শিরোনাম
সোমবার, ১৬ নভেম্বর, ২০২০ ০০:০০ টা

ছুটির দিনে বই

হোসেন আবদুল মান্নান

শাহবাগের পাঠক সমাবেশ কেন্দ্রের মূল স্টলে অর্থাৎ আজিজ মার্কেটের নিচতলা সংলগ্ন স্থানটিতে বেশ কজন লেখক ও পাঠক দাঁড়িয়ে গল্প করছেন। একজনের হাতে এইমাত্র ‘প্রথমা’র স্টল থেকে নেওয়া অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের ‘কাল নিরবধি’। বইটি যার হাতে তিনি বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসের একজন সিনিয়র কর্মকর্তা। আলাপের ভিতর আমি বললাম, স্যার বইটি একটু দেখতে পারি? কোনো শব্দ না করে তিনি সঙ্গে সঙ্গে আমাকে দিয়ে দিলেন। সবাই তখন আলোচনায় ব্যস্ত। বইটি হাতে নিয়ে পৃষ্ঠা উল্টোতেই আমি চমকে উঠি। উৎসর্গপত্রেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেশ দুর্লভ একটি কবিতার দুটো চরণ : ‘আকাশে তো আমি রাখি নাই, মোর/উড়িবার ইতিহাস।/তবু, উড়েছিনু এই মোর উল্লাস’।

‘কাল নিরবধি’ প্রথম প্রকাশ ফেব্রুয়ারি ২০০৩ সালে। এর চতুর্থ মুদ্রণ বের হয় ২০১৯। প্রকাশক মফিদুল হক, সাহিত্য প্রকাশ। বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা ৫৪৩। এটি সম্পূর্ণ স্মৃতি রোমন্থন করা অতীতের ঝলমলে রৌদ্রময় দিনগুলোর বৃত্তান্তবিশেষ রচনা। লেখাগুলো প্রথম আলোর সাহিত্য সাময়িকীতে ধারাবাহিকভাবে ১৯৯৭-১৯৯৮ সালে প্রকাশিত হয়। ২০০৯ সালের সেদিন থেকেই রবি ঠাকুরের কবিতার এ লাইন দুটো আমি অবচেতন মনে প্রায়ই উচ্চারণ করি। পরে জেনেছি, কবির প্রথম প্লেনে চড়ার অভিজ্ঞতাতেই নাকি এমন একটি কবিতা আছে। যা ১৯২৭ সালে লেখা ‘লেখন’ কাব্যের অন্তর্ভুক্ত একটি কবিতার অংশ।

মানুষের স্মৃতি রোমন্থনের শক্তি কত প্রবল, কত সতেজ এবং প্রাণবন্ত তাঁর কাল নিরবধি ছাড়াও ‘আমার একাত্তর’ বা ‘বিপুলা পৃথিবী’ না পড়লে পাঠক এ বিস্ময়কর সৃষ্টির সন্ধান পাবেন না। তাঁর কাল নিরবধিতে পঞ্চাশের দশকের ঢাকা শহরের রাস্তাঘাটের অপূর্ব সুন্দর বর্ণনাসহ লেখকের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, হল জীবন, ভাষা আন্দোলনের পটভূমি ও ফেব্রুয়ারি মাসের দিনলিপি, ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অসংখ্য স্বনামধন্য শিক্ষক সম্পর্কে অজানা তথ্য, ঢাকার শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির আদ্যপান্ত ইতিহাস, হক-সোহরাওয়ার্দী-ভাসানীর রাজনীতি ও নানা বিষয় চমৎকার ব্যঞ্জনায় উঠে আসে। যা এক কথায় অতুলনীয় এবং অননুকরণীয় কাহিনির বিন্যাস।

এই ভাষাবিদ, পন্ডিত, সংবিধানের অনুবাদক, স্বাধীনচেতা এবং প্রখর ব্যক্তিত্ববান শিক্ষকের বই ‘আমার একাত্তর ‘পড়ে আমি তাঁর প্রতি আরও গভীর ভাবে অবনতচিত্ত হই। বইটি বছর দেড় আগে চট্টগ্রামের আলোচিত বাতিঘর থেকে সংগ্রহ করি। দাফতরিক কাজের ফাঁকে মাসে অন্তত একবার বই দেখার নিমিত্ত সেখানটায় আমার আকস্মিক সফর হতো। মাঝারি সাইজের ২০০ পৃষ্ঠার একটি বই। আমি কয়েক রাত একটানা পড়ে যাই। মুক্তিযুদ্ধের সময় তাঁর সহচর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ভাইস চ্যান্সেলর ড. এ আর মল্লিককে তিনি তা উৎসর্গ করেন। বইয়ে ১৯৬৯ সালের শুরু থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হিসেবে গণঅভ্যুত্থান পর্বে তার সাংগঠনিক তৎপরতা, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড, শিক্ষক সমিতির ভূমিকা, প্রতিবাদ, প্রতিরোধসহ বিশিষ্টজনের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি গমন, সহকর্মীদের উদ্বুদ্ধকরণসহ নানা বিচিত্র বিষয়ে স্থান, কাল, পাত্রের নিরিখে অসামান্য সমাহার ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের এত বড় মাপের বুদ্ধিজীবী সংগঠক দেশে আর কজন অবশিষ্ট আছেন জানি না।

জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মৃতিধর্মী প্রায় সব লেখায় পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে, বাঙালির কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, তাঁর সময়ের জাতীয় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি, তাঁর সহকর্মীদের সঙ্গে দেশ বিদেশে ভ্রমণ, শিক্ষা সংস্কৃতি, ছাত্র রাজনীতি, শিক্ষক রাজনীতি, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, মহান ও কীর্তিমান মানুষের সঙ্গে সাক্ষাৎ, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন এ সবই স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে উঠে আসে। তাঁর ভাষা ব্যবহার রীতি ও অনুসৃত কৌশল ছিল অনন্য ও অনুসরণযোগ্য। তাঁর একাধিক বই ও লেখা কলকাতা, লন্ডন ও টোকিও থেকে প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তা, গবেষক, ভিজিটিং ফেলো ও প্রফেসরের দায়িত্বও পালন করেছেন। জীবদ্দশায় তিনি দেশে বিদেশে অসংখ্য নাম-যশ খ্যাতি, পুরস্কার, স্বীকৃতি লাভ করেছেন।

গর্ববোধ করি, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি শিক্ষক ছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আসার পর আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশব্যাপী জনসংযোগ করার একপর্যায়ে চট্টগ্রাম সফরে গিয়ে তিনি তাঁর শিক্ষকের খোঁজ নেন। এমনকি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অবস্থিত এ শিক্ষকের বাসায় হাজির হয়ে তাঁর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করে আসেন। সম্প্রতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী সিদ্দিকা জামানের ‘আমার বিপুলা পৃথিবী’ শিরোনামে ধারাবাহিক লেখায় এমন অনেক তথ্য রয়েছে।

ভারত সরকার থেকে পদ্মভূষণ এবং ১৪২৩ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইয়ের জন্য কলকাতার আনন্দ পুরস্কার লাভ স্মরণীয়। বিপুলা পৃথিবী ৫৭৫ পৃষ্ঠার বই। প্রথমা প্রকাশন বের করে ২০১৫ সালে। পরবর্তী দুই বছরে বইটির পঞ্চম মুদ্রণ প্রকাশিত হয়। এটি তাঁর আত্মজীবনীমূলক বই। বইয়ের হননের কাল অংশে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যাকান্ডের ওপর এবং এমন হৃদয়বিদারক ঘটনার চাক্ষুষ বিবরণ রয়েছে। পৈশাচিক এ হত্যাকান্ডের অব্যবহিত পরে সারা দেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থাসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতির নাটকীয় পরিবর্তনও বিশদভাবে তুলে ধরেছেন। উল্লেখ করেছেন, ১৯৮০ সালে অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে দিল্লিসহ বিভিন্ন স্থানে সফর করার কথা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্মলগ্নে অধ্যাপক রাজ্জাক স্যারের সরাসরি শিক্ষক ছিলেন প্রফেসর অমিয় দাসগুপ্ত। যিনি ১৯৪৬ সালে অধ্যাপনা শেষ করে ভারতে পাড়ি জমান। দীর্ঘ সময় পর এই গুরু-শিষ্যের মহামিলনের দৃশ্য অভূতপূর্ব বাক্যবিন্যাসে চিত্রায়িত করেছেন তিনি। একজন দেশপ্রেমিক, বিদগ্ধ, পরমতসহিষ্ণু, মননশীলতা চর্চাকারী, আপাদমস্তক শিক্ষকের প্রতিকৃতি ছিলেন তিনি। তাঁর যাপিত জীবনকে সামনে মেলে ধরে এক প্রতীকী নিখুঁত শিক্ষকের ছবি আঁকা যায়। এখন আমাদের চারপাশে নিবিড়ভাবে চোখ রাখলে সহজেই বোঝা যায়, এ রুচিবান আদর্শের মানুষগুলো ক্রমাগত কালের অদৃশ্য অতল গহ্বরে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছেন।

          ►      লেখক : গবেষক ও গল্পকার।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর