শুক্রবার, ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিচার ব্যবস্থায় বিচার-অবিচারের সংকট

মইনুল হোসেন

বিচার ব্যবস্থায় বিচার-অবিচারের সংকট

আইনের অনেক ফাঁকফোকর থাকার কারণে বিচারকরা যে বিচার করতে গিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বের সম্মুখীন হয়ে থাকেন সে বিষয়ে অতি সম্প্রতি আবারও বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। সিলেটের মৌলভীবাজারের আইনজীবীদের বাৎসরিক নৈশভোজে অংশ নিতে গিয়ে তিনি এ উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

আইন প্রণয়ন ও সংশোধন করার সময়  যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও যত্ন নেওয়ার ব্যাপারে তাই অনেক দিন থেকেই বিচারকের আসনে বসে তিনি তাগিদ দিয়ে আসছেন। এরকম আইন পাস করার আগে আইনগুলোর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় যে শ্রম দেওয়া দরকার ছিল আইন প্রণেতারা সে শ্রম দিচ্ছেন না।

সাধারণভাবেই শোনা যায়, আইনের গলদ থাকায় বিশেষ করে ফৌজদারি বিচারের ক্ষেত্রে অনেক অপরাধীকে সাজা ভোগ করতে হয় না। অনেক অপরাধীর অপরাধ প্রমাণ হয় না। তাই ছাড়া পায়। সুতরাং প্রধান বিচারপতি যে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন তার সঙ্গে সবাই ঐকমত্য পোষণ করেন।

বিচার ব্যবস্থার অন্য যে বিষয়টির সুযোগ নিয়ে নির্দোষ-নিরপরাধ অনেক ব্যক্তিকে দোষী প্রমাণিত না করেই শাস্তি দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বিচার ব্যবস্থার এত বড় অন্যায় দিকটি কিন্তু ভীষণভাবে উপেক্ষিত হচ্ছে। দোষী হয়েও শাস্তি পাচ্ছে না এমন লোকের চেয়ে বহুগুণ বেশি নির্দোষ-নিরপরাধ লোক জেল খাটছে।

ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় নিরপরাধীকে জামিন দিতে অস্বীকার করে তাকে জেলে সাজা ভোগ করতে বাধ্য করা হচ্ছে। নির্দোষ ব্যক্তিকে রক্ষা করার ব্যাপারটি সুবিচারের বিবেচনায় অধিকতর গুরুত্ব পাওয়ার কথা। আর এ উপলব্ধি হতে সুবিচারের নীতি হিসেবে বলা হয় যে, বিচারে দোষী প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে নির্দোষ বলে মেনে নিতে হবে।

ন্যায়বিচার পাওয়ার ব্যাপারে সরকার অথবা আইন প্রণেতারা যথাযথ গুরুত্ব দেন না বলেই আইন ত্রুটিপূর্ণ থেকে যাচ্ছে। আমাদের স্বীকার করতে দ্বিধা থাকার কথা নয় যে, জাতীয় সংসদের বেশির ভাগ আসন এখন ব্যবসায়ীদের দখলে। সংসদ সদস্যদের আইনকানুনের জ্ঞান কম থাকতে পারে তবে অন্য যে কোনো দেশের মতো বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করে আইনের খসড়া প্রস্তুত করতে তো কোনো অসুবিধা নেই।

আসলে ক্ষমতার কর্তৃত্ব হাতের মুঠোয় রাখার ব্যাপারেই আমাদের সরকার ও আইন প্রণেতারা আগ্রহ দেখিয়ে থাকেন। যারা ক্ষমতায় থাকেন তাদের এমনই ধারণা সব ক্ষমতাই তাদের। তারাই আইন, তারাই বিচারক। নিজেরা পুলিশি শক্তির ওপর নির্ভরশীল, তাই তারা পুলিশি বিচারে বিশ্বাসী। অন্যথায় তারা আইনের খসড়া বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পরীক্ষা করিয়ে নিতে পারতেন। আইনের অপব্যবহারের জন্য সঠিক আইনের প্রয়োজন হয় না।

সুপ্রিম কোর্ট নিজস্ব ব্যাপারে প্রণীত রুলসমূহ সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশ করা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে টানাপড়েন চলছে তা কোনো শুভ ইঙ্গিত বহন করে না। বিচার বিভাগের সঙ্গে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব সৃষ্টির সুযোগ খোঁজা হচ্ছে। 

বংলাদেশে যাকেই কোনো রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার দেওয়া হয় তাকেই দেখা যায় ক্ষমতার অপব্যবহার করতে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যে কারও অর্জিত নিজস্ব খেয়ালখুশির ক্ষমতা নয়, জনগণ প্রদত্ত ক্ষমতা, সে কথা কেউ ভাবতে চান না। ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সহজেই ভুলে যাওয়া হচ্ছে যে, জনস্বার্থ রক্ষার জন্য জনগণ তাদের ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছে। ক্ষমতার সঠিক প্রয়োগের জন্য তাদের জবাবদিহিতা আছে। তাদেরও আইনের আওতায় বিচারের ব্যবস্থা আছে।

দেশ স্বাধীন হয়েছে কিন্তু স্বাধীন জাতির সুবিচারের দায়িত্ববোধ গড়ে উঠছে না। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা যে শাসনতন্ত্র ও জনগণের অধিকার সংরক্ষণের জন্য সে বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে না। ক্ষমতাসীনদের আচরণ এটাই বলে দিচ্ছে যে, তারাই স্বাধীনতা এনেছেন, স্বাধীনতা তাদের জন্য।

আমাদের সমস্যার স্বরূপ বুঝতে হলে জানতে হবে বিচার ব্যবস্থায় কীভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করে যে কাউকে গ্রেফতার করা কত সহজ। আইনের সুষ্ঠু প্রয়োগ করে সরকারের জনস্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে কীভাবে সফল হবে তা নিয়ে উদ্বেগ খুব কমই দেখা যায়। ধারণাটা এরকম : ক্ষমতায় যারা রয়েছেন অন্যায়ের বিচারও তারাই করবেন। অপরাধ দমনের ক্ষেত্রে পুলিশের কথাই শেষ কথা হবে। শাসনতন্ত্র, ব্যক্তির মৌলিক অধিকার বা আইনের শাসন কোনো কিছুই বাস্তবে কিছু নয়। 

 

 

আইনের ফাঁকফোকর থাকার কারণেই শুধু বিচার ব্যাহত হচ্ছে না, দোষী ব্যক্তিরাও ছাড়া পাচ্ছে। বিচার ব্যবস্থায় পুলিশি আধিপত্যের জন্য নির্দোষ লোকদের জেল খাটতে হচ্ছে। জনজীবনে নিরাপত্তাহীনতার অন্যতম প্রধান কারণ বিচার ব্যবস্থায় দুর্বলতা। আইনের সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে, সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে বিচার ব্যবস্থায়ও। নির্দোষকে রক্ষা না করে দোষীর বিচার সম্ভব নয়— দোষীদের রক্ষা করা হয়।

পুলিশ প্রশাসন স্বাধীন না হওয়ায় পুলিশকে যে পুরোপুরি বিশ্বাস করা যায় না সেটা কোর্টও জানে। তবুও জামিনে মুক্তি দেওয়া নিয়ে বাধা-বিপত্তির শেষ নেই। পুলিশকেও কোর্টে মামলা প্রমাণের দায়িত্ব নিয়ে মামলা শুরু করতে হয় না। পুলিশও চাপের মুখে আছে। 

এ মাসেই হাই কোর্ট বিভাগ ২০ জনকে জামিনে মুক্তি দিলেন যখন তাদের নজরে আনা হলো যে, এরা সবাই কোনো বিচার ছাড়াই এক দশক কিংবা তারও বেশি সময় ধরে জেল খাটছে। সারা দেশে এরকম আরও অনেক অসহায় মানুষ বিনা বিচারে জেল খেটে যাচ্ছে।

বিষয়টিকে বিচারিক বিবেক দিয়ে উপলব্ধি করতে হবে যে, কোনো অপরাধে দোষী প্রমাণিত না হওয়া সত্ত্বেও জীবনের অনেকগুলো বছর তাদের জেলে কাটাতে হলো। তাদের পরিবার ইতিমধ্যে হয়তো ছিন্নভিন্ন হয়ে গেছে কিংবা পথে বসে গেছে। বিচারের ক্ষেত্রে এ ধরনের মানবতাবিরোধী কাজের জন্য কোর্টের উচিত ভুক্তভোগীদের ক্ষতিপূরণ দিতে সরকারকে বাধ্য করা।

মানবিক বিবেক ভোঁতা হওয়ার কারণে অসহায়, নিরীহ মানুষ বিচারকদের বিচারের আগেই সাজা ভোগ করতে বাধ্য হচ্ছে। শাস্তি দেওয়ার দায়িত্ব যেন পুলিশের, আদালতের নয়। আইনের শাসনের কথা হলো, পুলিশকে আদালতে অভিযুক্ত ব্যক্তির দোষ প্রমাণ করতে হবে। 

আজকের এ দুঃসময়ে যখন সর্বত্র একতরফা ক্ষমতার দাপট চলছে তখন আমাদের বিচার ব্যবস্থাকে সাহস ও দৃঢ়তার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। পরিস্থিতি এখন এতটাই তুঙ্গে যে, বিচারকরা সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে সুবিচার নিশ্চিত করতে পারছেন কিনা সে প্রশ্ন অবান্তর। বিচারকদের সুবিচার করার দায়িত্বই তো অস্বীকার করা হচ্ছে।

প্রধান বিচারপতি আইন প্রণয়নকারীদের ভুলভ্রান্তির কথা বলেছেন। আইন প্রণয়নকারীরা তো প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতির বিচার করার আইনও পাস করে নিয়েছেন। বিষয়টির শাসনতান্ত্রিক বৈধতা নিয়ে সরকার মামলায় লড়ছে। রায় মাননীয় আপিল বিভাগ দেবে। হাই কোর্ট অসাংবিধানিক বলে আইনটিকে অবৈধ ঘোষণা দিয়েছে।

আলোচ্য আইনটিতে শাসনতান্ত্রিক বৈধতার বিষয়টি নির্ধারণ করবেন আপিল বিভাগের মাননীয় বিচারকবৃন্দ। আমি শুধু বিচার ব্যবস্থার প্রতি যে বিচার-অবিচারের চ্যালেঞ্জ ছোড়া হচ্ছে সে দিকটির বিশ্লেষণ দিচ্ছি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের ইমপিচমেন্ট বা অভিশংসন করার জন্য যে আইনটি পাস করা হয়েছে সেটা একটা ঔদ্ধত্যপূর্ণ পদক্ষেপ ছাড়া আর কিছুই নয়। নিরপেক্ষ বিচারপতিদের দ্বারা সুবিচার পাওয়ার জনগণের মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে। এর দ্বারা প্রধানমন্ত্রী নিজেই প্রধান বিচারপতি ও অন্য বিচারপতিদের অপসারণ করার ক্ষমতার অধিকারী হবেন। বর্তমান যুগে আফ্রিকার কোনো দেশেও এরকম উদাহরণ পাওয়া যাবে না। 

বিচারকদের ইমপিচমেন্ট করার ক্ষমতা কেবল দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদকেই দেওয়া হয়। নিম্নকক্ষ ইমপিচমেন্ট কার্যক্রম শুরু করে কিন্তু কোনো বিচারককে সাজা দেওয়ার ক্ষমতা থাকে উচ্চকক্ষের (upper house) হাতে। সুতরাং আমাদের জাতীয় সংসদ বড়জোর ইমপিচমেন্ট কার্যক্রম শুরু করার ক্ষমতা দাবি করতে পারে। দ্বিতীয় কক্ষের অবর্তমানে সংসদ সদস্যরা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিকে শাস্তি বা ইমপিচমেন্ট করার ক্ষমতা দাবি করতে পারেন না।

সরকার সংসদীয় ব্যবস্থা অমান্য করে নির্বাচনকালে ক্ষমতায় বহাল থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছে। সংসদে বিরোধী দলের অবস্থান অস্বীকার করা হয়েছে। এখন বিচারপতিদের বিচার করার ক্ষমতা চাওয়া হচ্ছে। তাহলে সরকার হবে সংসদ ও বিচার ব্যবস্থাসহ সব ক্ষমতার অধিকারী। এর পর আর যাই হোক সুবিচার পাওয়ার আইনের শাসন বা শাসনতন্ত্র প্রদত্ত মৌলিক অধিকার বলতে আমাদের কিছুই থাকবে না। থাকবে শুধু সরকার। এটাকেই মানতে হবে জনগণের মুক্তিযুদ্ধের অহংকার হিসেবে। সরকার যেটা দাবি করছে সেটা যদি মেনে নিতে হয় তাহলে ক্ষমতার পৃথককরণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিলুপ্ত হবে এবং তা হবে শাসনতন্ত্রের মৌলিক চরিত্রের পরিপন্থী। তাই বর্তমান শাসনতন্ত্র রেখে তার মৌলিক (basic structure) বৈশিষ্ট্য অস্বীকার করার উপায় নেই।

আজ বিচার বিভাগকে যে ভয়াবহ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে তার মূলকথা হচ্ছে, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষ বিচারিক শক্তি রক্ষার। বিচার-অবিচারের সংকট থেকে বিচার বিভাগকে রক্ষার শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব পালনের। বিচারহীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিহত করার।

আমি আগেও বলেছি এখনো বলব, সুপ্রিম কোর্টের এক রায়ের জন্য আমাদের নির্বাচন ব্যবস্থায় মহাসংকট সৃষ্টি হয়েছে। নির্বাচনী সংকট মুক্ত না হলে গণতন্ত্র সংকট মুক্ত হবে না। সংসদীয় ব্যবস্থায় কোনো দেশেই নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন হতে পারে না। কারণ, অতি সহজ : সংসদ না ভেঙে সংসদের নির্বাচন হয় না। আর সংসদ না থাকলে, সরকারও নির্বাচিত থাকে না।  তবুও আমাদের দেশে সেটাই সম্ভব করতে পেরেছে বিচার বিভাগের সিদ্ধান্তের কারণে। আমরা স্বাধীনতার যোগ্য নই— এ কলঙ্ক আমাদের কাছে গ্রহণীয় হতে পারে না।

লেখক : তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা।

সর্বশেষ খবর