ছাউনিতে ফিদেল ও তার সঙ্গীরা ১৯৫৩ সালের ২৬ জুলাই আক্রমণ চালান। অভিযান ব্যর্থ হয়। বিপ্লবীরা অনেকেই প্রাণ হারান। ফিদেল গা-ঢাকা দেন, কিন্তু অচিরেই ধরা পড়েন। সামরিক আদালতের বিচারে তাকে ১৫ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। এই বিচারের সময় আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি সামরিক ট্রাইব্যুনালে যেসব কথা বলেছিলেন তাতে তার জনপ্রিয়তা বহুগুণ বেড়ে যায়। ফিদেল ছিলেন তুখোড় বক্তা, তার বাগ্মিতা মুগ্ধকর, তার রসবোধও ছিল প্রখর, বিভিন্ন বিষয়ে পড়াশোনাও বিস্তর। মনকাড়া ট্রাইব্যুনালে তিনি যে দীর্ঘ ভাষণ দেন তাতে ফিদেল কাস্ত্রো বেশ কয়েকবার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা ও প্রবন্ধ উদ্ধৃত করেছিলেন। ভাষণের শুরুতেই রবিঠাকুরকে উদ্ধৃত করে ফিদেল বলেন, ‘দুর্বলের ভয় ব্যথা পাবে, সবলের ভয় বাধা পাবে।’ বলেছিলেন ‘সাজা দেবে? দাও। পরোয়া করি না। ইতিহাস আমায় মুক্ত করবে।’ পরবর্তীকালে ওই ভাষণটি চটি বই আকারে প্রকাশিত হয় এবং বিশ্বময় প্রগতিপন্থি তরুণদের অন্তর জয় করে। বইটির শিরোনাম ‘ইতিহাস আমায় মুক্ত করবে।’ মনকাড়া অভিযানের ব্যর্থতা চোখ খুলে দেয় ফিদেলের। তিনি উপলব্ধি করেন, রোমান্টিক বিপ্লবে সময় নষ্ট হয়েছে। বিপ্লবী চেতনার কাজ ‘সন্ত্রাস’ হিসেবে বদনাম কুড়াবে, এ খুবই দুঃখজনক।

 

 

প্রবল জনদাবির মুখে ১৯৫৪ সালে ফিদেলকে মুক্তি দিলেন জেনারেল বাতিস্তা। ছাড়া পেয়ে চলে গেলেন মেক্সিকোয়। ওই দেশের রাজধানীতে তিনি ভবিষ্যতে করণীয় নিয়ে কিউবান বিপ্লবীদের সঙ্গে মতবিনিময় করতে থাকেন। এই সময়েই এক পর্যায়ে আর্জেন্টিনার বিপ্লবী আর্নেস্টো চে গুয়েভারার সঙ্গে ফিদেলের দেখা হয়। মেক্সিকান সোশ্যালিস্ট নেত্রী মারিয়া আন্তোনিয়া তার বাড়িতে ফিদেলকে আশ্রয় দিয়েছিলেন। রাতে খাবারের টেবিলে মারিয়া বলেন, ‘তোমায় যে বলেছিলাম কিউবার লইয়ার (আইনজীবী) ফিদেলের কথা। এই সেই ফিদেল। আর এ হচ্ছে ডাক্তার চে গুয়েভারা।’

দুই বিপ্লবী পরস্পরের দিকে মুগ্ধ চোখে সহাস্য তাকিয়ে রইলেন। চে বলেন, ‘তুমি তো বিপ্লবের মোহন সুরকার।’ ফিদেল বলেন, ‘তুমি তো বিপ্লবের অনুপম গীতিকার।’ মারিয়া আন্তোনিয়া তখন দুজনের দুহাত একত্রিত করে বলেন, ‘চমৎকার। এখন তোমরা দুজনে মিলে বিপ্লবের স্বরলিপি বানাও।’ ওই স্বরলিপি থেকে উৎসারিত সুরধ্বনিতে কিউবা হয়েছিল প্রকম্পিত। যুক্তরাষ্ট্র স্তম্ভিত, ক্রুব্ধ। পৃথিবী বিস্মিত, চমকিত। যুক্তরাষ্ট্র ফিদেলকে যতবার ‘দানব’ প্রমাণের চেষ্টা করেছে ততবারই পৃথিবীর দেশে দেশে মোহনীয় প্রভায় যুবমনের গহিনে জায়গা করে নিয়েছেন ফিদেল। শুধু কি যুবমন? না, পোক্ত-সমৃদ্ধ অনেক প্রবীণ মনও। ফিদেলের প্রভাব কতভাবেই না ফুটে উঠেছে। বহু রাজনীতিক, ক্রীড়াবিদ আর লেখকের তিনি ‘ফাদার ফিগার’ বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকা ও আফ্রিকায়। নিজ দেশে বিপ্লবের সুফল ততটা দীপ্যমান না করা সত্ত্বেও নিষ্ঠাবান বিক্রেতার মতোই দুনিয়ার নানা প্রান্তে বিপ্লব গছিয়ে দিতে পেরেছিলেন তিনি। চে গুয়েভারা একবার বলেছিলেন, ‘ফিদেল ইজ দ্য ম্যান হু হ্যাড মেড রেভ্যুলেশনস সেক্সি।’

বলা হয়, ইয়াসির আরাফাত, নেলসন ম্যান্ডেলার মতোই ফিদেল কাস্ত্রোর জনপ্রিয়তার নেপথ্যে অদ্ভুত এক রসায়ন কাজ করে যা তাকে পরিণত করেছে মোহন বিপ্লবীতে। ৫০ বছর ধরে দেখা গেছে, কিউবার সংবাদ মানে ফিদেলের সংবাদ। ফিদেলের সংবাদ মানে কিউবার সংবাদ। তার সীমাবদ্ধতা নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেনি। তার কর্তব্য কাজ ঠিক না বেঠিক কেউ মাথা ঘামায়নি। এমনকি এত নেতা থাকতে ২০০৬ সালে ছোট ভাই রাউল কাস্ত্রোর মতো আরেক বুড়োর হাতে ক্ষমতা যে অর্পণ করলেন তা কোন যুক্তিতে, তাও কেউ জানতে চাইল না।

তবে একটা প্রশ্ন সর্বদাই উঠেছে। যুক্তরাষ্ট্র কেন ফিদেলকে ৬৩৮ বার হত্যা করার চেষ্টা করেছে? দুশমনীর শুরু ১৯৬০ সালেই। সে বছর কিউবায় মার্কিনিদের মালিকানাধীন যেসব চিনিকল ছিল, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল সবই রাষ্ট্রায়ত্ত করেছিলেন ফিদেল এবং কোনোরকম ক্ষতিপূরণ না দিয়েই। ‘ওগুলো ফেরত দাও, নইলে টাকা দাও’— বলাটা শোভা পাবে না বলে তদানীন্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডি বলতেন, ‘কিউবায় কমিউনিস্টরা মানুষের স্বাধীনতা হরণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র চায় ওদের স্বাধীনতা ফিরে আসুক।’

ফিদেল তার কিউবায় স্বাস্থ্যসেবা আর শিক্ষাব্যবস্থা বেশ উন্নত করেছেন। সরকারি স্টোর থেকে ২৬ ডলারে ৫ সদস্যের একটি পরিবারের এক সপ্তাহের চাল-ডাল-তেল-রুটি-মাখন কেনা সম্ভব। সামান্য খরচে উচ্চতর ডাক্তারি ডিগ্রি অর্জন করা যায়। এ জন্য অনেক মার্কিন যুবক কিউবায় ভর্তি হতে চাইলে মার্কিন সরকার বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছিল, ‘নিষেধাজ্ঞা আছে। ওই দেশে শিক্ষা গ্রহণ করাটা আইনত দণ্ডনীয়।’ মার্কিন পত্রপত্রিকার খবর : বিপ্লবের পর কিউবা ১০৩টি দেশে ১ লাখ ৮৫ হাজারের বেশি চিকিৎসাকর্মী পাঠিয়েছে।

এতসব সাফল্য সত্ত্বেও ফিদেল কাস্ত্রোর স্বস্তি ছিল না। কলম্বিয়ার লেখক নোবেল বিজয়ী গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ লিখেছেন, ফিদেল কাস্ত্রো মুখে কখনো ব্যর্থতা স্বীকার করেন না। তবে অবচেতনে খুব সূক্ষ্মভাবে এক ধরনের পরাজয় মানেন। ফিদেল একবার বলেছিলেন, ‘কিউবায় সুশাসন না আসা পর্যন্ত আমি আমার দাড়ি কামাব না।’

আগামী দিনগুলোয় ফিদেল কি বিস্মৃতির অতলে লীন হয়ে যাবেন? তার পরম্পরা কতকাল ধারণ করবে আধুনিক কিউবা? আমাদের ধারণা এই নিয়ে বিতর্ক চলবে আরও অনেক বছর। কিন্তু বিশ্বময় নিপীড়িত বঞ্চিত শোষিত মানুষ যখনই বুকে সাহস সঞ্চয় করতে চাইবে, তখনই ফিদেল কাস্ত্রোকে স্মরণ করবে। কারণ তিনি ছিলেন এমন এক জমানার নায়ক যেকালে অনাচার-লুণ্ঠন-শোষণের বিরুদ্ধে লড়াই করাটা ছিল বিরাট সম্মানের ব্যাপার।

লেখক : সাংবাদিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর