শুক্রবার, ৩১ জানুয়ারি, ২০২০ ০০:০০ টা

যার আসন আমাদের হৃদয় সিংহাসনে

ক্যাপ্টেন এ বি তাজুল ইসলাম (অব.), এমপি

যার আসন আমাদের হৃদয় সিংহাসনে

শতাব্দীর ক্ষণজন্মা সংশপ্তক, অকুতোভয় সিংহপুরুষ, আজীবন দৃঢ় প্রতিজ্ঞ সংগ্রামী বীর মহামানবের স্থান ১৬ কোটি মানুষের হৃদয় সিংহাসনে, বাংলাদেশ জাতি-রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি দেশবাসীর অনাবিল অবিমিশ্র প্রাণঢালা শ্রদ্ধা নিবেদনের লক্ষ্যে উদ্যাপিত হচ্ছে মুজিববর্ষ। জাতির জীবনে এ এক পরম মাহেন্দ্রক্ষণ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে শিক্ষা আন্দোলন, ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন, সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলন, সর্বোপরি সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

আজ থেকে শতবর্ষ আগে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া গ্রামে ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ পুণ্য দিবসে মায়ের কোল আলো করে খোকা নামের যে শিশুটি এ ধরণিতে এসেছিল, ক্রমান্বয়ে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সমগ্র বাংলার নয়নমণি। কালক্রমে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার নিপীড়িত-নির্যাতিত জনতার প্রতিভূ এবং মুক্তিসংগ্রামের অপ্রতিরোধ্য নেতা। মহাকালের ইতিহাসে চির-অক্ষয় সেই স্বর্ণোজ্জ্বল শেখ মুজিবের নাম আজ কেবল বাংলার ঘরে ঘরেই নয়, সমগ্র বিশ্বে সসম্মানে উচ্চারিত।

জাতির জনকের জন্মের শুভলগ্নে মনে পড়ে কবিগুরুর সেই অবিস্মরণীয় পঙ্ক্তিমালাÑ

‘ঐ মহামানব আসে; দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে, মর্ত্যধূলির ঘাসে ঘাসে।

সুরলোকে বেজে উঠে শঙ্খ, নরলোকে বাজে জয়ডঙ্ক, এল মহাজন্মের লগ্ন।

আজি অমারাত্রির দুর্গতোরণ যত, ধূলিতলে হয়ে গেল ভগ্ন।

উদয়শিখরে জাগে মাভৈঃ মাভৈঃ রব, নব জীবনের আশ্বাসে।

জয় জয় জয় রে মানব-অভ্যুদয়, মন্দ্রি উঠিল মহাকাশে।’

জাতির পিতার সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মুজিববর্ষ উদ্যাপনের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করে বলেছেন, মুজিব শতবর্ষ উদ্যাপনের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিম-লে বঙ্গবন্ধুর কর্মময় জীবনের নানা দিক আরও ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। এর ফলে বিশ্ববাসী বঙ্গবন্ধুর আত্মত্যাগ ও বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবন সম্পর্কে নতুন করে জানতে পারবে। দ্বিবার্ষিক অ্যানিভার্সারি প্রোগ্রামের আওতায় ইউনেস্কো কোনো বিশেষ ঘটনার বা বিশিষ্ট ব্যক্তির জন্মের ৫০তম বা তদূর্ধ্ব অর্থাৎ ৭৫তম বা ১০০তম বা ১৫০তম বার্ষিকী উদ্যাপন করে। এ প্রোগ্রামের আওতায় ২০২০-২১ সালের জন্য ইউনেস্কোর গ্রহণ করা ৫৯টি অ্যানিভার্সারি উদ্যাপনের প্রস্তাবের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে বাংলাদেশের জাতির জনকের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুকে একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে নয়, বরং সাধারণ মানুষের অধিকার আদায়ের প্রতীক হিসেবে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণে ইউনেস্কো উদ্যোগী হয়। ইউনেস্কোর ম্যান্ডেটভুক্ত বিভিন্ন বিষয়ে বঙ্গবন্ধুর অনন্যসাধারণ অবদান এ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে বিশেষভাবে বিবেচনা করা হয়েছে; বিশেষ করে স্কুলজীবন থেকে শিক্ষার্থীদের অধিকার নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সচেতনতা ও পরবর্তী সময়ে শিক্ষা বিস্তারে বিভিন্ন কার্যক্রম, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে গৃহীত বিভিন্ন পদক্ষেপ, দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর পরিকল্পনা এবং সর্বোপরি ভাষার অধিকারসহ বাঙালির সব অধিকার আদায়ে বঙ্গবন্ধুর অবিচল সংগ্রাম ও ত্যাগের বিষয়গুলো ইউনেস্কো বিশেষভাবে বিবেচনা করেছে। শেখ হাসিনা বলেন, ইউনেস্কো বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় এ আয়োজন আন্তর্জাতিক রূপ লাভ করল এবং অনন্যমাত্রায় উন্নীত হলো। ইউনেস্কোর তত্ত্বাবধানে এখন সারা বিশ্ব নানা আয়োজনে জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন করবে। এর ফলে বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস এবং বাঙালি জাতির ও বাংলাদেশের জনগণের জন্য তাঁর আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীর কাছে আরও বড় পরিসরে প্রকাশ হবে।

মুজিববর্ষের বছরব্যাপী কর্মসূচি ও অনুষ্ঠানমালা যথোপযুক্ত জাঁকজমকপূর্ণ, আকর্ষণীয় ও আড়ম্বরপূর্ণ হবে। ২০২০ সালে পূর্ণ হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মের এক শত বছর। আর ২০২১ সাল হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছর।

মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের রাজত্বকালে ১৫৩৮ খ্রিস্টাব্দে বাংলার স্থানীয় প্রধান ও জমিদার বারো ভূঁঁইয়া প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিলেন। উনিশ শতকে বাংলায় হাজী শরীয়তউল্লাহর (১৭৮১-১৮৪০) নেতৃত্বে বাংলায় ঔপনিবেশিক ব্রিটিশবিরোধী দরিদ্র কৃষককে জমিদারদের শোষণ-নির্যাতন থেকে মুক্তি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ফরায়েজী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনার সাইয়িদ মীর নিসার আলী তিতুমীর (১৭৮২-১৮৩১) বাংলার প্রজাকুলের ওপর স্থানীয় জমিদার ও ইউরোপীয় নীলকরদের অত্যাচার প্রতিরোধ এবং ব্রিটিশ শাসন থেকে বাংলাকে মুক্ত করার লক্ষ্যে ১৮৩১ সালের অক্টোবরে নারকেলবাড়িয়ায় এক দুর্ভেদ্য বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করেন।

বাংলাদেশে মধ্যযুগ থেকে স্বাধীনতার চেতনা দেখা দিয়েছিল, তবে তা সংহত রূপ লাভ করেছে বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ, তিতিক্ষা ও অবিচল সংগ্রামের ফলে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যুদ্ধ করে স্বাধীনতার সূর্য এনেছি। বঙ্গবন্ধুর সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিকের বিশ্লেষণ করলেই তা সুস্পষ্টরূপে প্রতিভাত হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানের উপক্রমণিকায় বলা হয়েছে, ‘অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চ তারিখে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে বাংলার ইতিহাসে সর্ববৃহৎ জনসভায় এক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বর্ণনা করিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত হইবার ডাক দেন এবং ঘোষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”।’

বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গ করে শামসুর রাহমান ‘ধন্য সেই পুরুষ’ লিখেছেন-

‘ধন্য আমরা, দেখতে পাই দূর দিগন্ত থেকে এখনো তুমি আসো

আর তোমারই প্রতীক্ষায়

ব্যাকুল আমাদের প্রাণ, যেন গ্রীষ্মকাতর হরিণ

জলধারার জন্যে। তোমার বুক ফুঁড়ে অহঙ্কারের মতো

ফুটে আছে রক্তজবা, আর

আমরা সেই পুরুষের দিকে চেয়ে থাকি

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর রৌদ্র ঝরে

চিরকাল, গান হয়ে

নেমে আসে শ্রাবণের বৃষ্টিধারা; যাঁর নামের ওপর

কখনো ধুলো জমতে দেয় না হাওয়া,

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পাখা মেলে দেয়

জ্যোৎস্নার সারস,

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর পতাকার মতো

দুলতে থাকে স্বাধীনতা,

ধন্য সেই পুরুষ, যাঁর নামের ওপর ঝরে

মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি।’

৭ই মার্চে স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান

মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিশ্বের যে তিন জননেতার ভাষণ অমর হয়ে আছে তাঁরা হলেনÑ আমেরিকার প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯-১৮৬৫), বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং জুনিয়র (১৯২৯-১৯৬৮) এবং বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিয়তির কি নির্মম বিধান- এ তিন নেতার প্রত্যেকেই আততায়ীর গুলিতে নিহত হন।

১৮৬৩ সালে আমেরিকার ইতিহাসের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধে প্রায় ৮ হাজার মানুষ নিহত হয়। ওই বছরের ১৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে মাত্র দুই মিনিটের বক্তৃতাটি প্রদান করেন। বিখ্যাত আফ্রিকান-আমেরিকান মানবাধিকারকর্মী মার্টিন লুথার কিং ১৯৬৩ সালে ওয়াশিংটনে প্রায় ৩ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে তাঁর সেই বিখ্যাত ‘আই হ্যাভ অ্যা ড্রিম’ ভাষণটি প্রদান করেন।

গণতন্ত্রের মানসপুত্র বঙ্গবন্ধুর ১৮ মিনিট স্থায়ী ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বানের সেই অনলবর্ষী ভাষণ ‘ওয়ার্ল্ডস ডুকমেন্টারি হেরিটেজ’ হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ায় বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির গৌরব বহির্বিশ্বে বিপুলভাবে বেড়েছে।

অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ

‘বঙ্গমাতা’ শীর্ষক কবিতায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :

‘সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।

পুণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।

হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।

দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।’

কবি বেঁচে থাকলে নিশ্চয় আজকের বাংলাদেশ দেখে স্বস্তি পেতেন।

বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট আবর্তিত হচ্ছে পৃথিবীর কক্ষপথ ঘিরে। দেশের নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতুর মতো বৃহৎ কর্মযজ্ঞ। বাস্তবায়ন হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্তত ১০টি মেগা প্রকল্প। এসবই মাত্র কয়েক বছরে সম্ভব হয়েছে বঙ্গবন্ধুকন্যা বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বে।

বাংলাদেশের স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণ ঘটেছে। জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন নীতিসংক্রান্ত কমিটি (সিডিপি) গত ১৫ মার্চ এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণের যোগ্যতা অর্জনের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়। এলডিসি ক্যাটাগরি থেকে উত্তরণের জন্য মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ সূচক এবং অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক এ তিনটি সূচকের যে কোনো দুটি অর্জনের শর্ত থাকলেও বাংলাদেশ তিনটি সূচকের মানদন্ডেই উন্নীত হয়েছে।

জাতিসংঘের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিলের (ইকোসক) মানদন্ড অনুযায়ী এ ক্ষেত্রে একটি দেশের মাথাপিছু আয় হতে হবে কমপক্ষে ১২৩০ মার্কিন ডলার, বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় তার থেকে অনেক বেশি অর্থাৎ ১৬১০ মার্কিন ডলার। মানবসম্পদ সূচকে ৬৬ প্রয়োজন হলেও বাংলাদেশ অর্জন করেছে ৭২ দশমিক ৯। অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা সূচক হতে হবে ৩২ ভাগ বা এর কম যেখানে বাংলাদেশের রয়েছে ২৪ দশমিক ৮ ভাগ।

‘যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ থেকে আজকের এই উত্তরণ- যেখানে রয়েছে এক বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার ইতিহাস’ সরকারের রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়নের এটি একটি বড় অর্জন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের সাহসী ও অগ্রগতিশীল উন্নয়ন কৌশল গ্রহণের ফলে যা সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, কাঠামোগত রূপান্তর ও উল্লেখযোগ্য সামাজিক অগ্রগতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে দ্রুত উন্নয়নের পথে নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় উঠে আসে জন্মের ৫০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে কীভাবে বাংলাদেশ দ্রুতগতিসম্পন্ন বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণের মতো সফলতা দেখাতে যাচ্ছে। উঠে আসে জাতির পিতা কীভাবে সমগ্র জাতিকে স্বাধীনতার জন্য একতাবদ্ধ করেছিলেন, যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ থেকে কীভাবে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলায় পরিণত হতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার গতিশীল নেতৃত্ব, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, এমডিজি অর্জন, এসডিজি বাস্তবায়নসহ শিক্ষা, স্বাস্থ্য, লিঙ্গসমতা, কৃষি, দারিদ্র্যসীমা হ্রাস, গড় আয়ু বৃদ্ধি, রপ্তানিমুখী শিল্পায়ন, ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল, পোশাকশিল্প, ওষুধশিল্প, রপ্তানি আয় বৃদ্ধিসহ নানা অর্থনৈতিক সূচক। পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, ঢাকা মেট্রোরেলসহ দেশের মেগা প্রকল্পসমূহ।

বাংলাদেশের অর্জন

ক্ষুদ্র আয়তনের একটি উন্নয়নশীল দেশ হয়েও বাংলাদেশ ইতিমধ্যে সারা বিশ্বের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগের নিবিড় সমন্বিত ব্যবস্থাপনা, ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবহার এবং দারিদ্র্য দূরীকরণে তার ভূমিকা, জনবহুল দেশে নির্বাচন পরিচালনায় স্বচ্ছ ও সুষ্ঠুতা আনয়ন, বৃক্ষরোপণ, সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকের ইতিবাচক পরিবর্তন প্রভৃতি ক্ষেত্রে অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। ৩০ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে জন্ম নেওয়া এই বাংলাদেশকে আজকের অবস্থানে আসতে অতিক্রম করতে হয়েছে হাজারো প্রতিবন্ধকতা। যুদ্ধবিধ্বস্ত, প্রায় সব ক্ষেত্রে অবকাঠামোবিহীন সেদিনের সেই সদ্যোজাত জাতির চার যুগের অর্জনের পরিসংখ্যানও নিতান্ত অপ্রতুল নয়। সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার আটটি লক্ষ্যের মধ্যে শিক্ষা, শিশুমৃত্যুহার কমানো এবং দারিদ্র্য হ্রাসকরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য উন্নতি প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। নোবেল বিজয়ী ভারতীয় অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের করা মন্তব্য এ ক্ষেত্রে প্রণিধানযোগ্য। তার মতে কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিশ্বকে চমকে দেওয়ার মতো সাফল্য আছে বাংলাদেশের। বিশেষত শিক্ষা সুবিধা, নারীর ক্ষমতায়ন, মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার ও জন্মহার কমানো, গরিব মানুষের জন্য শৌচাগার ও স্বাস্থ্যসুবিধা প্রদান এবং শিশুদের টিকাদান কার্যক্রম অন্যতম।

শিক্ষা খাতে অর্জন

শিক্ষাকে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপসমূহের মধ্যে অন্যতম হলোÑ শতভাগ ছাত্রছাত্রীর মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ কার্যক্রম। নারী শিক্ষাকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি ব্যবস্থা। বর্তমানে ২৬ হাজার ১৯৩টি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে নতুন করে জাতীয়করণ করা হয়েছে। উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিক্ষকের চাকরি সরকারিকরণ করা হয়েছে। ১৯৯০ সালে বিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া শিশুর শতকরা হার ছিল ৬১, বর্তমানে তা উন্নীত হয়েছে শতকরা ৯৭.৭ ভাগে। শিক্ষার সুবিধাবঞ্চিত গরিব ও মেধাবী ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট আইন, ২০১২ প্রণয়ন করা হয়েছে, গঠন করা হয়েছে ‘শিক্ষাসহায়তা ট্রাস্ট’।

স্বাস্থ্যসেবায় সাফল্য

শিশুদের টিকাদান কর্মসূচির সাফল্যের জন্য বাংলাদেশ বিশ্বে অন্যতম আদর্শ দেশ হিসেবে তার স্থান করে নিয়েছে। স্বাস্থ্য খাতকে যুগোপযোগী করতে প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় স্বাস্থ্য নীতিমালা-২০১১’। তৃণমূল পর্যায়ের দরিদ্র মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে গড়ে তোলা হয়েছে ১২ হাজার ৭৭৯টি(১) কমিউনিটি ক্লিনিক। ৩১২টি(২) উপজেলা হাসপাতালকে উন্নীত করা হয়েছে ৫০ শয্যায়। মেডিকেল কলেজ ও জেলা হাসপতালগুলোয় ২ হাজার শয্যা বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার এবং জন্মহার হ্রাস করা সম্ভব হয়েছে উল্লেখযোগ্য হারে। ১৯৯০ সালে নবজাতক মৃত্যুর হার ১৪৯ থেকে নেমে বর্তমানে দাঁড়িয়েছে ৫৩-তে(৩)। স্বাস্থ্যসেবাকে জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্য সামনে রেখে নির্মাণ করা হয়েছে নতুন ১২টি(৪) মেডিকেল কলেজ, নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ৪৭ হাজারের বেশি জনশক্তি।

নারী ও শিশু উন্নয়নে অর্জন

নারীর সার্বিক উন্নয়নের জন্য প্রণয়ন করা হয়েছে ‘জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতিমালা-২০১১’। নারী শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত চালু করা হয়েছে উপবৃত্তি কার্যক্রম। সমাজের প্রতিটি স্তরে নারী অংশগ্রহণকে নিশ্চিত করতে গৃহীত হয়েছে নানামুখী পদক্ষেপ। প্রযুক্তিজগতে নারীদের প্রবেশকে সহজ করতে ইউনিয়ন ডিজিটাল কেন্দ্রের মতো ইউনিয়নভিত্তিক তথ্যসেবায় উদ্যোক্তা হিসেবে একজন পুরুষের পাশাপাশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে একজন নারী উদ্যোক্তাকেও। ‘জাতীয় শিশুনীতি-২০১১’ প্রণয়নের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হয়েছে শিশুদের সার্বিক অধিকারকে। দেশের ৪০টি জেলার সদর হাসপাতাল এবং ২০টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্থাপন করা হয়েছে ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেল। দুস্থ্, এতিম, অসহায় পথশিশুদের সার্বিক বিকাশের জন্য স্থাপন করা হয়েছে ১৫টি শিশু বিকাশ কেন্দ্র। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে দেশের নারী ও শিশুর উন্নয়নে ভূমিকা রাখার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ভূষিত করা হয়েছে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ অ্যাওয়ার্ডে।

নারীর ক্ষমতায়নে অর্জন

নারী বঞ্চনার তিক্ত অতীত পেরিয়ে বাংলাদেশ নারীর ক্ষমতায়নে অনেক দূর এগিয়েছে। পোশাকশিল্পে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ দেশ। আর এই শিল্পের সিংহভাগ কর্মী হচ্ছে নারী। ক্ষুদ্র ঋণ বাংলাদেশে গ্রামীণ উন্নয়নে ও নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব অবদান রেখেছে। আর ক্ষুদ্র ঋণ গ্রহীতার মধ্যে ৮০ ভাগের বেশি নারী। বাংলাদেশ সরকার নানাভাবে নারী উদ্যোক্তাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে এসেছে।

ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠন

ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবতায় রূপ দিতে সরকার নিয়েছে যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ। দেশের তৃণমূল পর্যায়ে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে সরকারি সেবা পৌঁছে দেওয়ার অভিপ্রায়ে দেশের ৪ হাজার ৫৫০টি ইউনিয়ন পরিষদে স্থাপন করা হয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার। তৈরি করা হয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিশাল ন্যাশনাল ওয়েব পোর্টাল। কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত এ পোর্টালের সংখ্যা প্রায় ২৫ হাজার। দেশের সবকটি উপজেলাকে আনা হয়েছে ইন্টারনেটের আওতায়। টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে নেওয়া বিভিন্ন পদক্ষেপের কারণে বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১২ কোটি ৩৭ লাখ(১) এবং ইন্টারনেট গ্রাহকের সংখ্যা ৪ কোটি ৪৬ লাখে(২) উন্নীত হয়েছে। সেবা প্রদান প্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছ করতে চালু করা হয়েছে ই-পেমেন্ট ও মোবাইল ব্যাংকিং। সরকারি ক্রয় প্রক্রিয়া অনলাইনে সম্পাদন করার বিষয়টিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। থ্রি-জি প্রযুক্তির মোবাইল নেটওয়ার্কের বাণিজ্যিক কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে।

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন

কৃষি খাতে অভূতপূর্ব কিছু সাফল্যের জন্য বিশ্বদরবারে বাংলাদেশ বারবার আলোচিত হয়েছে। ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশ বর্তমানে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত বছরগুলোয় বাংলাদেশে ধানের উৎপাদন বেড়েছে প্রায় ৫০ লাখ মেট্রিক টন। প্রধানমন্ত্রী ও কৃষিমন্ত্রীর সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশের বিজ্ঞানী ড. মাকসুদুল আলম আবিষ্কার করেছেন পাটের জিনোম সিকোয়েন্সিং। সারা বিশ্বে আজ পর্যন্ত মাত্র ১৭টি উদ্ভিদের জিনোম সিকোয়েন্সিং হয়েছে, তার মধ্যে ড. মাকসুদ করেছেন তিনটি। তাঁর এ অনন্য অর্জন বাংলাদেশের মানুষকে করেছে গর্বিত।

প্রবাসী শ্রমিকদের উন্নয়নে অর্জন

বর্তমানে বিশ্বের ১৫৭টি দেশে বাংলাদেশের ৮৬ লাখের অধিক শ্রমিক কর্মরত আছেন। বিদেশে শ্রমিক প্রেরণ প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। স্বল্প সুদে অভিবাসন ঋণ প্রদানের লক্ষ্যে প্রবাসীকল্যাণ ব্যাংক স্থাপন করে দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে এর শাখা স্থাপন করা হয়েছে। এই ব্যাংকের মাধ্যমে এপ্রিল, ২০১৪ পর্যন্ত ২০ কোটি ৫০ লাখ টাকা অভিবাসন ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায় থেকে বিদেশ গমনেচ্ছু জনগণকে রেজিস্ট্রেশন করা হয়েছে ফলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণকেও এ সেবা গ্রহণের আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের মাধ্যমে হয়রানি ছাড়াই স্বল্প ব্যয়ে মালয়েশিয়াসহ অন্য দেশগুলোয় শ্রমিকরা যেতে পেরেছেন।

জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বাংলাদেশ

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনে যোগদানের পর এ পর্যন্ত বিশ্বের ৩৯টি দেশের ৬৪ শান্তি মিশনে খ্যাতি ও সফলতার সঙ্গে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। এযাবৎকালে জাতিসংঘ শান্তি মিশনে বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণকারী ১১৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সবার ওপরে।

                লেখক : সাবেক মন্ত্রী।

সর্বশেষ খবর