বৃহস্পতিবার, ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে বিজেপি

সুখরঞ্জন দাশগুপ্ত

সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে বিজেপি

ভারতের বিজেপি সরকারের পাঁচ বছরের মেয়াদ শেষ হতে আর মাত্র ৭০ থেকে ৮০ দিন বাকি। ২০১৯ সালের ৩১ জানুয়ারি চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণের মাধ্যমে সংসদের উভয় সভায় যৌথ অধিবেশনে সরকারের কাজকর্ম নিয়ে ৭০ মিনিট ধরে রাষ্ট্রপতি ভাষণ দিয়েছেন। এটি হলো বিদায়ী সরকারের লিখে দেওয়া শেষ ভাষণ। ৯ ফেব্রুয়ারি শেষ হবে লোকসভার অধিবেশন। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহের মধ্যে সারা ভারতে নির্বাচনের নির্ঘণ্ট নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করবে। নির্বাচন চলবে প্রায় দুই মাস ধরে।

আসন্ন নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সারা দেশে এখন চলছে সংঘর্ষ, খুন, হত্যা, লুট এবং দলবদলের কেনাবেচা। গেরুয়া বাহিনী দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার জন্য সারা দেশে এক অঘোষিত সন্ত্রাস শুরু করে দিয়েছে। শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ খবরই নয়, আমেরিকার সিনেটেও এরকমই একটি রিপোর্ট জমা পড়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে- লোকসভা ভোটের আগে ভারতে সাম্প্রদায়িক সংঘাতের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে দেশের গুপ্তচর বাহিনীর সর্বেসর্বা ভ্যান কোটস্থ রিপোর্টে তিনি লিখেছেন, ‘নরেন্দ্র মোদির দল বিজেপি হিন্দু জাতীয়তাবাদী ভাবনায় জোর দিলে সাধারণ নির্বাচনের সময় ভারতে সাম্প্রদায়িক হিংসার আশঙ্কা রয়েছে। সমর্থকদের চাঙ্গা করতে হয়তো হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণা চালিয়ে ছোটখাটো হিংসা বাধাতে চাইবেন নেতারা।’ শুধু আমেরিকার সিনেটের এই গোপন রিপোর্ট নয়, চাকরির ভয়ে মুখ খুলতে না চাইলেও নাম বলতে অনিচ্ছুক কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা অনুরূপ আশঙ্কা করছেন। তারা মনে করেন, আসন্ন নির্বাচন হবে রক্তাক্ত। মন্দির, মসজিদ, গির্জা সরকারি দলের মূল ইস্যু। কয়েক মাস ধরে তারা একটু ঝিমিয়ে ছিলেন কারণ অযোধ্যায় রামের জন্মস্থানে মন্দির হবে কিনা সে ব্যাপারে ভারতের শীর্ষ আদালতে (সুপ্রিম কোর্ট) একটি মামলা রয়েছে। বিশ্বের সংসদীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে স্পিকার সব সময় নিরপেক্ষতা অবলম্বন করে থাকেন-এটাই সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি ও নীতি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় এই হতভাগ্য ভারতবর্ষের লোকসভার স্পিকার শ্রীমতি সুমিত্রা মহাজন সাধু-সন্তরের সঙ্গে গলা মিলিয়ে একটি বিবৃতি দিয়ে বলেছেন- অবিলম্বে রাম মন্দির চাই। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর লালকৃষ্ণ আদভানির নেতৃত্বে বাবরি মসজিদ ভেঙে দেওয়া হয়। সে নিয়েও একটি মামলা সুপ্রিম কোর্টে আছে। বাবরি মসজিদ ভাঙার পর সারা ভারতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়েছিল। গেরুয়াবাহিনীর উসকানির কোনো অভাব নেই। গত সপ্তাহে প্রয়াগে কুম্ভমেলায় গঙ্গার বক্ষে দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশের সন্ন্যাসী মুখ্যমন্ত্রী গেরুয়াধারী যোগিআদিত্য নাথ তার মন্ত্রিসভার বৈঠক করেন। সেই বৈঠকে তারা গঙ্গাজলকে স্পর্শ করে শপথ নেন, নির্বাচনের দিন ঘোষণার মধ্যেই তারা রামমন্দির নির্মাণের কাজ শুরু করবেন। তাদের সেই মন্ত্রিসভার বৈঠকের ছবি বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেলে দেখানো হয়েছিল। গোটা ভারতবর্ষ তাতে স্তম্ভিত। এ ধরনের উসকানিমূলক অপকর্মের জন্য শুধু ভারতবর্ষ নয়, বিশ্বের নানা জায়গায় তার প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মোদি ও অমিতশাহ দেশের নানা প্রান্ত ঘুরে শুধু ধর্মীয় উসকানিই দিচ্ছেন না, তারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা বিভাজনের সৃষ্টি করে চলেছেন। শুধু কি তাই, মোদি সরকারের পক্ষ থেকে সুপ্রিম কোর্টে গিয়ে রামমন্দির সংলগ্ন সব জমি ছেড়ে দেওয়ার আবেদন জানান, কোর্ট এ বিষয়ে কোনো নির্দেশ দেয়নি। ভারত সরকারের সলিসিটর জেনারেল তুষার মেহতা বার বার প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈর কাছে গিয়ে রামমন্দির সংক্রান্ত মামলার দ্রুত শুনানি চেয়েছেন।

এদিকে সরকারি যুক্তি, প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ নিয়ম করে দিয়েছেন, কোনো মামলার দ্রুত শুনানির জন্য আইনজীবীদের এসে মুখে উল্লেখ করার দরকার নেই। যদি না ফাঁসি, দোষী ব্যক্তির জেল থেকে ছাড়া পাওয়া বা কাউকে উচ্ছেদ হতে হচ্ছে এমন কোনো জরুরি বিষয় না তৈরি হয়। মামলা শুনানির জন্য এক সপ্তাহের মধ্যে এমনিতেই তালিকাভুক্ত হয়ে যাবে। এ নিয়ম অবশ্য চালু হবে ফেব্রুয়ারি থেকে। তাই কেন্দ্রের আইনজীবীদের অযোধ্যা মামলার দ্রুত শুনানির আর্জি জানাতে কোনো বাধা ছিল না। সলিসিটর জেনারেল এমনিতেই অন্য মামলায় সেই আর্জি রেখেছেন। আইনজীবীদের একাংশ এই প্রশ্ন তুলেছেন যে, মোদি সরকার অন্য কোনো মামলা তুললেও তা রামমন্দির-বাবরি মসজিদের মূল মামলার সঙ্গেই যুক্ত হয়ে যেতে পারে। ফলে রামমন্দির ঘিরে নতুন বেলুনে হাওয়া দিলেও তা বেরিয়ে যাবে আর তাই বোধ হয় সেই ভয়ে কেন্দ্র কোনো বাড়তি সক্রিয়তা দেখাচ্ছে না। কারণ মূল মামলার মীমাংসা হওয়ার সম্ভাবনা যে কম তা সরকার বুঝে গেছে। প্রবীণ আইনজীবী সঞ্চয় জেগড়ে মন্তব্য করেছেন, মামলার মূল নথি কয়েক হাজার পৃষ্ঠার। অনেক ট্রাঙ্ক ও বাক্সে তা বন্দী হয়ে আছে। কিছু নথি আবার ফার্সিতেও লেখা। মামলাকারীর সংখ্যাও কম নয়। সুব্রক্ষনম স্বামীর মতো ব্যক্তিত্বও এ মামলার সঙ্গে জড়িত, সবার কথা বিস্তারিত শুনতে হবে। তাই মামলা শুরু হলে ১০ দিনের মধ্যে তার রায় বের হওয়া সম্ভব নয়। কথায় বলে চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। গেরুয়া বাহিনী ও বিজেপির সেই দশাই হয়েছে। তারা নির্বাচনের আগে মন্দিরের শিলান্যাস করতে চায়। এর পরিণাম যে ভয়ঙ্কর হতে পারে সে বিষয় গোটা দেশবাসী আতঙ্কিত। বিজেপি চাইছে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে একটা বড় ধরনের বিভাজন সৃষ্টি করতে।

রাহুল গান্ধীর নেতৃত্ব যে বিজেপিবিরোধী জোট সৃষ্টি হয়েছে বিজেপিকে হারানোর জন্য, এই জোট যাতে দানা বাঁধতে না পারে সে জন্য সব রকম কূটকৌশল রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে দিচ্ছে মোদির শিষ্যরা। ইতিমধ্যে হিন্দি বলয়ের মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড় ও রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রীরা রামমন্দির তৈরির জন্য কোটি কোটি টাকা সরঞ্জাম পাঠিয়েছে। এসব রাজ্য থেকে কয়েক হাজার মিস্ত্রিও নেওয়া হয়েছে। যে কোনো মুহূর্তে তারা একটা বড় ধরনের অঘটন ঘটাতে পারে। এটি ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। গেরুয়া বাহিনী সাম্প্রতিককালে যেসব কথাবার্তা বলছে বা বিরোধী পক্ষকে যেভাবে আক্রমণ করছে তার ভাষা মহাত্মা গান্ধী, রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ভাষা নয়, যা ছাপার অক্ষরে লেখা যায় না কিন্তু আধুনিক যুগে টেলিভিশনের পর্দায় সেসব ভাষা শোনা যায় যা ভারতের পক্ষে নিম্নরুচির পরিচায়ক বিশেষ করে প্রিয়াঙ্কা গান্ধীর রাজনীতিতে যোগদানকে কেন্দ্র করে যেসব কটূক্তি বিজেপি ও আরএসএস নেতারা করছেন তা সাধারণ মানুষের সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে। একজন মহিলা সম্পর্কে এ ধরনের ভাষা স্বাধীন-উত্তর ভারতবর্ষে আগে শোনা যায়নি। নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য বিজেপি ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে চলেছে। এই উন্মাদনাকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনে জয়লাভের কৌশল করছে।

অপরদিকে বিজেপিকে আমল দিতে চাইছেন না কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী। রাহুল গান্ধী বলেছেন, ‘রাফাল নিয়ে প্রশ্ন করলে চৌকিদার ওপরে, নিচে, ডাইনে, বাঁয়ে তাকান। রাফালের সত্য আসছে সরকারের ভিতর থেকে। নরেন্দ্র মোদির রাতে ঘুম আসছে না। আম্বানি-রাফালের ছবি ভেসে উঠছে। ভয় পেলেই রাতে কখনো নোটবন্দী করেন। কখনো লাইনে সবাইকে দাঁড় করান। অনিল-আম্বানিকে কেন ঝাড়– হাতে সাফাইয়ে নামান না? হাইটেক কথা বলেন, ধারার পাশে নালা তার গ্যাস থেকে জ্বালানি। মোদিজি নিজে একটা পাইপ লাগিয়ে দেখুন গ্যাস বেরোয় কিনা, এত গ্যাস দেন, দুই কোটি রোজগার দেবেন, কৃষকদের সঠিক দাম দেবেন... অনিলকে বরাত দিয়ে অগ্যাস বিগড়োলে চাষিদের ঋণ দিয়েও বিগড়োব।’

বিদেশি সরকারের লিখে দেওয়া যে ভাষণটি বৃহস্পতিবার দিল্লির সেন্টার হলে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে পড়ানো হলো সে ব্যাপারে অনেকের মতামত জানার জন্য যোগাযোগ করা হলে একই মন্তব্য পাওয়া যায় সবার কাছ থেকে। তাহলে বিজেপি রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহার পড়িয়ে দিলেন। নোটবন্দী থেকে ভয়াবহ বেকার সমস্যা, মোদি সরকারের দুর্নীতি নিয়ে একটি শব্দও তিনি বের করেননি। প্রথা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি সরকারের কাজকর্ম উল্লেখ করে থাকেন। সরকারের বৈদেশিক নীতি নিয়ে একটি শব্দও নেই, আছে শুধু মোদির প্রশংসা।         

            লেখক : ভারতীয় সাংবাদিক।

সর্বশেষ খবর