বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০১৯ ০০:০০ টা

ক্ষমতার পাশেই পুলিশ ও কারাগার বাস করে

পীর হাবিবুর রহমান

ক্ষমতার পাশেই পুলিশ ও কারাগার বাস করে

ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলন সামনে রেখে সারা দেশে উৎসবমুখর পরিবেশে দলের তৃণমূল সম্মেলন হচ্ছে। উৎসবের আনন্দে যেমন নেতা-কর্মীদের মধ্যে জাগরণ সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি ব্যয়বহুল বর্ণাঢ্য আয়োজনে খরচের মাত্রাও দৃশ্যমান হয়েছে। টানা ১১ বছর দল ক্ষমতায়, একই সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির সঙ্গে দলের নেতা-কর্মীদেরও কপাল যে খুলেছে, তাও দেখা যাচ্ছে। ঢাকার দুই মহানগরীসহ এরই মধ্যে প্রায় ২০টি জেলা ও দেড় শতাধিক উপজেলার সম্মেলন সম্পন্ন হয়েছে। ২০ ও ২১ ডিসেম্বরের জাতীয় সম্মেলনের আগে অর্ধশত জেলার সম্মেলন শেষ হয়ে যাবে। একই দিনে দুই থেকে তিনটি জেলা ও মহানগরের সম্মেলন হচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ জেলাগুলোরই সম্মেলন হচ্ছে। দলের কেন্দ্রীয় নেতারা কেউ হেলিকপ্টারে, কেউ বিমানে, কেউবা সড়কপথে সম্মেলনে যোগ দিচ্ছেন বিশাল বহরসহ। অনেক সম্মেলনের বর্ণাঢ্য আয়োজনে নানা রঙের আলোকসজ্জাসহ সুদৃশ্য প্যান্ডেল ও মঞ্চ এবং শহরজুড়ে সাজসজ্জার তুমুল চিত্র দেখা যাচ্ছে। উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রামের ভিতর দিয়ে এই জায়গা দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে এসেছে। মাঠের নেতৃত্বে এবার ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা হচ্ছে। একেকটি জেলা ও মহানগরে একাধিক প্রার্থী দেখা দিলে তাদের নিয়ে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে কাউন্সিল অধিবেশনে নেতৃত্ব নির্বাচন করে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে নাম ঘোষণা করে আসছেন নেতারা। পূর্ণাঙ্গ কমিটি দেওয়া হলে উত্তম হতো। না হয় জটিলতা তৈরি হয়। ঢাকা মহানগরীতে যেভাবে অর্থবিত্ত আর নানামুখী বিতর্কিত সিন্ডিকেটের বাইরে আদর্শিক পোড় খাওয়া নেতৃত্ব উপহার দিয়েছেন, তাতে দলের নিবেদিতপ্রাণ যেসব নেতা-কর্মী হতাশ হয়ে পড়েছিলেন, অভিমানে ঘরে উঠেছিলেন, তারা এখন আশার আলো দেখছেন। দলের জন্য নিবেদিত হয়ে কাজ করলে যেমন মূল্যায়ন হয়, তেমনি দম্ভ, কোন্দল, দুর্নীতি ও বিতর্কিত কর্মকান্ডে লিপ্ত হলে দলের নেতৃত্ব থেকে বিতাড়িত হতে হয়।

সিলেট জেলা ও মহানগরে নেতৃত্বে রীতিমতো চমক দিয়ে এসেছেন নেতারা। মহানগর সভাপতি থেকে দীর্ঘদিন পর বাদ পড়লেন সাবেক মেয়র বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। যদিও তাকে কেন্দ্রীয় কমিটিতে আগেই আনা হয়েছে। একই সঙ্গে দলের দুবার মনোনয়ন না পাওয়া সাবেক এমপি ও দলের নিবেদিতপ্রাণ বিদায়ী সাধারণ সম্পাদক শফিকুর রহমান চৌধুরী বাদ পড়ায় অনেকের প্রশ্ন- আগামীতে কী ঘটছে তার ভাগ্যে। জেলা সভাপতি পদে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ সবার মুরুব্বি লুৎফর রহমানকে ভারমুক্ত করে সভাপতি করা হয়েছে। সাধারণ সম্পাদক হয়েছেন জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নাসির উদ্দিন খান। মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হয়েছেন দলের নিবেদিতপ্রাণ, মুক্তিযোদ্ধা, রাজনীতিবিদ মাশুক উদ্দিন আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক জাকির হোসেন। সবার ক্লিন ইমেজ রয়েছে। সবচেয়ে বড় চমক হয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে। সেখানে কাউন্সিলরদের ভোটে এবার নেতৃত্ব নির্বাচিত করা হয়েছে। ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে গণমুখী আদর্শিক চরিত্র নিয়ে উঠে আসা চারবারের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সালাম সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ছাত্রলীগের রাজনীতি দিয়ে দীর্ঘ পথ হাঁটা কর্মী আতাউর রহমান।

এদিকে জাসদ একাংশের নেতা মঈন উদ্দীন খান বাদলের মৃত্যুতে তার শূন্য হওয়া আসনে উপনির্বাচনে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারিয়ান বোর্ড মনোনয়ন দিয়েছে দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি মোসলেম উদ্দিনকে। ষাটের দশকের ছাত্রলীগ নেতা মুক্তিযোদ্ধা মোসলেম উদ্দিন ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এই প্রথম দলীয় মনোনয়ন পেলেন। দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের জন্য এটা বড় ধরনের সুখবর। মঈন উদ্দীন খান বাদলের পত্নী যদিও জোটের প্রার্থী হতে চাইছেন, কিন্তু উপনির্বাচনে যেখানে নির্বাচন হবে গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ, সেখানে জাসদের নেতা-কর্মীশূন্য এই আসনে বিএনপি প্রার্থীর সঙ্গে ভোটযুদ্ধে মোসলেম উদ্দিনই শক্তিশালী প্রার্থী। মোসলেম উদ্দিনের মনোনয়ন বহাল রাখাই হবে সঠিক সিদ্ধান্ত। দু-তিনটি জেলায় ব্যতিক্রম হলেও প্রায় সব জায়গায় আদর্শিক, গণমুখী ও পোড় খাওয়া নেতা-কর্মীরাই উঠে এসেছেন। যেসব জেলায় মেয়াদ শেষ হয়নি, সেসব জেলায় সম্মেলন হচ্ছে না। আওয়ামী লীগ সর্বশেষ জাতীয় সম্মেলনের আগে দলের জনপ্রিয় ক্লিন ইমেজের সাধারণ সম্পাদক মরহুম সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে উদ্বোধনী অধিবেশনে প্রায় জনসভা থেকে সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করে এসেছিলেন। তৃণমূল নেতা-কর্মীরা সে সময় সাধারণ সম্পাদক পদে অকালপ্রয়াত মেয়র আইয়ুব বখত জগলুল বা বতর্মান জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নুরুল হুদা মুকুটের নাম শুনতে চাইলেও অপ্রত্যাশিত নাম শুনে আর্তনাদ করে উঠেছিলেন। পরে পঁচাত্তর-উত্তর ছাত্রলীগের একজন সাধারণ সম্পাদক ছাড়া জেলা ছাত্রলীগের কোনো সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক কমিটিতে ঠাঁই না পাওয়ায় এবং অনেক ত্যাগী নেতার বদলে কারও কারও খেয়ালখুশিমতো নাম উঠে আসায় কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে তারা দলবেঁধে নালিশ জানিয়েছিলেন। এবারের সম্মেলনগুলোয় কোথাও এ রকম ঘটনা এখনো ঘটেনি। উৎসবমুখর পরিবেশেই সম্মেলন হচ্ছে। কাউন্সিল অধিবেশনে সমঝোতার ভিত্তিতে নেতৃত্ব নির্বাচন চলছে।

এ দেশে উপমহাদেশের প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ও ক্যারিশমায় এ দলটির প্রথম চূড়ান্ত বিকাশ ঘটেছিল। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতা-সংগ্রামের পথ ধরে সত্তরের গণরায়ে অভিষিক্ত হয়ে একাত্তরের সুমহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছিল। পঁচাত্তর সালের ১৫ আগস্ট পরিবার-পরিজনসহ বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর জাতীয় চার নেতাকেই কারাগারে হত্যা করা হয়নি, দলের হাজার হাজার নেতা-কর্মীকে নির্দয় অত্যাচার ও দমন-পীড়নে কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। হাজার হাজার তরুণ টাইগার সিদ্দিকী খ্যাত বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তমের নেতৃত্বে প্রতিরোধযুদ্ধে গিয়েছিলেন। ১০৪ জন শহীদ হন। অনেকেই নির্বাসিত হয়েছিলেন। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে ঘুরে দাঁড়ানো আওয়ামী লীগ আবদুর রাজ্জাককে মধ্যমণি করে আবদুল মালেক উকিল, তোফায়েল আহমেদদের সামনে নিয়ে ঘুরে দাঁড়ালেও মিজানুর রহমান চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি অংশ দলে ভাঙন সৃষ্টি করেছিল। ’৮১ সালে ইডেন কাউন্সিলে সভাপতি পদে নেতৃত্বের লড়াইয়ে দল যখন ভাঙনের মুখে, তখন নেতা-কর্মীদের আবেগ-অনুভূতির জায়গায় থেকে দিল্লি নির্বাসিত মুজিবকন্যা শেখ হাসিনাকে ঐক্যের প্রতীক হিসেবে সভানেত্রী নির্বাচিত করে দেশে এনে তাঁর দীর্ঘ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দলকে দ্বিতীয় দফায় চূড়ান্ত বিকাশ ঘটিয়ে একুশ বছর পর ’৯৬ সালে ক্ষমতার মুখ দেখেছিল। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা দেশের বাইরে থাকায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এই দলের নেতৃত্ব দিতে গিয়ে শেখ হাসিনাকে কুড়িবারের বেশি মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসতে হয়েছে। একুশের ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাসহ তাঁর ওপর নানামুখী আক্রমণ ও ষড়যন্ত্র হয়েছে। ৩৯ বছরের শেখ হাসিনার রাজনৈতিক সংগ্রাম শুধু ক্ষমতার আলোকিত দৃশ্যপটই নয়, তার চেয়ে বেশি দীর্ঘ বেদনার অশ্রু ঝরানো রাজপথের, কারাদহনের।

এ দেশের রাজনীতির জীবন্ত কিংবদন্তি তোফায়েল আহমেদ এমন কোনো সরকার নেই যাদের শাসনামলে রাজবন্দী হিসেবে জেল খাটেননি। শেখ হাসিনার নানা দুঃসময়ে বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ আমির হোসেন আমুসহ অনেকেই শেখ হাসিনাকে দেশে ফিরিয়ে আনাসহ তাঁর নেতৃত্বের হাতকে শক্তিশালী করতে অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন। ২০০১ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসতে না পারায় আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ঘরবাড়িছাড়া হয়েছেন। দেশান্তরী হয়েছেন। পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শাসক দলের নেতা-কর্মীদের হামলার মুখে পড়েছেন। কারা নির্যাতনও ভোগ করেছেন। রাজনীতিতে কখনো ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। সেদিন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যদি শেখ হাসিনা ফিরে না আসতেন এবং নানা সময়ের আঘাতে মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে না যেতেন, তাহলে ভাঙাগড়ার মধ্য দিয়ে নেতৃত্বের কোন্দলে জর্জরিত, ক্ষতবিক্ষত আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা দূরে থাক, রাজনীতিতে কী পরিণতির মুখোমুখি হতে হতো আজকের বাস্তবতায় গভীরভাবে চিন্তা করলে হাড়ে হাড়ে তা উপলব্ধি করা যায়। আজ আওয়ামী লীগ টানা ১১ বছর ক্ষমতাসীন হওয়ার কারণে শুধু দেশের উন্নয়নই ঘটেনি, অর্থনীতিতে আমাদের বিস্ময়কর উত্থানই হয়নি, অবকাঠামোগত উন্নয়নের চিত্রপটও দৃশ্যমান হয়েছে। তেমনি এটাও সত্য, দেশে সর্বগ্রাসী দুর্নীতির চিত্রপট আজ উঠে আসছে। এমনকি আওয়ামী লীগের অনেক নেতা-কর্মীও ১১ বছরের ক্ষমতায় নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। একসময়ের গরিবের দল গণমুখী আওয়ামী লীগে কেন্দ্র থেকে মাঠের অসংখ্য নেতা ধনাঢ্য হয়েছেন। দুর্নীতিবিরোধী অভিযানে অনেকের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে। অনেকের নাম আলোচিত হচ্ছে। অভিযানের ধারাবাহিকতায় আরও অনেকের নাম উঠে আসবে। সেটি আইনের ধারাবাহিক প্রয়োগের বিষয়। কিন্তু দলের সভানেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা দুর্নীতির বিরুদ্ধে তাঁর অঙ্গীকার প্রশ্নে যেমন অটল রয়েছেন, তেমনি নিবেদিতপ্রাণ ত্যাগীদের মূল্যায়নের যে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এমনকি দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে সতর্কতা দীর্ঘদিন থেকে উচ্চারণ করে আসছিলেন, তা এখন সম্মেলনের ময়দানে কার্যকর হতে দেখা যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের তৃণমূল থেকে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে বসে যারা কমিটি বাণিজ্য করেছেন, মনোনয়ন বাণিজ্য করেছেন, তদবির বাণিজ্যসহ নানা বিতর্কিত সিন্ডিকেটের সঙ্গে যুক্ত হয়ে রাজনৈতিক বাণিজ্যিকীকরণের পথে অঢেল অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের বাদ দেওয়ার এ প্রক্রিয়া অভিনন্দনযোগ্যই নয়, দলের গণমুখী আদর্শিক চরিত্র ফিরিয়ে এনে সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও সহায়ক। যে নেতা কর্মীর কাছ থেকে অর্থ নেন, বিদেশ সফরে ডলার নেন, সেই নেতা নিজেই দুর্নীতিগ্রস্ত নন, ওই কর্মীটিকেও দলীয় পদবি ব্যবহার করে অনৈতিক কর্মকান্ডে লিপ্ত হতে উৎসাহিত করেন। এমন নেতৃত্ব ও কর্মী দলের জন্য আশীর্বাদের বদলে অভিশাপ ছাড়া কিছু নয়।

যে কথা বলছিলাম, একটা সময় ছিল, আওয়ামী লীগে মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতি জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ সদস্য পদে মনোনয়ন দেওয়ার আগে যখন দলে যোগদান করান, তখন তাঁকে ধানমন্ডি ওয়ার্ড কমিটিতে প্রাথমিক সদস্যপদ নিতে হয়েছিল। একসময় প্রগতিশীল যত বড় নেতাই হোন তৃণমূল থেকে কেন্দ্রে আওয়ামী লীগে যোগদান করার পর নেতৃত্বে আসতে দীর্ঘ সময় পরীক্ষা দিতে হতো। প্রয়াত পার্লামেন্টারিয়ান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত গণতন্ত্রী পার্টির একাংশ নিয়ে রমনার বিশেষ কাউন্সিলে শেখ হাসিনাকে প্রধান অতিথি করে ’৯৪ সালে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছিলেন। কিছুদিন পর মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তাঁকে দলের প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন মরহুম আবদুর রাজ্জাকের বন্ধু। তাদের সম্পর্ক ছিল তুই-তোকারির। তোফায়েল আহমেদ একবার রসিকতার ছলে আবদুর রাজ্জাকের সামনেই সুরঞ্জিত সেনগুপ্তকে বলেছিলেন, ‘দাদা নেত্রীর প্রতি আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। তিনি দলে এনেই আপনাকে প্রেসিডিয়ামে ঠাঁই দিয়েছেন। আপনার ভাগ্য ভালো, আপনার বন্ধু রাজ্জাক ভাইয়ের সময় দলে যোগ দেননি, তাঁর সময় দলে যোগ দিয়ে মতিয়া চৌধুরীকে ওয়ার্কিং কমিটিতে পদবি পেতে দীর্ঘদিন বসে থাকতে হয়েছে।’ পরে একটা সময় অনেক ব্যবসায়ী এসেও আওয়ামী লীগে দুই দিনেই পদ-পদবি বাগিয়ে নিয়েছিলেন। এবারের সম্মেলনের মধ্য দিয়ে রাজনীতিটা রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের হাতে ফিরিয়ে আনার চিত্র দৃশ্যমান হচ্ছে। জাতীয় সম্মেলনের পর ওয়ার্কিং কমিটি ঘোষণা হলে বোঝা যাবে, দল ও সরকার আলাদা হচ্ছে কিনা এবং নবীন-প্রবীণের সমন্বয় হচ্ছে কিনা। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের মৃত্যুর দুয়ার থেকে সুস্থ হয়ে যেভাবে পরিশ্রম করছেন ও সময় দিচ্ছেন তাতে তিনি শেখ হাসিনার বিশ্বস্তজন হিসেবে সারা দেশের নেতা-কর্মীর সঙ্গে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের সুবাদে দ্বিতীয় দফা সপদে বহাল থাকছেন বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। মাঠপর্যায়ে অনেক জায়গায় এমপিরা নেতৃত্বে এসেছেন। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রী থেকেও দলের সাধারণ সম্পাদক পদে দায়িত্ব পালনের রেওয়াজও আওয়ামী লীগে রয়েছে। সরকার ও দলকে আলাদা করার পরীক্ষা কতটা যৌক্তিক, বিচার করতে হবে। কর্মী ও মানুষের কাজ করতে হলে দলের পদবির সঙ্গে ক্ষমতাও জরুরি। তবে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে অনেকেই আলোচনা করছেন মন্ত্রিসভায় একটা পরিবর্তন আনা যেমন অনিবার্য, তেমনি দলেও নবীনের সঙ্গে প্রবীণের অভিজ্ঞতা ও ভাবমূর্তির সমন্বয় ঘটানো জরুরি। মন্ত্রিসভায় আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, মতিয়া চৌধুরীদের যেমন আনার প্রয়োজন মনে করছেন অনেকেই, তেমনি দলের প্রেসিডিয়ামে আমু-তোফায়েলসহ সারা দেশের নেতা-কর্মীর কাছে পরিচিত, গ্রহণযোগ্য কিছু অভিজ্ঞ নেতাকেও যুক্ত করার যুক্তি দিচ্ছেন।

দেশে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে মানুষ না খেয়ে না মরলেও নষ্ট সময়ের অসুস্থ প্রতিযোগিতায় মূল্যবোধ হারিয়ে এ দেশের রাজনীতি, শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত সমাজসচেতন মধ্যবিত্ত শ্রেণির একটি অংশ ভেসে গেলেও আরেকটি অংশ হিমশিম খাচ্ছে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তরা না খেয়ে মারা না গেলেও জীবনের কঠিন সংগ্রামের লড়াই করছে। আরেকদিকে একটি অংশ ঘুষ-দুর্নীতিতে ডুবে গিয়ে অঢেল অর্থসম্পদ গড়ছে। একটি প্রতারক সময়ের মুখোমুখি দেশ। আদর্শিক রাজনীতিতে খরা দেখা দেওয়ায়ও লোভ ও লাভের অতিরিক্ত নেশায় অসুস্থ প্রতিযোগিতায় সমাজে বেহায়া নষ্টদের দাপট বেড়েছে। দুর্নীতিবাজ অসৎ মিথ্যুকদের একদিন যে সমাজ ঘৃণা করত আজ সমীহ করছে। অনেকেই বিদেশে অর্থ পাচার করেছেন। ব্যাংক ও শেয়ারবাজার এবং সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে লুটপাট করে নিজেদের আখের গুছিয়েছেন। ব্যবসা-বাণিজ্য ছাড়াও অবৈধভাবে যারা কাঁচা অর্থ ও সম্পদের মালিক হয়েছেন, তাদের আইনের আওতায় আনা হবে- এমনটি মানুষ বিশ্বাস করছে। একসময় রাজনীতিতে সব দলের সম্মেলনে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে নৈতিক প্রতিযোগিতায় রাজনীতিতে রক্তসঞ্চালন ঘটত। দেশে এখন শাসক দল আওয়ামী লীগের উৎসববন্যায় ভাসলেও এত আলোকসজ্জা আর সাজসাজ রব তুললেও কোথায় যেন ছন্দপতন, কোথায় যেন বিষাদগ্রস্ততা, কোথায় যেন দমবন্ধ বুকভরে শ্বাস নিতে না পারার বেদনা রাজনীতিতে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। আদর্শিক রাজনীতি ও দুর্নীতিমুক্ত শাসনব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক সমাজই আনন্দহীন পরিবেশ থেকে মুক্তি দিতে পারে। গণতন্ত্রের দরজা-জানালাও কিন্তু খুলে দিতে হবে। বিএনপি বিধ্বস্ত মানে শেষ নয়। আওয়ামী লীগের ক্ষমতানির্ভর বর্ণাঢ্য সম্মেলনের এত মহাআয়োজন উৎসব মানে এই নয় যে, গোটা দেশে সবাই আওয়ামী লীগ হয়েছে। দুর্দিনে আওয়ামী লীগ ও মহোৎসব দূরে থাক পোস্টার আর প্রচারের খরচ জোগাতে হিমশিম খেয়েছি। বিএনপি ক্ষমতায় থাকতেও কত বর্ণাঢ্য জনসভা আলোকসজ্জার বর্ণালি সম্মেলন করেছিল! আজ কোথায়?

স্বাধীনতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধী জামায়াতও নতুন নেতৃত্ব নির্বাচিত করেছে। নতুন আমির ডা. শফিকুর রহমান বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালেও যখন মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযোগে ফাঁসিতে ঝুলে যাওয়া নেতাদের স্মরণ করেন, তখন বোঝা যায়, সে তার রাজনীতির মূল জায়গাটিতেই রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের অপরাধের বোঝাই বহন করছে। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা বিএনপি-জামায়াত তার পাপের শাসনের অভিশাপে ও দম্ভে এতটাই অন্ধ ছিল যে, চিন্তাই করেনি, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতার পাশেই একের পর এক নির্মিত হয় সুরম্য কারাগার। দেশের উন্নয়নের সঙ্গে সারা দেশে অনেক নতুন কারাগার তৈরি হয়েছে। বিএনপি আমলে তৈরি অনেক কারাগারে তাদের অনেক মন্ত্রী-নেতা ঘুরে এসেছেন। অনেকেই এখনো আছেন। বিএনপি একটি জনসমর্থিত, জনপ্রিয় রাজনৈতিক দল হলেও তাদের নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া বৃদ্ধ বয়সে অসুস্থ শরীরে এখন কারাজীবন ভোগ করছেন। তাঁর দোর্দ- প্রতাপশালী পুত্র হাওয়া ভবনের সঙ্গে বাস করা সেদিনের বহুল আলোচিত ক্ষমতার প্যারালাল শক্তি তারেক রহমান বিভিন্ন মামলায় দন্ডিত হয়ে লন্ডনে নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। লন্ডনে বসে মায়ের অবস্থা নেতা-কর্মীদের করুণ দুর্দশা কতটা উপলব্ধি করছেন তার কথাবার্তায় তা বোঝা যায় না। তবে ১১ বছর ধরে আওয়ামী লীগ ও তার ক্ষমতার অংশীদার যারা দম্ভ, আত্মঅহংকার ও অনৈতিক কর্মকান্ডে জড়িয়েছেন বা জড়িয়ে যাচ্ছেন, তাদের শিক্ষা গ্রহণের কথা। জর্জ বার্নার্ড শ যদিও বলেছেন, ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে, ইতিহাস থেকে কেউ শিক্ষা নেয় না। কিন্তু রাজনীতিতে ইতিহাসের শিক্ষাই হচ্ছে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতাবানদের পাশেই বাস করে পুলিশ ও কারাগার। কাল যারা ক্ষমতায় ছিলেন, পুলিশ যাদের স্যালুট দিয়েছে, সুবিধাবাদীরা যাদের নিয়ে উল্লাস করেছে, সেই ক্ষমতাবানদের আজ পুলিশ লাঠিপেটা করছে। ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে জেলে ঢোকাচ্ছে। ভ্যানে তুলে আদালতে হাজির করছে। আর সুবিধাবাদীরা ফিরেও তাকাচ্ছে না। যাঁরা রাজনৈতিক কর্মসূচিতে আর্থিক অনুদান দিতেন, তাঁরা টেলিফোনই ধরছেন না। এই দুঃসময়টা একসময় আজকের আওয়ামী লীগ ও তার মিত্ররা দেখেছেন। এই দুঃসময়টা সেদিনের ক্ষমতার দম্ভে উন্নাসিক বিএনপি আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। রাজনীতির এই পাঠশালা থেকে সবাইকেই পাঠ নেওয়া জরুরি।

আওয়ামী লীগ পঁচাত্তর-উত্তর দীর্ঘ সময়ই দেখেনি, ২০০১ সালের পরও নির্মমতা সয়েছে। তাই আজ যারা বিরোধী দলে দমন-পীড়ন কারাগারে তাদের নিয়ে উল্লাস না করে, আনন্দ না করে শিক্ষা নেওয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর আত্মসমালোচনা আত্মসংযম ও আত্মশুদ্ধির পথে নিজেদের ক্লিন বিনয়ী ইমেজ তৈরি করা অনিবার্য। ক্ষমতা চলে গেলে প্রতিটি দম্ভ ও অহংকারের হিসাব ভোগ করতে হয়। নিজেদের শুধরে মুজিবকন্যার হাত শক্তিশালী রাখাই উত্তম।

                লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

সর্বশেষ খবর