মঙ্গলবার, ১৯ জানুয়ারি, ২০২১ ০০:০০ টা

বঙ্গবন্ধুর পদতলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র প্রদান দিবস

বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম

বঙ্গবন্ধুর পদতলে কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র প্রদান দিবস

একদিকে স্বাধীনতা অন্যদিকে অস্ত্র জমাদানের ৫০ বছর। আবার নেতা ও পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী। আমাদের ব্যস্ততার শেষ ছিল না। ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু অস্ত্র নিতে টাঙ্গাইল আসবেন আমরা সব দিক থেকে প্রস্তুত হচ্ছিলাম। পিতার হাতে অস্ত্র তুলে দেওয়া, আসা-যাওয়ায় তাঁর নিরাপত্তা সবকিছু নিখুঁতভাবে যাতে হয় তার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চলছিল কাদেরিয়া বাহিনীর। কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার ফজলুর রহমান, জাহাজমারা কমান্ডার হাবিব বীরবিক্রম, মেজর হাকিম বীরপ্রতীক, মেজর লোকমান, ক্যাপ্টেন সবুর বীরবিক্রম, কমান্ডার লাল্টু, ক্যাপ্টেন মোস্তফা বীরপ্রতীক, ক্যাপ্টেন ফজলুল হক বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকের কোনো বিশ্রাম ছিল না। রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা মনে হয় ২৪ মিনিটের মতো চলে যাচ্ছিল। নতুন দেশ সবার মধ্যে চরম উত্তেজনা, অন্যদিকে স্বাধীনতার আগেই কাদেরিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে পাহাড়সমান ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হয়েছিল। আমাকে মেরে ফেলার চেষ্টা হচ্ছিল নিরন্তর। পাকিস্তানিরা যে কাজটি করতে পারেনি তা-ই করার জন্য বিরোধী গ্রুপ ছিল দুর্বার সক্রিয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে কোনো বিরোধী দল ছিল না, সব ছিল ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগ। তাদের বিরোধী গ্রুপই ছিল আমার শত্রু বা জানি দুশমন। যদিও তাদের জন্য আমাকে কখনো ভাবতে হয়নি। যুদ্ধ চলাকালে জুলাই-আগস্টের মানকারচর মহেন্দ্রগঞ্জের পাশে মামা-ভাগিনার টিলায় ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা বারবার মিটিং করছিল কী করে কাদেরিয়া বাহিনীর প্রধান কাদের সিদ্দিকীকে হত্যা করা যায়। এমন এক মিটিংয়ে যুবনেতা আবদুর রাজ্জাক এমপি উপস্থিত ছিলেন। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা শুনে তিনি বলেছিলেন, ‘এখন কাদেরকে হত্যার চিন্তা মন থেকে ঝেড়েপুঁছে ফেল। হানাদারদের পরাজিত করার বুদ্ধি ও কলাকৌশল নিয়ে চিন্তা কর।’ তার পরও কেউ কেউ গলা খুলে চেঁচামেচি করছিল। জননেতা রাজ্জাক বলেছিলেন, ‘চিৎকার করা সোজা, ভালো কাজ করা সোজা নয়। আর যা নিয়ে আলোচনা করছ তা করা খুবই কঠিন। আর যা করতে চাচ্ছ তা করা বড়ই কঠিন। পাকিস্তানি হানাদাররা কি কাদেরকে চুমা খেতে চায়? নাকি পেলে হত্যা করবে? পাকিস্তানি হানাদাররাই যেখানে তার পশম স্পর্শ করতে পারছে না, তোমরা কী করবে? এসব বন্ধ কর। স্বাধীনতার জন্য মনপ্রাণ ঢেলে যুদ্ধ কর। হানাদারমুক্ত দেশে যা করতে চাও পারলে করবে।’ তেমন কেউ শুনতে চায়নি। আরও খলবল কলবল করছিল। তখন রাজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, ‘মারতে হলে তো কাদেরের কাছে পৌঁছতে হবে। যেখানে হানাদাররাই পৌঁছতে পারছে না সেখানে তোমরা পৌঁছবে কী করে?’ অপদার্থ বিরোধী নেতাদের চেষ্টা তাতে বন্ধ হয়নি। তারা অনেক ফন্দি-ফিকির করেছে। কিন্তু আল্লাহ আজও আমায় বাঁচিয়ে রেখেছেন। সবই তাঁর মহিমা। এত কিছুর পরও বিরোধী শাজাহান সিরাজের গ্রুপের অনেক নেতা-কর্মী কাদেরিয়া বাহিনীতে যোগ দিয়েছিল। যারা মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে আমার রক্ত-মাংস চিবিয়ে খেত তারা যুদ্ধের সময় বুঝতেও পারেনি কোনো দিন তারা আমার শত্রু ছিল। সেই মুক্তিযোদ্ধাদের যারা এখনো বেঁচে আছে, তারা শাজাহান সিরাজকে বা আমার বিরোধী নেতাদের শ্রদ্ধা করলেও আমাকে ভীষণ ভালোবাসে। তাদের অনেককে আমার নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েও নিশ্চিত থেকেছি।

২৪ জানুয়ারি রবিবার অস্ত্র জমাদানের অর্ধশত বর্ষপূর্তি উপলক্ষে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ টাঙ্গাইল জেলা শাখা একটি অনুষ্ঠান করার প্রস্তুতি নিয়েছে। তাদের দাবি, ২৪ জানুয়ারি জাতীয় দিবস ঘোষণা করা হোক। আমি এসব নিয়ে এখন আর তেমন মাথা ঘামাই না। কর্মীদের ভালো কাজে সব সময় উৎসাহ দিই এবং সহযোগিতা করি। নেতা-কর্মীরা যখন বারবার আমার উপস্থিতি কামনা করছিল তখন তাদের বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করেছি, ওই অনুষ্ঠানে আমার যাওয়া উচিত না। তা ছাড়া করোনায় আক্রমণের সময় আমি কোনো সভা-সমাবেশে যেতে চাই না। আমাকে ছাড়া সবাইকে নিয়ে অনুষ্ঠান করলে তোমরা প্রচুর লাভবান হবে। অনুষ্ঠানটা বর্তমান রাজনীতির না হয়ে স্বাধীনতার হলে মুক্তিযুদ্ধের হলে ভালো হবে। এখানে দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির কোনো মূল্য নেই। জাতীয় মনোভাবের মূল্য দিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধে যার যা ভূমিকা তার চাইতেও তাদের বেশি মর্যাদা দিতে হবে। আমাদের নেতা আবদুল মান্নান, শামসুর রহমান খান শাজাহান, তোফাজ্জল হোসেন মুকুল, বদিউজ্জামান খান কেউ বেঁচে নেই। এখনো দু-চার জন যারা আছেন তাদের সম্পৃক্ত করতে পারলে তাদের সম্মান জানালে ভালো হবে, তোমরা উপকৃত হবে। বিশেষ করে লতিফ ভাই, ফজলুর রহমান খান ফারুক, আল মুজাহিদী এদের যুক্ত করা হলে বিষয়টা সুন্দর হবে। আবদুস সবুর খান বীরবিক্রম, আবুল কালাম আজাদ বীরবিক্রম, ফজলুল হক বীরপ্রতীক, খোরশেদ আলম বীরপ্রতীক, আনোয়ার হোসেন পাহাড়ি বীরপ্রতীক, আবদুল্লাহ বীরপ্রতীকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের যথাযথ সম্মান দিলে সেটা যথার্থ হবে। মানুষ যেমন অনেক কিছু ভুলে যায় তেমনি সত্য ও আসল কোনো দিন ভোলে না। শুধু একটু নাড়াচাড়া করতে হয়। আমি আন্তরিকভাবে আশা করি এবং দোয়া করি, যারা ২৪ জানুয়ারি পালনের পদক্ষেপ নিয়েছে তারা যেন সফল হয়।

জীবনে কখনো স্রোতের অনুকূলে চলতে পারিনি, সব সময় প্রতিকূলে চলতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর হাতে অস্ত্র দেওয়াতেও খুব একটা অনুকূল পরিবেশ ছিল না। বঙ্গবন্ধু যেদিন অস্ত্র নিতে টাঙ্গাইল আসেন সেদিন একজন ক্যাবিনেট মন্ত্রীও আসেননি, একজন সচিব না, সেনাবাহিনী-পুলিশ-বিডিআরের কেউ না। সবাই পিতাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করেছিল। সবাই দল বেঁধে বলেছিল, আপনি টাঙ্গাইল গেলে আপনাকে বন্দী করে ক্ষমতা নিয়ে নেবে। নেতা কারও কথা কানে তোলেননি। তিনি তাঁর আত্মবিশ্বাসের ওপর ভর করে এসেছিলেন। নিকটজনের মধ্যে সঙ্গে ছিল দুই ছেলে- শিশু রাসেল ও শেখ জামাল। তা ছাড়া ’৬৯-এর গণআন্দোলনের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদ এবং শেখ শহীদ। আমলা-ফইলা কিছু ছিল। কিন্তু তেমন উল্লেখযোগ্য কেউ নয়। আমরা সেদিন বঙ্গবন্ধুকে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়েছিলাম। প্রায় ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ৪০ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে দ-ায়মান হয়েছিল। এই ৪০ কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে না হলেও ৪-৫ লাখ সাধারণ মানুষ দাঁড়িয়ে ছিল। শিশু থেকে বৃদ্ধা পর্যন্ত কেউ বাদ পড়েনি। পিতা রাস্তায় রাস্তায় সমবেত লোকদের তাঁর কণ্ঠে অভয় বাণী শোনাচ্ছিলেন। এক পাশে আনোয়ারুল আলম শহীদ, আরেক পাশে আমি টয়োটা জিপের পাদানিতে দাঁড়িয়ে ছিলাম। জনতার উৎসাহ-উদ্বেলতা দেখে বঙ্গবন্ধু খুশি হচ্ছিলেন আবার আবেগে চোখের পানি রাখতে পারছিলেন না। আমরা কীভাবে এমন সুসংগঠিত মুক্তিবাহিনী গঠন করলাম জনগণকে উদ্বুদ্ধ করলাম। আমাদের বলার কিছু ছিল না। শুধু বলে চলেছিলাম, সবই আপনার প্রতি সাধারণ মানুষের অফুরন্ত ভালোবাসা। এখানে আমাদের ভূমিকা খুবই কম, খুবই গৌণ।

গোড়াই-মির্জাপুর-জামুর্কী-পাকুল্যা-নাটিয়াপাড়া-করটিয়া-ভাতকুড়া পথে পথে হাজারো মানুষের সামনে তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা মেশানো বক্তৃতা করে টাঙ্গাইল এলেন। শহরের মুখে শিবনাথ হাইস্কুল মাঠে জাহাজমারা কমান্ডার মেজর হাবিব বীরবিক্রমের নেতৃত্বে ১ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধা বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়। গার্ড অব অনার পরিদর্শন করে মঞ্চে ফিরে সমবেত যোদ্ধাদের তিনি বলেন, ‘আমি অস্ত্র দিতে পারি নাই, শুধু হুকুম দিয়েছিলাম। তোমরা পাকিস্তানি হানাদারদের অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়ে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছ। তোমাদের আমি সালাম জানাই, ধন্যবাদ জানাই। তোমরা যে অবদান রেখেছ তোমাদের কথা দেশ সারা জীবন মনে রাখবে। দেশবাসী তোমাদের মাথায় তুলে রাখবে।’ এরপর এলেন বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে। যেখানে থরে থরে অস্ত্র সাজিয়ে রাখা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে এলে কমান্ডার মেজর হাকিম বীরপ্রতীক ৩ হাজার যোদ্ধার প্যারেডকে সজাগ করে আমার একসময়ের ব্যবহৃত পুলিশের ব্যাটাগানটি কাদেরিয়া বাহিনীর প্রশাসক আবু মোহাম্মদ এনায়েত করিমের হাতে এনে দিলে তিনি সটার্ন এগিয়ে আসেন। আমি এগিয়ে গিয়ে তার হাত থেকে অস্ত্রটি নিয়ে ঘুরে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর পায়ের কাছে বিছিয়ে দিই। বঙ্গবন্ধু অভিভূত হয়ে অস্ত্রটি কুড়িয়ে তুলে আনোয়ারুল আলম শহীদের হাতে দেন। আমি তাঁর সামনে মাইক্রোফোন এগিয়ে দিলে তিনি বলেন, ‘না, তুই বল।’ আমার বলার ইচ্ছা ছিল না। একদিকে সত্যিই আনন্দে উদ্বেল ছিলাম, অন্যদিকে মন ছিল ভাঙা চুরমার। কেন যেন অস্ত্রগুলো দিয়ে দিতে বুক ভেঙে খানখান হয়ে যাচ্ছিল।

বলেছিলাম, ‘গত নয় মাস যুদ্ধের ময়দানে বাবা-মা-আত্মীয়স্বজন আমাদের রক্ষা করেনি, করতে পারেনি। এ অস্ত্র হাতে আমরা দেশবাসীকে রক্ষা করেছি। দুর্বার হিংস্র পাকিস্তান হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করেছি। দুষ্টের দমনে শিষ্টের পালনের আশায় আমাদের প্রিয় অস্ত্র আপনার হাতে তুলে দিলাম। দেশবাসী যেন নিরাপদে থাকে, হেফাজতে থাকে।’ বঙ্গবন্ধু আমার কথা শুনে অঝরে কাঁদছিলেন। তাঁর রুমালে চোখ মুছছিলেন। তারপর তাঁর সামনে মাইক্রোফোন দেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘মুক্তিযোদ্ধারা তোমরা যা করেছ পৃথিবীর ইতিহাসে এর নজির নেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অত অল্প সময়ে এত মানুষ মরেনি যা আমার বাংলাদেশে মরেছে। আমি ঘুষখোর অফিসারদের কথা শুনব না, তোমাদের কথা শুনব। যারা লেখাপড়া করতে চাও, যারা কৃষক তারা কৃষিকাজ করবে সরকার সাহায্য করবে। ছাত্রবন্ধুদের সাহায্য করবে। তিন বছর আমি তোমাদের কিছু দিতে পারব না। তিন বছর যুদ্ধ চললে তোমরা যুদ্ধ করতা না?’ সারা মাঠ গর্জে ওঠে- করতাম, করতাম। ‘তাহলে মনে কর যুদ্ধ চলছে। সে যুদ্ধ হবে দেশ গড়ার। তোমাদের কোনো অসুবিধা হলে কাদেরকে বলবে, লতিফকে বলবে, শহীদকে বলবে। ওদের আমি জন্মের পর থেকে চিনি। তোমাদের কথা ওরা আমাকে জানাবে। আমি সাথে সাথে তোমাদের কথা পালন করব।’

এরপর তিনি অস্ত্র পরিদর্শনে আসেন। আমাদের পাশে পাশে লালু-ভুলু চলছিল। লালু ছিল খুবই ছোট। শহিদুল ইসলাম লালু বীরপ্রতীককে কোলে নিয়ে বিদেশি সাংবাদিকদের দেখাচ্ছিলেন, ‘এই আমাদের মুক্তিযোদ্ধা। এরা কাদেরের শক্তি।’ সারা মাঠ ঘুরে ঘুরে অস্ত্র দেখে তিনি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলেন। বারবার বলছিলেন, ‘কাদের, তোরা এ কী করেছিস? এটা কী করে সম্ভব?’ বলেছিলাম, আপনাকে ভালোবেসে, দেশ ও দেশমাতৃকাকে ভালোবেসে আমরা যে সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছি। বিন্দুবাসিনী মাঠ থেকে বঙ্গবন্ধু আসেন পুলিশ প্যারেড ময়দানে ভবিষ্যৎ বাহিনীর সামনে স্থাপন করেন শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর। প্রায় ৬ হাজার কচিকাঁচা বাঁশের-কাঠের লাঠি নিয়ে, কেউ কেউ নানা ধরনের অস্ত্র বানিয়ে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধু তাদের সামনে এসে বললেন, ‘তোমরা ভবিষ্যৎ বাহিনী বানিয়েছ আমি খুশি হয়েছি। ভবিষ্যতে যদি আবার বাঙালি জাতি আক্রান্ত হয় তোমরা যুদ্ধ করবে। জয় বাংলা।’ সারা মাঠ উদ্বেলিত হয়ে উঠেছিল। তাদের আনন্দ আর ধরে না। এরপর পিতা এলেন টাঙ্গাইলে ওয়াপদা ডাকবাংলোয় মুক্তিযুদ্ধের পর যেখানে আমি অনেক দিন ছিলাম। রাস্তায় ধুলোয় জামা-কাপড় ময়লা হয়ে গিয়েছিল। গোসল করে কাপড় বদলে নিচ্ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর কোটে অনেক ধুলো পড়েছিল তা পরিষ্কার করা দরকার। শুধু হাতে নিয়ে তা ভালোভাবে করা যাচ্ছিল না। সে জন্য ড. নুরুন্নবীর গায়ে বঙ্গবন্ধুর মুজিবকোট জড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। নুরুন্নবী ছোটখাটো হলেও অত যে বেটে আমরা ভাবতেও পারিনি। বঙ্গবন্ধুর কোট তার গায়ে চড়ালে কোটটি প্রায় ফ্লোরে লেগে যাচ্ছিল। অনেকেই এ নিয়ে হাসি-তামাশাও করেছিল। যা হোক তৈরি হয়ে বঙ্গবন্ধু নিচে নামতেই রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আঁদ্রে ফোমিন তাঁর দেশের স্বীকৃতি নিয়ে হাজির। তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় টাঙ্গাইল সার্কিট হাউসে। বঙ্গবন্ধুর পাশে বসে দুপুরের খাবার খেয়ে আঁদ্রে ফোমিন চলে যান রাজধানীর পথে। আমরা ছুটি টাঙ্গাইল পার্ক ময়দানে। সেখানে স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জনসভা। টাঙ্গাইলের ইতিহাসে কখনো কোনো সভায় অত জনসমাগম হয়নি। এখন দেশে লোক অনেক। তার পরও আর কখনো অমন জনসমাগম হবে কিনা জানি না। জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আমার তিন শ বছরের টুঙ্গিপাড়া গ্রামের বাড়ি পাকিস্তানি হানাদাররা পুড়ে ছারখার করে দিয়েছে। আমি সেটা দেখতে যাইনি। আমি প্রথম টাঙ্গাইল এসেছি। টাঙ্গাইলের মানুষকে সম্মান জানাতে এসেছি। কাদেরকে, কাদেরিয়া বাহিনীকে ভালোবাসা জানাতে এসেছি। আমি কারও সাথে শত্রুতা চাই না, আমি সবার সাথে বন্ধুত্ব চাই। ভারতকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমার ১ কোটি মানুষকে আশ্রয় দিয়েছে, মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। মহীয়সী নারী ভারতের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অভিনন্দন জানাই। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা জানাই। ভারতের সাথে আমাদের বন্ধুত্ব অম্লান থাকবে।’ একপর্যায়ে বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘কাদের পল্টনে চারজনকে গুলি করে শাস্তি দিয়েছিল। যারা লুটতরাজ করে অশান্তি সৃষ্টি করে তাদের যদি আরও ১ হাজার জনকে শাস্তি দিত তা হলেও কাদের আমার ধন্যবাদ পেত। টাঙ্গাইলের মানুষ যা করেছে ইতিহাস হয়ে থাকবে। সারা দেশে দশটা কাদের যদি থাকত তাহলে আমাকে পাকিস্তানের জিন্দানখানায় নয় মাস কাটাতে হতো না। আমি সারা জীবন টাঙ্গাইলকে মনে রাখব, কাদেরকে মনে রাখব, লতিফকে মনে রাখব, শহীদকে মনে রাখব, আপনাদের সবাইকে মনে রাখব। জয় বাংলা। ভারত-বাংলা মৈত্রী অমর হোক।’

সেই মহান স্মৃতির ২৪ জানুয়ারি পালন করা হবে সেটা যদি হিংসা-ঘৃণা ভুলে সবাইকে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের মনোভাব নিয়ে পালন করা হয় সে হবে আমার জন্য এক মহাগৌরবের। ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর পদতলে অস্ত্র প্রদান দিবস সফল হোক।

লেখক : রাজনীতিক।

www.ksjleague.com

সর্বশেষ খবর