নতুন বছর ভালো থাকব, ভালো শুনব, ভালো দেখব- মনে হয় আর হচ্ছে না। আজ কদিন খবরের শিরোনাম ওবায়দুল কাদের। শেষ পর্যন্ত ওবায়দুল কাদেরও রাজাকার হলেন অথবা রাজাকার বলে আখ্যা পেলেন। বেশ কয়েক বছর আগে আমার বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর কিছু উচ্ছৃঙ্খল চেলা কালিহাতির সয়া-পালিমায় পাল্টাপাল্টি জনসভা করতে গিয়ে ‘কাদের সিদ্দিকী রাজাকার, এ মুহূর্তে বাংলা ছাড়’ স্লোগান তুলেছিল। যারা স্লোগান দিয়েছিল তারা সবাই বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর লোক। সেখানে যেমন মাজহারুল ইসলাম ছিল, ছিল বর্তমান কালিহাতি আসনের এমপি সোহেল হাজারী। তোফায়েল আহমেদ, আমু ভাই, বাহাউদ্দিন নাছিম, মোহাম্মদ নাসিমসহ আরও অনেককে ব্যাপারটা বলেছিলাম। তারা অসহায়ের মতো আচরণ করেছিলেন। সে সময় বলেছিলাম, আমি যদি রাজাকার হই তাহলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু তো আমার কমান্ডার। জীবনে যা কিছু করেছি প্রায় সবই তাঁর নির্দেশ-আদেশে করেছি। এমনকি মুক্তিযুদ্ধও তাঁর নির্দেশে করা। যুদ্ধজীবনে বা যুদ্ধের সময় কষ্ট না হয় আমিই করেছি, কিন্তু কষ্ট করার নির্দেশ তো তিনিই দিয়েছিলেন। সে সময় এও বলেছিলাম, যে যাই বলুন গোলাম আযম আমার নেতা না, কমান্ডারও না। আমার নেতা-পিতা-কমান্ডার সবই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার পরও অনেকের গা-জ্বালা করেছিল। আওয়ামী লীগ যুক্তি মানে না, ‘বিচার মানি তালগাছ আমার’- নীতিতে তারা বিশ্বাসী। চিত হয়ে থুতু ছুড়লে যে বুকে পড়ে- মানতে না চাইলেও এটাই ধ্রুব সত্য। কিন্তু যেহেতু আমাকে গালাগালি তাই আওয়ামী লীগ মনে করত ভালোই হয়েছে। অথচ দেশবাসী অন্তত কিছুটা মনে করে যে আমাকে গালি দিলে বঙ্গবন্ধুও কিছুটা পান। কারণ বঙ্গবন্ধু এবং দেশের জন্য আমি আমার জীবন-যৌবন ঝরিয়েছি। আজ কদিন একরামুল করিম চৌধুরীর কথাবার্তায় ভীষণ মর্মাহত হয়েছি। প্রিয় ওবায়দুল কাদের আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। সব দলেই দলাদলি থাকে। আওয়ামী লীগ তো উপদলের কারখানা। তাই দলেও ওবায়দুল কাদেরের বিরোধিতা থাকবে, বিরুদ্ধে লোক থাকবে। তাই বলে ওবায়দুল কাদের একেবারে ফেলনা- এটা বলা যায় না। এ দেশে সত্যিই অনেক ফেলনাকে রাস্তা থেকে তুলে এনে অনেক নেতা পথ দেখিয়েছেন। কিন্তু ওবায়দুল কাদের সে রকম রাস্তা থেকে তুলে আনা মানুষ নন। তিনি গ্রামের মানুষ হতে পারেন, মফস্বলের সাধারণ ঘরের হতে পারেন, রাজ-রাজড়া পরিবারের আমরা তেমন কেউ না। আমরা প্রায় সবাই প্রাসাদ ভেঙে জনতার রাজত্ব কায়েমের দলের। আইয়ুব-মোনায়েমকে তাড়াতে না পারলে আজকের বাংলাদেশ হতো না। আর বাংলাদেশ না হলে তো একরামুল করিম চৌধুরী নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং এমপি হতেন না। এমপি হয়েছেন, হয়তো পয়সাও হয়েছে, সেই গরমে ধরাকে সরা-জ্ঞান করছেন, তাল সামলাতে পারছেন না। একরামুল করিমের কথাবার্তায় আমার এক গল্প মনে পড়ে গেল। এক মহারাজার খুবই শিকারের শখ ছিল। প্রতি বছর আশপাশের রাজা-জমিদারদের নিয়ে শিকারে বেরোতেন। একবার শিকারের নির্দিষ্ট দিনে আশপাশের সবাই এসেছে। যেদিন যাত্রা হবে সেদিন সকালে আর রাজার শিকারি হাতি ওঠে না। মাহুত শত চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে রাজাকে খবর দেয়। রাজা শিকারের পরিকল্পনা বাতিল করে হাতি নিয়ে ব্যস্ত হন। অনেক দিনের পুরনো হাতি, তার জন্য রাজার দরদ অপরিসীম। দেশের নানা প্রান্ত থেকে বড় বড় পশু চিকিৎসক-বদ্যি আনা হলো। নানাজন নানাভাবে চেষ্টা করল। কিন্তু হাতিকে কেউ ওঠাতে পারল না। এতে ছয়-সাত দিন চলে গেলে আশপাশের সব রাজা-জমিদারকে মহারাজা বিদায় করে দিলেন। রাজবাড়ির পাশেই ছিল এক হতদরিদ্র ব্রাহ্মণের বাস। তাদের একদিন খাবার জুটলে আরেক দিন জোটে না। রাজার প্রিয় শিকারি হাতি ওঠে না, রাজ্যে চলেছে হাহাকার। একসময় মহারাজা ঘোষণা করলেন, যে হাতিকে সুস্থ করতে পারবে, দাঁড় করাতে পারবে তাকে সাত গ্রাম পুরস্কার দেওয়া হবে। পুরস্কারের লোভেও অনেকে এলো, কিন্তু কোনো কাজের কাজ হলো না। তখন রাজবাড়ির পাশের ব্রাহ্মণী ব্রাহ্মণকে বলল, ‘যাও না, তুমি গিয়ে কিছু করতে পার কিনা দেখ। তোমার যে শরীর-স্বাস্থ্য, বুক-পিঠ দেখা যায়। তোমাকে দেখেও তো হাতি উঠে দাঁড়িয়ে যেতে পারে।’ খোঁচা খেয়ে ব্রাহ্মণ রাজার কাছে গেল, ‘রাজামশাই, আমি আপনার হাতিকে দাঁড় করাতে পারি।’ অনুমতি পেয়ে ব্রাহ্মণ গেল হাতিশালায়। এক দিন যায়, দুই দিন যায় সমস্যার কোনো কিনারা পায় না। হাতির মাথার কাছে গালে হাত দিয়ে দরিদ্র ব্রাহ্মণ বসে আছে। সে হাতির চোখের দিকে তাকিয়ে দেখে চোখ একেবারে বুজে আছে আর অঝরে পানি ঝরছে। এমনিই দেহ আন্দাজে হাতির চোখ ছোট। ব্রাহ্মণ তাকিয়ে আছে হাতির মাথার দিকে। কিছুক্ষণ পর পানি পড়া কিছুটা বন্ধ হয়ে যায় এবং আস্তে আস্তে হাতি তার ছোট চোখ খুলতে থাকে। একটু সুস্থও মনে হয়। এ সময় পাশের এক গর্ত থেকে এক ব্যাঙ হাতির মাথায় লাফিয়ে পড়ে। আর সঙ্গে সঙ্গে হাতির চোখ দিয়ে আবার দরদর করে পানি ঝরা শুরু করে। কিছুক্ষণ হাতির মাথায় বসে থেকে ব্যাঙ আবার লাফিয়ে তার গর্তে পড়ে। যায় কয়েক মিনিট। আস্তে আস্তে হাতির চোখের পানি ঝরা কমে আসে। আবার ব্যাঙ গিয়ে হাতির মাথায় লাফিয়ে পড়ে। বারবার এমন করছে। একবার হাতির মাথায় ব্যাঙের লাফিয়ে পড়া এবং গর্তে গিয়ে পড়া দেখে ব্রাহ্মণ গর্তের দিকে তাকিয়ে দেখেন কী যেন চকচক করছে। পরের বার ব্যাঙ হাতির মাথায় লাফিয়ে পড়তেই ব্রাহ্মণ সেই চকচকে জিনিসটা ব্যাঙের গর্ত থেকে চট করে তুলে এনে দেখেন সেটা আর কিছু না, একটা আধুলি। ব্রাহ্মণের হাতে আধুলি। একসময় ব্যাঙ হাতির মাথা থেকে লাফিয়ে গর্তে পড়ে। আধুলি ছাড়া গর্তে লাফিয়ে পড়ে আর সে নাড়াচাড়া করে না। পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, এক ঘণ্টা যায় ব্যাঙ চুপচাপ বসে আছে। ওদিকে রাজার হাতি একসময় দাঁড়িয়ে পড়ে। সারা বাড়িতে আনন্দের বান ডেকে যায়, রাজার হাতি দাঁড়িয়েছে, রাজার হাতি দাঁড়িয়েছে। এত কান্ডের পর রাজা কঙ্কালসার ব্রাহ্মণকে দরবারে ডেকে পাঠান। চারদিকে ধন্য ধন্য রব। রাজা ব্রাহ্মণকে জিজ্ঞেস করেন, ‘যে কাজ কেউ পারল না তা তুমি পারলে কী করে, আমাকে বলতে হবে।’ ব্রাহ্মণ বললেন, মহারাজা! আপনি আমাদের বাপ-মা। এসব আমি আপনাকে বলতে পারব না। মহারাজা শুনবেন হাতি দাঁড় করার কৌশল, ব্রাহ্মণ বলবেন না। অনেক ঠেলাঠেলির পর মহারাজা বললেন, ‘হাতি দাঁড় করানোর জন্য তোমাকে সাত গ্রাম উপঢৌকন দিতে চেয়েছি তা তো দেবই, কী করে হাতি দাঁড় করিয়েছ তা বললে সাত-এর স্থলে ১৪ গ্রাম দেব। কিন্তু না বললে তোমাকে শূলে চড়াব।’ তখন ব্রাহ্মণ মহারাজাকে বললেন, মহারাজা যদি জানতেই হয় তাহলে আমার সঙ্গে আপনার একা হাতিশালায় যেতে হবে। মহারাজা তাতেও রাজি। গেলেন হাতিশালায়। যেখানে হাতি শুয়ে ছিল মাহুতকে সেখানে শোয়াতে বললেন। হাতি শুয়ে পড়লে কঙ্কালসার ব্রাহ্মণ গর্তে চুপচাপ বসে থাকা ব্যাঙকে এক হাতে তুলে আধুলি আগে যেখানে ছিল সেখানে সেভাবে রেখে দিয়ে ব্যাঙকে তার ওপর আগের মতো বসিয়ে দেয়। এক-দুই মিনিট পর ব্যাঙ হাতির মাথায় আবার লাফিয়ে পড়ে। হাতির দুই চোখ দিয়ে আবার ঝরঝর করে পানি ঝরতে থাকে। দু-চার বার এমন করার পর ব্রাহ্মণ সেই আধুলিটা সরিয়ে নিলে হাতির মাথা থেকে লাফিয়ে গর্তে পড়ে ব্যাঙ চুপচাপ বসে থাকে। কয়েক মিনিট পর হাতি আবার উঠে দাঁড়ায়। তখন ব্রাহ্মণ মহারাজাকে বলেন, ‘হুজুর! হাতি যখন শুয়েছিল আধুলির গরমে ব্যাঙ হাতির মাথায় লাফিয়ে পড়ছিল। আর হাতির মাথায় ব্যাঙ লাফিয়ে পড়ায় হাতি বেদনায়-দুঃখে-অভিমানে আর উঠে দাঁড়ায়নি। শুধু কেঁদেছে। মহারাজ এ আর কিছু না, পাছার তলে আধুলির গরম।’ পাছা থেকে আধুলি সরিয়ে নিলে আর গরম থাকে না, ব্যাঙ হাতির মাথায় লাফিয়ে পড়ে না। ওবায়দুল কাদেরকে রাজাকার বলায় আমার কি এটা বলা অন্যায় হবে যে, সবই ক্ষমতার গরম, মানে আধুলির গরম। ওবায়দুল কাদের রাজাকার পরিবারের, রাজাকার বংশের বা তিনি রাজাকার এসব বলার মানে কী? কাদেরিয়া বাহিনীর বেসামরিক প্রশাসক ছিলেন আনোয়ারুল আলম শহীদ। তার বাবা আবদুল করিম ইছাপুরী ঘোর মুসলিম লীগার টাঙ্গাইল জেলা শান্তি কমিটির অন্যতম সদস্য। কই, তাকে নিয়ে তো কথা ওঠেনি? অনেক আশা করে তাকে রক্ষীবাহিনীর অন্যতম পরিচালক বানানো হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে যারা ক্ষমতায় বসেছিল, প্রথম তিনি তাদের প্রতি আনুগত্য জানিয়েছিলেন। তার পরও তার বীরত্ব নিয়ে কথা হয় না। হুমায়ূন আহমেদের নানা বারহাট্টা উপজেলা শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন। এ রকম হাজার জনের নাম বলতে পারি। কই তাদের নিয়ে তো কোনো কথা হয় না? একরামুল করিম এও বলেছেন, অজপাড়াগাঁয়ের একজন ছোট্ট মানুষ এত বড় নেতা হয়েছে। সত্যিই ওবায়দুল কাদের কারও হাতে-পায়ে ধরে নেতা হননি। বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে হত্যার পর আমি যদি সশস্ত্র প্রতিবাদ না করতাম তাহলে যেমন জিয়াউর রহমানের লোকেরা আওয়ামী লীগকে কবর দিত, ঠিক তেমনি দেশের ভিতরে ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ওবায়দুল কাদেরই ছাত্র-যুব সমাজকে হিমাদ্রির মতো অবিচল রেখেছিলেন। আজ আধুলির গরমে যে যত নাচানাচিই করুন, সে সময় ওবায়দুল কাদেরের এক দুর্বার ভূমিকা রয়েছে। ষাটের দশকে গণঅভ্যুত্থানের মহান নেতা তোফায়েল আহমেদের ভূমিকা যেমন, আশির দশকে ছাত্রনেতা ওবায়দুল কাদেরের ভূমিকাও তেমন। তিনি কোনো খেলনা নন। ওবায়দুল কাদেরকে অবলম্বন করেই ধীরে ধীরে ছাত্রলীগ দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। সবই ওবায়দুল কাদেরকে ঘিরে। দলীয় কোন্দলে বা দলের আশকারায় একজন আরেকজনের চরিত্রহনন করলে তাতে শুধু ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় না, দলও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। আমাকে গালাগাল করে ছোট করে যারা মনে করে তারা লাভবান হচ্ছে তারা একটুও বুঝতে চায় না কাদের সিদ্দিকীকে গালি দেওয়া, ছোট করা বঙ্গবন্ধুর গায়েও লাগে, সিদ্দিকী পরিবারকে ধ্বংসের চেষ্টা বঙ্গবন্ধুরও ক্ষতি। সত্যিই আমি মর্মাহত ওবায়দুল কাদেরের বিরুদ্ধে এমন বিষোদ্গার করায়। ২০০৪ সালে সভানেত্রী শেখ হাসিনার ওপর গ্রেনেড হামলায় ওবায়দুল কাদের ও বাহাউদ্দিন নাছিম আহত হয়ে যখন দিল্লির অ্যাপোলো হসপিটালসে কাতরাচ্ছিলেন তখন আমার হাত ধরে তারা দুজনই বলেছিলেন, ‘কাদের ভাই! আমরা কি মরে যাব?’ তার সেদিনের সেই আকুতি আমাকে স্পর্শ করে। বাহাউদ্দিন নাছিমের উৎকণ্ঠা আমাকে নাড়া দেয়।
এটা কোনোমতেই ভালো কিছু না। মতের অমিল হলেই একজন আরেকজনকে রাজাকার, রাজাকারের পরিবার বলে টুঁটি চেপে ধরতে হবে যেমনটা একরামুল করিম চৌধুরী ওবায়দুল কাদের সম্পর্কে বলেছেন। কাজটা ভালো করেননি। যদিও আওয়ামী লীগে ন্যায়-অন্যায়ের বিচার নেই। আওয়ামী লীগ কখনো দলের নেতাদের সম্মান রক্ষার খুব একটা চেষ্টা করে না। হুজুর মওলানা ভাসানী এবং বঙ্গবন্ধু থাকতে তবু কিছুটা করা হতো। কিন্তু এখন তার কানাকড়িও নেই। এ কাদা ছোড়াছুড়ি কবে শেষ হবে, কাউকে মিথ্যা অপবাদ দেওয়া চরিত্রহনন করা কবে বন্ধ হবে তা আমরা কেউ জানি না। কিন্তু দেশের মঙ্গল দেশের কল্যাণে এটা বন্ধ হওয়া উচিত। সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের একজন ব্যক্তি নন, তিনি একটি প্রতিষ্ঠান। তাকে হেয় প্রতিপন্ন করা একসময়ের ছাত্র নেতৃত্বকে ছোট করা খেলো করা। তাকে ছোট করে তার দলকে কেউ বড় করতে পারবে না, হবেও না। নিশ্চয়ই ওবায়দুল কাদেরের অপমানে হাততালি দেওয়ার লোকজনও পাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে দলের-সরকারের-সমাজের কোনো লাভ হবে না।
২৪ জানুয়ারি ছিল শহীদ মতিউর রহমান দিবস। পুরান ঢাকার নবকুমার স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে শহীদ হয়েছিল। অন্যদিকে ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধে হানাদারদের পরাজিত করে ’৭২-এর ২৪ জানুয়ারি সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে রাজধানীর বাইরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথম টাঙ্গাইল গিয়েছিলেন। বিন্দুবাসিনী স্কুলমাঠে তাঁর পায়ের কাছে কাদেরিয়া বাহিনী কয়েক হাজার অস্ত্র বিছিয়ে দিয়েছিল। কাদেরিয়া বাহিনীর অস্ত্র টাঙ্গাইল থেকে ঢাকা বয়ে আনতে ৩১৫টি ট্রাকের প্রয়োজন হয়েছিল। সে ঐতিহাসিক অস্ত্র প্রদান দিবস স্মরণীয় করতে টাঙ্গাইল জেলা কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ এক সর্বদলীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল। যেখানে টাঙ্গাইল জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, প্রবীণ নেতা ফজলুর রহমান খান ফারুক সভাপতিত্ব করেছেন এবং কাদেরিয়া বাহিনীর সর্বস্তরের যোদ্ধা ও জনগণ অংশগ্রহণ করেছেন। হাজারো লোকের মিছিল হয়েছে, দিনব্যাপী লাঠিখেলা হয়েছে। কিন্তু পত্রপত্রিকায় তেমন খবর আসেনি, ইলেকট্রনিক মিডিয়ায়ও নয়। অথচ ’৭২ সাল থেকে বসবাস করা সাবেক মন্ত্রী বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকীর বাড়ি প্রশাসন দখল করে নিয়েছে তার খবর ছিল দিনব্যাপী। বুঝতে পারলাম না প্রশাসন কী করছে, কী করতে চাচ্ছে। আমাদের নাতির বয়সের এক মহিলা ম্যাজিস্ট্রেট আগ বাড়িয়ে বললেন, ‘লতিফ সিদ্দিকী সরকারি জায়গা দখল করেছিলেন। হাই কোর্টের নির্দেশে তা দখলমুক্ত করলাম।’ কথাটা মোটেও সত্য নয়। হাই কোর্টে মামলার কোনো নিষ্পত্তি হয়নি, সুপ্রিম কোর্টে রয়েছে। যদি সরকারের জায়গা হয় সরকার নেবে। কিন্তু তার জন্য কারও চরিত্রহননের প্রয়োজন কি? বড় ভাই লতিফ সিদ্দিকী ’৭২ সাল থেকে সেখানে ছিলেন। কারণ আমাদের পৈতৃক বাড়ি পাকিস্তানি হানাদাররা জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছিল। লতিফ সিদ্দিকীর বিয়ের পর ভাবিকে নিয়ে ওই বাড়িতে প্রথম ওঠা হয়েছিল। কত নেতা, কত মন্ত্রী- তার মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সময় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, কামারুজ্জামান, মান্নান ভাই, কতজন সেখানে গেছেন, খেয়েছেন।’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু নিহত হলে আমরা যখন সব ছেড়ে চলে যাই তখন আমার ঢাকার বাবর রোডের বাড়ি আর টাঙ্গাইলে আকুরটাকুর পাড়ার লতিফ ভাই বাসা ছেড়ে গিয়েছিলেন। ২৪ জানুয়ারি, ২০২১, লতিফ ভাইয়ের আকুরটাকুর পাড়ার ভাঙা বাড়িঘর ভাঙচুর করে প্রশাসন দখল নিয়েছে। এখন আমাকে বাবর রোড থেকে নামিয়ে দিয়ে দখল নেওয়া হবে। কারণ অবৈধ দখলদার হিসেবে আমার নাম মহান সংসদেও তোলা হয়েছে। এ সবই ইতিহাস। যে লতিফ সিদ্দিকী না হলে আমরা রাজনীতিতে আসতাম না, মুক্তিযোদ্ধা হতাম না, বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্য পেতাম না, সেই লতিফ সিদ্দিকীকে অবৈধ দখলদার বলে দাঁত কেলিয়ে হাসার লোকের অভাব নেই। কত শত লাখো সরকারি জমি ৯৯ বছরের বন্দোবস্ত নিয়ে কতজন ভোগদখল করছে আর পুরো ৫০ বছর একজন সুনাগরিকের দখলে থাকার পরও জায়গাটিতে তিনি দখলদার! আমরা বাংলাদেশ না বানালে আজ যারা বড় বড় নেতা-কর্মকর্তা, তাদের নামগন্ধ থাকত না। এখনো পাকিস্তান থাকলে এরা অনেকে দারোয়ান-পিয়নের ওপরে উঠতে পারত না।
লেখক : রাজনীতিক।
www.ksjleague.com