বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ ০০:০০ টা

তারুণ্যের শক্তি ও নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন

স্বপ্ন সারথি

‘তরুণ তারুণ্যের মতোই, যে তারুণ্য তিমির বিদারী, সে যে আলোর দেবতা’- কাজী নজরুলের এই অভিভাষণের মতোই বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখছে তারুণ্যের শক্তিতে জ্বলে ওঠার। দেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ (প্রায় ৫ কোটি ৩০ লাখ) আজ তারুণ্যের পতাকাবাহী। এ পতাকাতলেই জড়ো হয়েছে সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্ন। স্রোতের এ মাতম রুখবে সাধ্য কার! বাঙালির স্বপ্নে যুগ যুগ ধরে তরুণরাই নেতৃত্ব দিয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব স্বপ্নের সূচনা তরুণদের চোখে-মুখেই ধরা দিয়েছে আলোর ঝলকানি হয়ে। মাস্টারদা সূর্যসেন, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদাররা জ্বলে উঠেছিল এই তারুণ্যের শক্তি নিয়েই; যাদের বঞ্চিত বুকে ফেনিয়ে উঠেছিল উপনিবেশের বেঁধে দেওয়া পুঞ্জীভূত অভিমান। এই তারুণ্যের হুতাশনে পুড়েই ছাই হয়েছে আরব উপদ্বীপ। তিউনিসিয়ার তরুণ বোয়াজিজির নিজের গায়ে ঢেলে দেওয়া আগুন ছড়িয়ে পড়েছিল আরব বসন্ত হয়ে। তাই তারণ্যের জোয়ারকে বেঁধে রেখে নয়, সেই জোয়ারকে শক্তির টারবাইনে স্থানান্তরিত করে দেশকে সম্মুখে এগিয়ে নিতে হবে বিদ্যুতের মতো। তরুণদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাবটি দীর্ঘদিন ধরে রাষ্ট্রযন্ত্রের ধর্তব্যের বাইরে ছিল কিন্তু বিগত ১০ বছর ধরে শিক্ষা, কর্মসংস্থান এবং তাদের মেধা ও প্রতিভা বিকাশের সুযোগ অবারিত করতে সরকার চেষ্টা চালিয়েছে অফুরান। রাষ্ট্রযন্ত্র বুঝে গিয়েছিল এই তরুণরাই বয়ে নিয়ে আসবে সাফল্য, প্রথাগত সনাতনী ব্যবস্থা ভেঙে গড়ে তুলবে আধুনিক সমাজ কাঠামো। মর্মে মর্মে অনুভব করছে রবীন্দ্রনাথের সবুজের অভিযান কবিতার মর্মার্থ, যেখানে চিত্রপটে আঁকা আধমরাদের ঘা মেরে বাঁচাবে দুরন্ত কাঁচা সেনারা। আর সে উদ্দেশ্য সামনে রেখে তাদের দেওয়া হয়েছে নিত্যনতুন কার্যকর প্রশিক্ষণ, অর্থের অভাবে মুখ লুকানো উদ্যোক্তা তরুণদের দেওয়া হয়েছে সহজ শর্তে ঋণ ও অনুদান। কর্মসংস্থানের জন্য বৈচিত্র্যময় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে তাদের করে তোলা হচ্ছে শিক্ষিত, দক্ষ, কর্মমুখী ও আত্মনির্ভরশীল যা তাদের জীবনকে করে তুলবে নিরাপদ ও সম্মানজনক। সমৃদ্ধির মূলস্রোতে তরুণদের কার্যকরভাবে সম্পৃক্ত করতে ইতিমধ্যে ১১টি জেলায় স্থাপন করা হয়েছে যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র; যার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে উপজেলা পর্যায়েও। যেখান থেকে গত ১০ বছরে ২৪ লাখ তরুণ-তরুণী প্রশিক্ষণ লাভ করে পেয়েছে নতুন জীবনে দিশা, ভেঙেছে বেকারত্বের শৃঙ্খল। বেকারত্বের করাল গ্রাসে পতিত যুবসমাজকে বের করে নিয়ে আসতে ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ‘ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি’ বাস্তবায়নের যে কাজ অগ্রগায়ণ করা হচ্ছে তার সাতটি পর্ব থেকে ইতিমধ্যে ৩৭ জেলার ১২৮টি উপজেলায় ১ লাখ ৯৩ হাজার ৯৮৫ জন যুবককে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয়েছে; যার ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৫০ জন বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থায় নিযুক্ত হয়েছেন আর অস্থায়ী কর্ম শেষে তাদের ৮৩ হাজার ১৪ জন আত্মকর্মসংস্থানে নিয়োজিত হয়েছেন। কিছু বিষয়ে তরুণরা বার বারই হোঁচট খেয়েছে তাদের অধিকার ও প্রাপ্য দেনা-পাওনা আদায়ে, কারণ তাদের নিরাপদ জীবনাচরণে ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তায় ছিল না কোনো সরকারি আইন, অধ্যাদেশ। ২০১৭ সালে তাদের এই হতাশার বুকে আশার সঞ্চার করে ‘জাতীয় যুবনীতি-২০১৭’। যুবসমাজ খুঁজে পায় দাঁড়ানোর শক্ত পাটাতন, সে পাটাতনে ভর করেই লাখো তরুণ আজ স্বাবলম্বী, আত্মনির্ভরশীল। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিশেষজ্ঞদের অনেকেই বাজি ধরেছিলেন নীরব ভোট বিপ্লবের পক্ষে। যে নীরব বিপ্লবের নেতৃত্বে থাকবে তরুণ ভোটাররা। আদতে হয়েছেও তাই। নীরব বিপ্লব ঘটেছে এবং সেই বিপ্লবের গতিপথ ক্ষমতাসীন দলের পক্ষেই গিয়েছে কারণ তরুণ ভোটারেরা প্রত্যক্ষ করেছে গত এক দশকে দেশের উন্নয়ন। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে তারা সুবিবেচকের মতোই ব্যালটের মাধ্যমে তাদের মতামত প্রদান করেছে। তাই যুবসমাজের ভোটের মূল্য জনপ্রতিনিধিরা রাখবেন সে আশা আমাদের সবার। তাদের দীর্ঘদিনের হতাশা আর আকাক্সক্ষা সামনে এনে গ্রহণ করবেন নতুন নতুন উদ্যোগ। একটি সুচিন্তিত কর্মপরিকল্পনা প্রণয়নের মাধ্যমে জাতীয় যুবনীতির পুরোপুরি বাস্তবায়ন, তরুণ কল্যাণ ও উন্নয়নে প্রশাসনিক গতি আনতে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আওতায় পৃথক যুব বিভাগ গঠন, জাতীয় বাজেটে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের আর্থিক বরাদ্দ বৃদ্ধি, যুব গবেষণা কেন্দ্র গঠন- এ বিষয়গুলো তরুণদের প্রত্যাশা আর ক্ষমতাসীন সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারেও এগুলো উল্লেখ করা হয়েছিল।

শিক্ষা মানুষের সুকোমল বৃত্তিগুলোকে বিকশিত করে আর প্রশিক্ষণ পরিণত করে দক্ষ ও কর্মমুখী জনসম্পদে। তাই প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থাকে আধুনিকীকরণের মতোই মনোযোগী হওয়া সমীচীন হবে কারিগরি শিক্ষা ও তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি খাতে, গবেষণার দ্বার উন্মোচন করতে হবে প্রতিটি উচ্চশিক্ষা কেন্দ্রে, ন্যাশনাল সার্ভিস কর্মসূচি আশার আলো ছড়াবে প্রত্যন্ত অঞ্চলসমূহে। পাশাপাশি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দিতে এই কেন্দ্রগুলোকে গড়ে তোলা যায় জনসম্পদ তৈরির হাব হিসেবে। সাম্প্রতিক কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা। তাদের আন্দোলন ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে চেয়েছিল কুচক্রী মহল কিন্তু তাদেরই দৃঢ়তায় ও সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় তা ব্যর্থ হয় এবং সরকার মেনে নিয়েছে তরুণদের যৌক্তিক দাবি; যা মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগকে আরও প্রেরণাব্যঞ্জক করেছে। আরও একটি বিষয় নিয়ে তরুণরা দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে, তা হচ্ছেÑ সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা বৃদ্ধি। তরুণদের এ চাওয়া সামনে রেখে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের একটি যৌক্তিক সীমা নির্ধারণ করাও এখন সময়ের দাবি। স্বাভাবিকভাবেই সব মানুষ সমান মেধায় বা সমান পরিশ্রমের অধিকারী হয় না। একই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেও সবাই সমান দক্ষতা অর্জন করতে পারে না। তাই প্রয়োজন তাদের কর্মক্ষেত্রগুলোকে শ্রেণিকরণ করার। বিচিত্র্যময় প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে ভারসাম্যহীনতা দূরীকরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা কোনো দুরূহ কাজ নয়। মেধা, শ্রম, দক্ষতা, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার ওপর ভিত্তি করে কর্মপদ্ধতি ও প্রকল্প গ্রহণ প্রয়োজন। তবে তরুণদের জন্য আশার বাণী নিয়ে এসেছে সরকার, যেখানে ঘোষণা দেওয়া হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে স্বল্প, মধ্যম ও উচ্চ শিক্ষিত তরুণদের তথ্যসংবলিত ইন্টিগ্রেটেট ডাটাবেইজ তৈরির কথা, যার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের প্রয়োজন ও তরুণদের যোগ্যতা অনুযায়ী চাকরির পথ সুগম করবে। ইতিমধ্যে ২০২৩ সাল নাগাদ অতিরিক্ত ১ কোটি ৫০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টির পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে এবং উক্ত সময়ে নতুনভাবে শ্রমশক্তিতে যুক্ত হবে আরও ১ কোটি ১০ লাখ ৯০ হাজার মানুষ। উদ্ভাবনী ক্ষমতা ও উদ্যোক্তা হওয়ার সামর্থ্য বাংলাদেশের তরুণদের একটি সহজাত গুণ। নিত্যদিন তারা উদ্ভাবন করে চলেছে নতুন নতুন প্রযুক্তি এবং বাণিজ্য, কৃষি ও শিল্পের নতুন নতুন ক্ষেত্র। এই তরুণদের পৃষ্ঠপোষকতা বাংলাদেশকে এনে দিতে পারে একটি সোনালি স্বপ্নের আশা। তরুণদের উদ্যোক্তা হওয়ার প্রবণতা ও আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করতে কর্মসংস্থান ব্যাংকের মাধ্যমে বিনা জামানতে ও সহজ শর্তে ঋণ বিতরণ করা হচ্ছে। চিন্তা করা হচ্ছে সুবিধা আরও বৃদ্ধি করার এবং নতুন ‘উদ্যোক্তা নীতিমালা’ প্রণয়নের। খেলাধুলা, ইন্টারনেট সেবা, সুস্থ বিনোদন ও কাউন্সেলিংয়ের মাধমে উগ্রসাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ও জঙ্গিবাদের থাবা থেকে রক্ষা করতে যেমন পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে তেমনি মাদকের ভয়াল আসক্তি থেকেও তাদের রক্ষার জন্য কাউন্সেলিং সেন্টার, মাদক নিরাময় ও পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন এবং বেসরকারি কেন্দ্রগুলোকে আরও অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করে একটি সুস্থ ও কর্মোদ্দীপ্ত তরুণ সমাজ গঠন করে নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলাই সবার প্রত্যাশা। বিখ্যাত মার্কিন লেখক হেলেন কেলার উক্তি করেছিলেন, It is not possible for civilization to flow backward while there is youth in the world. Youth may be headstrong, but it will advance it’s allotted length. তাই যত দিন এই তরুণরা সমৃদ্ধির নেতৃত্ব দেবে তত দিন পিছু হটার ভয় নেই বাংলাদেশের। বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এই তারুণ্যের শক্তিতেই। ক্রিকেটের রণাঙ্গনে যেমনি সমীহ জাগিয়েছে পরাশক্তিসমূহের বিরুদ্ধে তেমনি নিজেদের উদ্ভাবনী ক্ষমতা, দক্ষতা এ কর্মস্পৃহায় দেশের আর্থ-সামাজিক ও পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থার নেতৃত্ব যে তরুণদের হাত ধরেই আসবেÑ তার ঘণ্টাধ্বনি আজ গহনদ্বারে বার বারই শুনি। তাই প্রয়োজন এই তরুণ সমাজকে সমৃদ্ধির মূলধারায় ধরে রাখা, তারুণ্যের মূল্যবোধকে অনুধাবন করা এবং সে অনুযায়ী পরিকল্পনা প্রণয়ন। আর এই তারুণ্যের শক্তিতেই আসবে বাংলাদেশের সমৃদ্ধি।

            লেখক : কলামিস্ট

সর্বশেষ খবর