বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমার প্রিয় চরিত্রের একজন ওবায়দুল কাদের। কেন প্রিয় তার অনেক যৌক্তিক কারণ আছে। সবচেয়ে ছোট কারণটি বলি। রাজনীতির পাশাপাশি ওবায়দুল কাদের পেশাদার সাংবাদিকতাও করেছেন। দৈনিক বাংলার বাণীর সহকারী সম্পাদক ছিলেন। একজন পেশাদার সাংবাদিক আজ রাজনীতির শীর্ষ আসনে পৌঁছেছেন, তাঁর প্রতি একটু বাড়তি পক্ষপাত তো থাকতেই পারে। এটাকে আপনারা স্বজনপ্রীতিও বলতে পারেন। তবে তাঁকে ভালোবাসার আরও অনেক কারণ আছে।
রাজনীতিতে তিনি উড়ে এসে জুড়ে বসা কেউ নন। ছাত্রজীবন থেকে ধাপে ধাপে আজ শীর্ষে পৌঁছেছেন। ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগের সুখের পাখি নন, বরং চরম দুঃসময়ে হাল ধরা পরীক্ষিত সৈনিক। ’৭৫-এর পর দলের চরম দুঃসময়ে যখন নেতাদের হারিকেন দিয়ে খুঁজেও পাওয়া যায়নি, কর্মীরা ভয়ে আড়ালে; তখনো ওবায়দুল কাদের ছাত্রলীগকে সংগঠিত করেছেন। ’৭৫-এর পর প্রায় তিন বছর কারাগারে ছিলেন। কারাগারে থেকেই তিনি ছাত্রলীগের সভাপতির দায়িত্ব পেয়েছেন। ’৭৫-এর পর যখন আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলে দিনের পর দিন, তখনো ওবায়দুল কাদের হাল ছাড়েননি, মাঠ ছাড়েননি। পরপর দুবার ছাত্রলীগের মনোনয়নে ডাকসুর ভিপি পদে নির্বাচন করেছেন। অবশ্য দুবারই হেরেছেন। তখন ছাত্রলীগের হয়ে নির্বাচন করাটাই বড় কথা, জয়-পরাজয় নয়। তারা তখন মাটি কামড়ে পড়ে ছিলেন বলেই আজ আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। কিন্তু ওবায়দুল কাদের যে দুজনের কাছে হেরেছিলেন সেই মাহমুদুর রহমান মান্না ও আখতারুজ্জামান আজ বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রায় ঝরে যাওয়া তারা। আর তখন হেরে যাওয়া ওবায়দুল কাদের আজ উজ্জ্বল নক্ষত্র। নিষ্ঠা আর সততার সঙ্গে লেগে থাকলে, আদর্শে অটল থাকলে ফল যে মেলে তার প্রমাণ ওবায়দুল কাদের।
তাঁকে পছন্দ করার আরেকটি কারণ তাঁর প্রজ্ঞা। ছাত্ররাজনীতি মানেই মাস্তানি- এ ধারণা ভেঙে দিয়েছেন অনেক আগেই। তিনি পড়াশোনা করেন এবং লেখালেখিও করেন। তাঁর লেখার ক্ষেত্র রাজনীতি থেকে সৃজনশীল সাহিত্য পর্যন্ত। তাঁর উপন্যাস থেকে সিনেমাও বানানো হয়েছে। তিনি কথা বলেন গুছিয়ে, যুক্তি দিয়ে। তাঁর আক্রমণেও থাকে কাব্যের ছোঁয়া।দুঃসময়ে ছাত্রলীগের হাল ধরার প্রতিদান পেয়েছেন, আজ দলের সুসময়েও আওয়ামী লীগের হাল ওবায়দুল কাদেরের হাতেই। টানা দুই মেয়াদে ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। কখনো কখনো আমার মনে হয় বিরোধী দলের নেতৃত্ব দেওয়ার চেয়ে সরকারি দলের নেতৃত্ব দেওয়া বরং অনেক কঠিন। কারণ ক্ষমতার স্রোতে ভেসে অনেক কচুরিপানাও চলে আসে দলে, যা দলের প্রবহমানতাকে আটকে দেয়। তাই এ কচুরিপানা পরিষ্কার রেখে দলকে সচল রাখা বেশ কঠিনই বটে।
এ কঠিন কাজটিই ওবায়দুল কাদের করে যাচ্ছেন বছরের পর বছর। বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বড় সমালোচকের নাম কী? আমাকে কেউ এ প্রশ্ন করলে আমি বলব, ওবায়দুল কাদের। তিনি যে ভাষায় ছাত্রলীগ, আওয়ামী লীগের সমালোচনা করেন শুনলে আমারই ভয় লাগে। ওবায়দুল কাদের না বলে অন্য কেউ বললে তার বাংলাদেশে থাকাই দায় হতো। যাত্রায় যেমন বিবেক থাকে, ওবায়দুল কাদেরকে আমার তেমনি আওয়ামী লীগের বিবেক মনে হয়। হাইব্রিড আওয়ামী লীগারদের ‘কাউয়া’ নামে ডাকা শুরু করেছেন তিনিই। তবে মুখে বললেও আওয়ামী লীগে অনুপ্রবেশকারী হাইব্রিড, কাউয়ার স্রোত ঠেকাতে পারেননি। হয়তো পুরোটা ঠেকানো তাঁর পক্ষে সম্ভবও নয়। তবে নিজে যেহেতু ছাত্রলীগের দুঃসময়ের কা-ারি, তাই তিনি নিশ্চয়ই সেই সময়ের ত্যাগী নেতা-কর্মীদের চেনেন। তাদের খুঁজে এনে দায়িত্ব দিতে পারেন। হাইব্রিডদের আগ্রাসন ঠেকাতে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো ত্যাগী নেতা-কর্মীরা।
শুধু দল নয়, সরকারেরও সবচেয়ে ভাইব্র্যান্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব ওবায়দুল কাদেরের কাঁধে। গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে সড়ক ও সেতু খাতে যে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে তার কৃতিত্বও অনেকটাই ওবায়দুল কাদেরের। বাংলাদেশের অনেক সড়ক দেখলে চট করে বিভ্রম সৃষ্টি হয়, বাংলাদেশেই আছি তো! একসময় তিনি রাস্তায় হেঁটে হেঁটে সড়কে শৃঙ্খলা আনার কাজ করতেন। বিআরটিএসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ওবায়দুল কাদেরের ‘সারপ্রাইজ ভিজিট’ দুর্নীতি কমাতে দৃশ্যমান অবদান রেখেছে। অনেকে তখন ওবায়দুল কাদেরকে ‘হাঁটা বাবা’, ‘ফাটাকেষ্ট’ বলে টিপ্পনী কাটতেন। কিন্তু আমি বরাবরই ওবায়দুল কাদেরের এ ‘ডাইরেক্ট অ্যাকশন’-কে সমর্থন করেছি। ২০১৯ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা তাঁর এ গতি কিছুটা মন্থর করে দিয়েছে। অনেকেই ভেবেছিলেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণ থেকে ফিরে আসা ওবায়দুল কাদের হয়তো নিজেকে কিছুটা গুটিয়ে নেবেন। কিন্তু হয়েছে উল্টো। এখনো আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সক্রিয় নেতার নাম ওবায়দুল কাদের। তাঁর পূর্বসূরি সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম যেখানে কালেভদ্রে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলতেন সেখানে ওবায়দুল কাদের প্রায় প্রতিদিন একাধিক অনুষ্ঠানে হাজির থাকেন। এমনকি করোনাকালেও ওবায়দুল কাদের প্রতিদিন বাসা থেকে বিভিন্ন বিষয়ে দল ও সরকারের অবস্থান নিয়ে কথা বলছেন। তাঁর নিয়মিত ব্রিফিংয়ের প্রধান টার্গেট প্রায় আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাওয়া বিএনপি। এমনও বলা হয়, ওবায়দুল কাদেরই বিএনপিকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। তিনি প্রতিদিন নাম না নিলে বিএনপি মিডিয়া থেকেও হারিয়ে যেত।
তবে বিএনপিকে প্রধান প্রতিপক্ষ না বানিয়ে ওবায়দুল কাদেরের এখন ঘরে তাকানোর সময় এসেছে। ঘরে মানে একদমই ঘরে। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জের বসুরহাট পৌরসভা নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত মেয়র প্রার্থী আবদুল কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদেরের আপন ছোট ভাই। ১৬ জানুয়ারি এ পৌরসভার নির্বাচন। কিন্তু ওবায়দুল কাদেরের ছোট ভাইয়ের শঙ্কা নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া নিয়ে। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে ৩ জানুয়ারি তিনি বসুরহাটে দিনভর বিক্ষোভ করেন। বেলা ১১টার দিকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচির কারণে পৌর এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। বন্ধ হয় দোকানপাটও। বিকাল ৫টার দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। আমি শুধু ভাবছি, যদি ওবায়দুল কাদেরের ভাই এবং আওয়ামী লীগ নেতা না করে বিএনপির কেউ বসুরহাট পৌর সদর দিনভর অচল করে রাখার চেষ্টা করতেন তাহলে কী হতো। কর্মসূচি চলাকালে আবদুল কাদের মির্জা ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রীসহ দলের একাধিক সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন। কর্মসূচি চলাকালে আবদুল কাদের মির্জা বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জনগণের ভাতের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন, কিন্তু ভোটের অধিকার এখনো প্রতিষ্ঠা হয়নি। দুর্নীতি, টেন্ডারবাজি বন্ধ হয়নি। তাই সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে ভোট অনুষ্ঠানের নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি অবস্থান কর্মসূচিতে অনড় থাকবেন। আমি ঠিক বুঝতে পারছি না আবদুল কাদের মির্জা কার কাছে বিচার চাইলেন, কার কাছে সুষ্ঠু নির্বাচন চাইলেন? ওবায়দুল কাদের কি তাঁর ভাইয়ের দাবির সঙ্গে একমত? তিনি কি এখন ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁর আপন ভাইয়ের আন্দোলনে পাশে থাকবেন? সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে রাস্তায় নামার আগে আবদুল কাদের মির্জা ৩১ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে দলের এমপিদের জনপ্রিয়তা নিয়েও সংশয় প্রকাশ করেন। তাঁর দাবি, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে নোয়াখালীর এমপিরা পালানোর দরজা খুঁজে পাবেন না।
ওবায়দুল কাদেরের নিজের ভাইয়ের ধারণা যদি এই হয়, নিজের জেলার এমপিদের অবস্থা যদি এই হয় তাহলে সারা বাংলাদেশের অবস্থা কী? আমি অনুরোধ করছি, অন্য কোনো ব্যক্তি বা দলের দিকে আঙুল তোলার আগে ওবায়দুল কাদের যেন নিজের ভাইয়ের বক্তব্য এবং দলের সত্যিকারের অবস্থা যাচাই করেন। দাবি বলেন আর আবদার; বড় ভাই হিসেবে ওবায়দুল কাদেরের দায়িত্ব হলো আবদুল কাদের মির্জার কথা মেনে নেওয়া। আর তাঁর আবদার খুব অন্যায়ও নয়। আবদুল কাদের মির্জা স্রেফ সুষ্ঠু নির্বাচন চেয়েছেন। ওবায়দুল কাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়ে দলের শক্তির প্রমাণ দিতে পারেন, জনপ্রিয়তা যাচাই করতে পারেন। আর নোয়াখালীর এমপিদের জনপ্রিয়তা নিয়ে আবদুল কাদের মির্জার দাবি যদি ওবায়দুল কাদের যাচাই ছাড়াই বিশ্বাস করেন তাহলে তাঁর উচিত হবে দলের সব এমপিকে জনগণের কাছে যেতে বাধ্য করা। কারণ শুধু নোয়াখালী নয়, সরকারি দলের অধিকাংশ এমপিই জনবিচ্ছিন্ন। যেহেতু নির্বাচনে জয়ের চিন্তা নেই মাথায় তাই তারা একেকজন নিজ নিজ এলাকায় একক রাজত্ব কায়েম করেছেন। জনবিচ্ছিন্ন এই এমপিদের কারণে যেন গত এক যুগে আওয়ামী লীগ সরকারের সব উন্নয়ন, শেখ হাসিনা এবং ওবায়দুল কাদেরের সব চেষ্টা মাঠে মারা না যায়।
লেখক : সাংবাদিক।