রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের জীবনে মেরাজ অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পার্থিব জীবনের অভিভাবক চাচা আবু তালিবের ইন্তেকাল, প্রিয়তমা স্ত্রী খাদিজা (রা.) -এর বিয়োগ, তায়েফের হৃদয়বিদারক ঘটনা, মক্কার কাফেরদের অমানবিক আচরণ, নির্যাতনসহ বিভিন্ন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় যখন সবদিক থেকে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মারাত্মক সংকট ও শোকের সম্মুখীন হয়েছিলেন, তখনই আল্লাহতায়ালা তাঁর প্রিয়তম হাবিবকে সান্ত্বনা হিসেবে তাঁর সান্নিধ্য প্রদান করে ধন্য করেন। তা-ই মেরাজ। মেরাজের ব্যাপারে উম্মতের সবচেয়ে বড় করণীয় হলো মেরাজের সত্যতায় বিশ্বাস করা। তারপর মেরাজে ফরজ হওয়া পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ সারা জীবন গুরুত্বের সঙ্গে আদায় করা। কেননা রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজ থেকে উম্মতের জন্য যা নিয়ে এসেছেন তা হলো নামাজ। এরপর প্রত্যেক মুমিনের কর্তব্য হলো মেরাজের অন্যান্য শিক্ষা, যেগুলো রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে মেরাজে দেখানো হয়েছে এবং সূরা ইসরায় বর্ণিত হয়েছে সেগুলোর ওপর আমল করা। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মেরাজ থেকে ফিরে এলে সূরা বনি ইসরাইলের (সূরা ইসরা) মাধ্যমে কয়েকটি শিক্ষা মানুষের কাছে পেশ করেন। ১. আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করা যাবে না। মেরাজেও রসুল এ-সংক্রান্ত একটি ঘটনা দেখেন। মেরাজের এক পর্যায়ে রসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর ঘ্রাণ পেতে থাকেন। এ ঘ্রাণ সম্পর্কে জিবরাইলের কাছে জানতে চাইলে হজরত জিবরাইল (আ.) বলেন, ‘এ হলো ফিরাউনের কন্যার চুল আঁচড়ানো দাসী ও তার সন্তানদের সুগন্ধ। দাসীটি ছিল ইমানদার। চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে একবার চিরুনি পড়ে যায়। সে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে তা তুলে নেয়। ফিরাউনকন্যা বলে, আমার পিতার নামেই তো কর্ম শুরু করতে হয়। তুমি এ কী বলেছ? দাসীটি বলে, আমি তো তোমার, আমার ও তোমার পিতার প্রভু আল্লাহর নাম নিয়েছি। ফিরাউনের কন্যা বিষয়টি তার পিতাকে জানালে ফিরাউন সেই দাসীকে তাওহিদ (আল্লাহর একাত্মবাদ) ত্যাগ করতে বলে। দাসীটি তা না মানলে ফিরাউন তাকে শাস্তি দিতে অগ্নিকু- তৈরি করে তাকে তাতে পোড়ানোর ভয় দেখায়। দাসীটি তাওহিদের ওপর অবিচল থাকে এবং আল্লাহর সঙ্গে শিরক না করে আগুনকে বরণ করে নেয়। হজরত জিবরাইল বলেন, এ হলো সেই দাসীর জান্নাতের সুঘ্রাণ। ২. পিতা-মাতার সঙ্গে ভালো আচরণ করতে হবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘মা-বাবার সঙ্গে ভালো আচরণ কর। তাদের একজন বা দুজন যদি তোমাদের সামনে বৃদ্ধ অবস্থায় উপনীত হয় তাহলে তাদের সঙ্গে উফ শব্দটিও উচ্চারণ কোরো না।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৩। ৩. আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দিয়ে দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘আত্মীয়স্বজনকে তাদের অধিকার দাও। আর মুসাফিরদের হক আদায় কর।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬। ৪. অপব্যয় করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘কিছুতেই অপব্যয় কোরো না। নিশ্চয়ই অপব্যয়কারীরা শয়তানের ভাই।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ২৬-২৭। ৫. সন্তানদের হত্যা করা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘দারিদ্র্যের ভয়ে তোমাদের সন্তানদের হত্যা কোরো না। তাদের এবং তোমাদের আমিই জীবনোপকরণ দিয়ে থাকি। নিশ্চয়ই তাদের হত্যা করা মারাত্মক অন্যায়।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩১। ৬. ব্যভিচারের কাছেও যাওয়া যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘আর ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চই এটা অশ্লীল কাজ ও মন্দ পথ।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩২। ৭. এতিমের সম্পদের ব্যাপারে কঠোরভাবে সতর্কতা অবলম্বন। আল্লাহ বলেন, ‘এতিমের মালের কাছেও যেও না। একমাত্র তার কল্যাণাকাক্সক্ষা ছাড়া...।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৪। ৮. যে বিষয়ে জ্ঞান নেই সে বিষয়ে মতামত দেওয়া অন্যায়। চোখ, কান এবং অন্তর সবকিছুর ব্যাপারেই আল্লাহর কাছে জবাব দিতে হবে। আল্লাহ বলেন, ‘যে বিষয়ে তোমার কোনো জ্ঞান নেই তার পেছনে পোড়ো না...।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৬। ৯. জমিনে দম্ভসহকারে চলা যাবে না। আল্লাহ বলেন, ‘পৃথিবীতে দম্ভভরে পদচারণ কোরো না। নিশ্চয়ই তুমি তো ভূপৃষ্ঠকে কখনোই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় কখনো পর্বতসমান হতে পারবে না।’ সূরা বনি ইসরাইল, আয়াত ৩৭। এ ১৪ দফাই মেরাজের প্রকৃত শিক্ষা। এগুলো বাস্তবায়ন করলেই একজন মুমিন জান্নাতের দিকে অগ্রসর হবে।
লেখক : খতিব, বাইতুশ শফীক মসজিদ
বোর্ডবাজার (আবদুল গনি রোড), গাজীপুর।