বাংলাদেশের এবং পশ্চিমবঙ্গের অনেকে আমার কবিতা আবৃত্তি করে ইউটিউবে দেয়। অবধারিতভাবে বাংলাদেশের বাঙালির আবৃত্তি ভালো নয়, পশ্চিমবঙ্গের, বিশেষ করে কলকাতার বাঙালির আবৃত্তি ভালো। এর কারণ, উচ্চারণ। বাংলাদেশের অধিকাংশ বাঙালির বাংলা উচ্চারণে ত্রুটি থাকেই। শুদ্ধ বাংলা বলার অভ্যেস নেই বলেই সম্ভবত কবিতায় শুদ্ধ উচ্চারণে ভুল হয়ে যায়। বাংলাদেশের মানুষ শব্দে চন্দ্রবিন্দুর উচ্চারণ করেই না, দাঁড়ানোকে দাড়ানো বলে, অবশ্য দাড়ানোও বলে না, বলে দারানো। র আর ড়’ র উচ্চারণে কোনও পার্থক্য থাকে না। লক্ষ করেছি, বাংলাদেশের বাঙালি বাংলা শব্দ উচ্চারণ করতে গিয়ে মুখের যে পেশি ব্যবহার করে, কলকাতার বাঙালি সে পেশি ব্যবহার করে না। সে কারণেই উচ্চারণ ভিন্ন হতে বাধ্য। ফরাসি দেশের লোকের ফরাসি উচ্চারণ, আর কানাডা, বেলজিয়াম, সুইত্জারল্যান্ড, মালি, বেনিন, বুরুন্ডি, চাদ, কঙ্গো, জিবুতি, হাইতি, রুয়ান্ডার ফরাসিভাষী লোকদের ফরাসি উচ্চারণ ভিন্ন। বাংলাদেশের বাঙালিকে বাঙালি হতে হলে বাংলাটা অন্তত শুদ্ধ করে বলতে হবে, লিখতে হবে, তা না হলে হয়তো একদিন তাদের আর বাঙালি না বলে বাংলাভাষী বলা হবে। পশ্চিমবঙ্গের অনেকে বাংলাদেশের বাঙালিদের ‘বাঙাল’ বা ‘বাংলাভাষী’ বলে, বাঙালি বলে না। আমরা আপত্তি করি, কিন্তু কদিন করবো। অনেকে এও বলে, বাংলা ভাষা যদি টিকে থাকে, তাহলে বাংলাদেশেই টিকে থাকবে। তা ঠিক, কিন্তু বাংলাদেশে ভাষা টিকে থাকা মানে ভাষা নয়, উপভাষা টিকে থাকা , অপভ্রংশ টিকে থাকা। আমরা যে ভাষায় বই পত্র লিখি, সে ভাষায় কথা বলি না। কিন্তু চেষ্টা করলেই কিন্তু শুদ্ধ বাংলা বলার অভ্যেসটা আমরা করতে পারি। আবৃত্তি শেখার জন্য সারা পশ্চিমবঙ্গে বিদ্যালয় খোলা হয়েছে। বাচিকশিল্পীরা ছাত্রছাত্রীদের শুদ্ধ উচ্চারণে কথা বলতে শেখাচ্ছেন, কবিতা পড়তে শেখাচ্ছেন, খবর পড়তে শেখাচ্ছেন। বাংলাদেশে এমন অসংখ্য বিদ্যালয় থাকা উচিত। শুদ্ধ বাংলায় লিখতে-বলতে শিখলে আঞ্চলিক ভাষা বা উপভাষা হারিয়ে যায় না। দুটোই থাকে। বাংলাদেশে শুদ্ধ বাংলার চর্চাই শুদ্ধ বাংলাকে টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করবে।
ভাষা অবশ্য কোনও এক জায়গায় থেমে থাকে না। ভাষারও বিবর্তন ঘটে। আদি বাংলা ভাষা বোঝার জন্য আধুনিক বাংলা ভাষায় আমাদের অনুবাদ দরকার হয়। আদি বাংলা ছিল এরকম—
‘উঁচা উঁচা পাবত তঁহি বসই সবরী বালী।মোরঙ্গি পীচ্ছ পরহিণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী
উমত সবরো পাগল শবরো মা কর গুলী গুহাডা তোহৌরি।
ণিঅ ঘরনি ণামে সহজ সুন্দারী
ণাণা তরুবর মৌলিল রে গঅণত লাগেলি ডালী।
একেলী সবরী এ বণ হিণ্ডই কর্ণ কুণ্ডলবজ ধারী’।
এর অর্থ, ‘উঁচু পর্বতে শবরী বালিকা বাস করে। তার মাথায় ময়ূূরপুচ্ছ, গলায় গুঞ্জামালিকা। নানা তরু মুকুলিত হলো। তাদের শাখা-প্রশাখা আকাশে বিস্তৃত হলো। শবর-শবরীর প্রেমে পাগল হলো। কামনার রঙে তাদের হৃদয় রঙিন ও উদ্দাম। শয্যা পাতা হলো। শবর-শবরী প্রেমাবেশে রাত্রিযাপন করলো’।
এক সময় আমাদের এই বাংলা ভাষাও ভবিষ্যতের বাঙালি বুঝতে পারবে না, তারাও অনুবাদ দাবি করবে। বাংলাদেশের অনেকে বাঙাল ভাষা বা বাংলার পূর্বাঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষাটিকেই সাহিত্যের ভাষা করতে আগ্রহী, নতুন পরিচালকদের নাটকে এর হরদম ব্যবহার হয়। কিন্তু ভাষা যতক্ষণ টিকে আছে, উপভাষা একটি পূর্ণাঙ্গ ভাষা হয়ে উঠতে পারবে না। ‘করছি’ শব্দটির অস্তিত্ব থাকলে ‘করতেছি’ শব্দটি, শুধু বেশি লোকে বলে ব’লেই, পরিশীলিত বাংলার দাবি করতে পারে না। বিবর্তন আমাদের বাংলা ভাষাকে কী রূপ দেবে তা জানি না, কিন্তু আমাদের কাজ আমাদের ভাষাকে আরও সমৃদ্ধ করা। বিদেশি শব্দগুলোর জন্য বাংলায় পারিভাষিক শব্দ তৈরি করা। ভাষাকে ভালোবাসা।
বাঙালি তাদের ভাষাকে ভালো বাসে না। একুশে ফেব্রুয়ারি এলে হয়তো ভাষা নিয়ে আদিখ্যেতা শুরু হয়। কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারি থেকেই আবার যে কে সেই। ছেলেমেয়েদের ইংলিশ মিডিয়াম ইস্কুলে পাঠানো, ইংরেজি ভালো না জানলেও ইংরেজি বলার প্রাণপণ চেষ্টা করা, ইংরেজি ভালো বলতে পারলে তাদের খুব সহজে শিক্ষিত বলে রায় দিয়ে দেওয়া, ইংরেজি না জানলে লজ্জায় কুণ্ঠায় মাটির সাথে মিশে যাওয়া, ইংরেজি উচ্চারণে বাংলা বলা, বাংলা বলতে গিয়ে বারবার ইংরেজি শব্দে হোঁচট খাওয়া যেমন ‘আমি যেতে চেয়েছিলাম, বাট যেতে পারিনি’, এখানে কিন্তু বাট বলার কোনও দরকার নেই, কিন্তু শব্দটি আমাদের আছে। আর আমেরিকার নতুন ছেলেমেয়েদের মতো কথায় কথায় লাইক বলা। ওরা না হয় ইংরেজি বলতে গিয়ে লাইক এটা লাইক সেটা বলে, তুমি বাপু বাংলা বলতে গিয়ে এত লাইক লাইক করো কেন? ইংরেজি ভাষার প্রতি বাঙালিদের ভালোবাসা প্রচণ্ড। একটা চোর ভালো ইংরেজি বললে তাঁর কুকর্ম অপকর্ম সব ক্ষমা করে দিতে পারে তারা।
সম্ভবত গরিব অঞ্চলের ভাষা বলে বাইরের জগতে এই ভাষা নিয়ে বাঙালি গৌরব করতে পারে না। বিখ্যাত বাঙালির উদাহরণ দিতে গিয়ে এক রবীন্দ্রনাথকে থলি থেকে বের করে আর কত দেখাবে? গরিব দেশের ভাষার প্রতি মানুষের উৎসাহ কম থাকে। আমার বই অনুবাদ করতে গিয়ে আমার বিদেশি প্রকাশকরা অনুবাদক পান না। ইউরোপ আমেরিকার অনেকে চীনে ভাষা, জাপানি ভাষা, হিব্রু ভাষা, আরবি ভাষা শেখেন, কিন্তু বাংলা শিখতে আগ্রহী নন।
প্রায় পঁচিশ কোটি লোক, অথবা তারও চেয়ে বেশি, বাংলা ভাষায় কথা বলে। লেখে অনেক কম। যারা বাংলায় লিখতে পারে, ফেসবুকে তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ করার মতো। কিন্তু তাদের বাংলা লেখা দেখলে দুঃখ হয়। আমি কয়েকজনকে বলেছিলাম বাংলা বানান ঠিক করে লিখতে। ঠিক বানানটা বলেই দিয়েছিলাম। কিন্তু বানান ঠিক করার কোনও ইচ্ছেই তাদের নেই। তারা বলে ফেসবুকের ভাষা এটা, বানান ঠিক করে লেখার দরকার হয় না। ফেসবুকের লেখাগুলোই মানুষ বই পড়ার চেয়ে বেশি পড়ছে, আর সেখানে শুদ্ধ বানান লেখার প্রয়োজন নেই, এ কেমন কথা? হ্যাঁ, এটিই আজকের বাস্তবতা।
আমাকে কলকাতার এক সংস্কৃত বিশারদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ বাংলা বানান লিখতে ভুল করে, কারণ বাংলা ভাষার যে মূল উৎস, সংস্কৃত, এ নিয়ে তাদের চর্চা যথেষ্ট নয়, ফলে তৎসম শব্দের বানানের যে বিধিগুলো অনুসরণ করা হয়, সে সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল নন। ফলতঃ বাংলা সাহিত্য পড়ে ভাষা এবং বানান তাদের আয়ত্ত করতে হয়েছে, কিন্তু সেই বানানগুলোর উৎস সম্পর্কে তাদের সম্যক ধারণা নেই’। আজকাল অবাক হয়ে লক্ষ করি, কিছু প্রকাশক এবং সম্পাদকের কার্যালয় থেকে বাংলা বানানকে শুদ্ধ করার নামে অশুদ্ধ করে দেওয়া হয়। ওঁরা যে জেনেশুনে বানান ভুল করেন, তা নয়, বানান জানেন না বলে করেন। বাংলা বানান জানেন না, অথচ বাংলা বই প্রকাশ করেন, বাংলা পত্রিকা সম্পাদনা করেন। কী ভয়ঙ্কর কাণ্ড। শুদ্ধ করে বাংলায় একটি বাক্য লিখতে পারেন না, এমন লোকেরও দেখছি গল্প উপন্যাস বেরোচ্ছে, কবিতার বই বেরোচ্ছে। ভাষা নিয়ে তাই আমার আশংকা উত্তরোত্তর বাড়ছে। এই লেখক কবিরা বাংলার সর্বনাশ না করে ছাড়বেন না। বাংলা ভাষার জন্য মানুষ প্রাণ দিয়েছেন। এই ভাষাকে বাঁচিয়ে রাখার, এই ভাষাকে সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির। ভাষা যত সুন্দর হবে, যত শুদ্ধ হবে, এই ভাষাকে নিয়ে তত গর্ব হবে মানুষের।
লেখক : নির্বাসিত লেখিকা।