রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

ফিরে দেখা ৫ মে ২০১৩ হেফাজতের তান্ডব

এ কে এম শহীদুল হক

ফিরে দেখা ৫ মে ২০১৩ হেফাজতের তান্ডব

২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা শহরে হেফাজতে ইসলামের তান্ডবের কথা কার না মনে আছে। সে তান্ডবে নগরবাসী ছিল আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্যে। ওই দিন হেফাজতের ১৩ দফা দাবি আদায়ের জন্য ঢাকা অবরুদ্ধ করার কর্মসূচি ছিল। সকালের মধ্যেই ঢাকার ছয়টি প্রবেশদ্বার হেফাজতের দখলে চলে যায়। হেফাজতপন্থিরা সড়ক বন্ধ করে সমাবেশ করে। সমাবেশে হেফাজতি নেতাদের রূপ ছিল অতিবিপ্লবীর মতো। পবিত্র ইসলাম ধর্মে বিনয় ও শালীনতা রক্ষা করে কথা বলার নির্দেশ থাকলেও হেফাজতি নেতাদের মধ্যে দেখা যায় তার বিপরীত চিত্র। তারা গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে অশালীনভাবে বক্তব্য দিচ্ছিলেন। আপত্তিকর কথা বলছিলেন। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে কওমি মাদরাসার হাজার হাজার ছাত্র-শিক্ষক এনে সমাবেশে জমায়েত করেছিলেন। হেফাজতের কিছু নেতা শিক্ষক ও ছাত্রদের বুঝিয়েছিলেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ইসলাম ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। ইসলাম রক্ষার জন্য ঢাকা যেতে হবে এ কথা বলে নেতারা তাদের ঢাকা এনেছিলেন। সমাবেশে অসংখ্য কোমলমতি শিশুও ছিল।

হেফাজতে ইসলামের চাহিদা মোতাবেক তাদের ঢাকার ছয়টি প্রবেশদ্বারে সমাবেশ করার অনুমতি দেওয়া হয়েছিল। তারা সমাবেশ করছিল। হঠাৎ তারা বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে হেফাজত আমির আল্লামা আহমদ শফীর দোয়া মাহফিলের ঘোষণা দেয়। ঢাকায় ঢোকার বায়না ধরে। এতে পুলিশ কর্মকর্তাদের মনে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। ডিএমপি তাদের প্রথমে ঢাকায় ঢুকতে অনুমতি দেয়নি। পরে সরকারের নির্দেশে দিতে বাধ্য হয়েছিল। তবে বায়তুল মোকাররম নয়। মতিঝিলের শাপলা চত্বরে। হেফাজতে ইসলাম মতিঝিলের শাপলা চত্বরে এসে দোয়া মাহফিল করে আসর নামাজের আগেই চলে যাবে এ শর্ত মেনে নেয়।

হেফাজতিরা ঢাকায় ঢুকল। কেউ কেউ শাপলা চত্বরে গেল। আবার হাজার হাজার উগ্র হেফাজতি জঙ্গি মিছিল ও উসকানিমূলক স্লোগান দিয়ে আওয়ামী লীগের অফিস অভিমুখে যাওয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছিল। পুলিশের বাধায় আওয়ামী লীগের অফিসে যেতে না পেরে তারা পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশকে বোমা, ককটেল, ইট, পাথর, লাঠি ইত্যাদি দিয়ে আক্রমণ করেছে। পুলিশ টিয়ার গ্যাস ও শর্টগান দিয়ে জবাব দেয়।

হেফাজতিরা রাস্তার আইল্যান্ডগুলো সব ভেঙে ফেলে। করাত দিয়ে আইল্যান্ডের অসংখ্য গাছ কেটে ফেলে। বায়তুল মোকাররমের উত্তরের দোকানগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। বুকস্টলের বিপুলসংখ্যক কোরআন শরিফ ও ইসলামী পুস্তক পুড়ে ছাই হয়ে যায়। রাস্তার দুই পাশে পার্কিং গাড়িগুলো ভাঙা ও পোড়ানোর মহোৎসবে মেতে উঠেছিল হেফাজতিরা। আগুনের লেলিহান শিখা পুরো এলাকায় দাউদাউ করে জ্বলছিল। পুলিশের স্থাপনায় আগুন দিয়েছে। শান্তিনগরের ডিসি ট্রাফিক অফিস আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছিল। দোতলায় পুলিশ আটকা পড়ে আগুনে পুড়ে মারাত্মক আহত হয়। তাদের মধ্যে কনস্টেবল পেয়ারুল ইসলামের অবস্থা মুমূর্ষু ছিল। পরে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুর পাঠানো হয়। খরচ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বহন করেন। মতিঝিল ব্যাংক ও অফিসপাড়ায় লোকজন আটকা পড়ে। তারা চরম নিরাপত্তাহীনতা, ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে ছিল।

আসর নামাজের পর আল্লামা শফী দোয়া করে সভা শেষ করে দেওয়ার কথা। আসর গেল, মাগরিব গেল কিন্তু আহমদ শফী শাপলা চত্বরে এলেন না। পুলিশের পক্ষ থেকে তাঁকে বারবার অনুরোধ করা হয়েছিল শাপলা চত্বরে যেতে। কিন্তু তিনি লালবাগ মাদরাসা থেকে বের হতে চাচ্ছিলেন না। তাঁকে নানাজন নানা পরামর্শ দিচ্ছিল। অবশেষে মাগরিবের পর রওনা হলেন। পথিমধ্যে তাঁর এক সঙ্গীর কাছে ফোন এলো। কথা বললেন। গাড়ি ঘুরিয়ে লালবাগ মাদরাসায় ফিরে গেলেন। এদিকে শাপলা চত্বরে হেফাজতিদের জ্বালাময়ী বক্তব্য চলছিল। বক্তারা ১৩ দফা ভুলে গিয়ে এক দফা অর্থাৎ সরকারের পদত্যাগ দাবি করছিলেন।

সন্ধ্যার পর আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার এবং আমি পুলিশ কন্ট্রোল রুমে গেলাম। পুলিশ কমিশনার বেনজীর ও অন্যান্য অফিসার উপস্থিত ছিলেন। স্পেশাল ব্রাঞ্চ ও অন্যান্য গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরাও ছিলেন। পুলিশ কমিশনারকে খুব ক্লান্ত মনে হচ্ছিল। আমাকে দেখে ডিএমপির একজন সিনিয়র অফিসার বললেন, ‘স্যার, শাপলা চত্বরে যাওয়া যাবে না, হাত দেওয়া যাবে না। ওখানে গেলে শত শত লোক শহীদ হয়ে যাবে।’ আমি তাকে ধমক দিয়ে বললাম, ‘এত কথা বল কেন? ওরা যদি শহীদ হতে চায় হবে। আমাদের কী করার আছে। ওদের ওখান থেকে যথাশিগগির সম্ভব তাড়িয়ে দিতেই হবে। বিকল্প কোনো চিন্তা করার দরকার নেই।’

ডিজি র‌্যাব মোখলেছুর রহমান, র‌্যাবের কর্নেল জিয়া ও বিজিবি অফিসাররা পুলিশ কন্ট্রোল রুমে এলেন। সবার মধ্যেই উদ্বেগের ছাপ ছিল। আমি ডিসি মতিঝিল, ডিসি রমনা ও ডিসি লালবাগের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে পরিস্থিতির সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে অবহিত হচ্ছিলাম। পুলিশের মনোবল দৃঢ়ই ছিল। তাদের জিজ্ঞাসা করলাম উচ্ছৃঙ্খল জনতাকে ছত্রভঙ্গ করে তাড়িয়ে দেওয়া যাবে কি না। সবাই সাহসের সঙ্গে বললেন, অবশ্যই তাড়ানো যাবে। কিন্তু সরকারের শীর্ষ মহল থেকে অভিযান চালানোর গ্রিন সিগন্যাল পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি কয়েকবার আলাপ করে অনুমতি চেয়েছিলাম। কিন্তু তিনি অভিযানের অনুমতি দিচ্ছিলেন না। তাঁর আশঙ্কা ছিল ওখানে অভিযান চালালে প্রাণহানির সম্ভাবনা থাকবে।

এদিকে বিভিন্ন সূত্র থেকে গোপন তথ্য পাওয়া যাচ্ছিল রাত শেষে ফজরের নামাজের পর বিএনপি ও জামায়াত-শিবিরের কর্মী-সমর্থকরা হেফাজতের সঙ্গে যোগ দিয়ে সরকার পতনের লক্ষ্যে সর্বাত্মক নাশকতামূলক কাজ চালানোর পরিকল্পনা করছে। এ অবস্থায় হেফাজতকে রাতের মধ্যেই শাপলা চত্বর থেকে তাড়িয়ে দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প পথ খোলা ছিল না। পুলিশ কমিশনার বেনজীর র‌্যাব ও বিজিবি অফিসারদের সঙ্গে আলাপ করে অপারেশন প্ল্যান প্রস্তুত করলেন। প্ল্যানে পূর্ব ও দক্ষিণ দিক খোলা রাখা হলো যাতে অপারেশন শুরু হলে হেফাজতের লোকজন দুই দিক দিয়ে পালিয়ে যেতে পারে।

অপারেশনের আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আইজিপি মহোদয়কে কথা বলার জন্য অনুরোধ করলাম। তিনি কথা বললেন ও নির্দেশনা নিলেন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা মোতাবেক সিদ্ধান্ত হলো অভিযানে শুধু গ্যাস, শর্টগান ও সাউন্ড গ্রেনেড ব্যবহার করা হবে। কোনোক্রমেই রাইফেলের গুলি ছোড়া যাবে না। একটি লোকেরও যাতে প্রাণহানি না হয় সেদিকে সবাইকে খেয়াল রাখার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।

রাত ১টার কিছু পরে (৬/৫/২০১৩ তারিখে) অভিযান শুরু হয়। সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সমাবেশস্থলে থাকা জিহাদিরা ভয়ে দিগ্বিদিক দৌড়াদৌড়ি শুরু করে। দক্ষিণ দিক খোলা থাকায় সেদিকেই বেশি লোক পালিয়ে গিয়েছিল। পূর্ব দিকেও কিছু পালিয়ে যায়। প্রায় আধা ঘণ্টার মধ্যে পুরো শাপলা চত্বর ও আশপাশ এলাকা জনশূন্য হয়ে পড়ে। একটি লোকেরও প্রাণহানি হয়নি। সকালে দিলকুশা থেকে পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টরের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। তার পিস্তলটিও পাওয়া যায়নি। সম্ভবত অভিযান চলাকালে সে যে কোনো কারণেই বিচ্ছিন্ন হয়ে হেফাজতিদের আক্রমণে পড়েছিল।

শাপলা চত্বরের রাতের অভিযানে হেফাজতে ইসলামের কোনো নেতা-কর্মীর প্রাণহানি না হলেও হেফাজতের কতিপয় নেতা ও স্বার্থান্বেষী মহল চরম মিথ্যাচার করে, প্রচার করে শাপলা চত্বরে শত শত লোক মারা গেছে। হাইতিতে ভূমিকম্পে নিহতদের ছবি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট দিয়ে প্রচার করে ওইগুলো শাপলা চত্বরে নিহতদের ছবি। অথচ চ্যালেঞ্জ দেওয়া সত্ত্বেও তারা শাপলা চত্বরে কথিত নিহত বা আহত একটি লোকের নামও জানাতে পারেনি। আসলে শাপলা চত্বরের অভিযানে একটি লোকেরও প্রাণহানি হয়নি।

হেফাজতের যেসব জিহাদি নেতা ধ্বংসাত্মক কাজে উসকানি দিয়েছে তার কয়েকজনকে গ্রেফতার করা প্রয়োজন বলে আমি মনে করলাম। এত তান্ডব ও ধ্বংসলীলা চালাল অথচ একটি লোকও গ্রেফতার হবে না? সরকারের শীর্ষ মহলের অনুমতি না থাকায় তা সম্ভব হচ্ছিল না। তবু আমি সাহস করে ডিসি লালবাগ হারুনকে নির্দেশ দিলাম হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরীকে গ্রেফতার করে ডিবি অফিসে পাঠিয়ে দিতে। হারুন তাই করল। এতে তৎকালীন আইজিপি মহোদয় রুষ্ট হয়েছিলেন। আমি ডিবির জয়েন্ট কমিশনারকে বলেছিলাম বাবুনগরীকে ভালোভাবে জিজ্ঞাসাবাদ করে সব তথ্য বের করতে। কেন তাঁরা ওয়াদা ও শর্ত ভঙ্গ করে ঢাকা শহরে ঢুকলেন। কেন তাঁরা আসর নামাজের পর শাপলা চত্বর ত্যাগ করলেন না, কেন তাঁরা রাতে শাপলা চত্বরে অবস্থান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত নিলেন ইত্যাদি তথ্য তাঁর কাছ থেকে জেনে তাঁর জবানবন্দি রেকর্ড করতে নির্দেশ দিলাম।

ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী হেফাজতিদের তান্ডবের রহস্য পুলিশের কাছে অকপটে প্রকাশ করেন। পরে তিনি আদালতেও কার্যবিধি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। তিনি জানান শাপলা চত্বরে সমাবেশ শুরুর আগে তিনি লালবাগ মাদরাসায় অবস্থানকালীন জানতে পারেন তাঁদের উচ্ছৃঙ্খল ছেলেরা বায়তুল মোকাররম, পুরানা পল্টন, বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ, বিজয়নগরসহ নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, বোমাবাজি, লুটতরাজ, পুলিশের ওপর হামলা ইত্যাদি অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে। আল্লামা আহমদ শফীর হুকুমে তিনি প্রকৃত ঘটনা জানার চেষ্টা করেন। তাঁদের নিয়োজিত স্বেচ্ছাসেবীদের মাধ্যমে জানতে পারেন হেফাজতের কর্মী ছাড়াও মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম ও বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ এলাকায় জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী এবং ছাত্রদল ও যুবদলের ছেলেরা সহিংস ঘটনা ঘটাচ্ছে। একপর্যায়ে খবর আসে উচ্ছৃঙ্খল লোকজন বায়তুল মোকাররমের বইয়ের দোকানসহ কোরআন শরিফ পোড়াচ্ছে। এ সংবাদ শুনে তাঁরা বিচলিত হয়ে পড়েন। তখন তিনি সমাবেশস্থলে উপস্থিত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী প্রমুখের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁদের সহিংসতা বন্ধ করতে বলেন। কিন্তু সহিংসতা বন্ধের কোনো ইচ্ছা তাঁদের ছিল না। তাঁরা বরং তাঁকে চুপচাপ থাকতে পরামর্শ দেন। তাঁরা আরও বলেন, তাঁদের আন্দোলন এখন আর ১৩ দফার মধ্যে নেই। এটা এখন এক দফা- সরকার পতনের আন্দোলন। তাঁরা তাঁকে জানান, বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের লোকজন তাঁদের সর্বাত্মক সহায়তা করছেন। তাঁদের সঙ্গে হেফাজত নেতাদের কথাও হচ্ছে।

বাবুনগরী বলেন, তিনি মাগরিবের নামাজের পর লালবাগ মাদরাসা থেকে শাপলা চত্বরে সমাবেশস্থলে যান। তখন ওখানে মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী, মুফতি ফয়জুল্লাহ, মাওলানা আবুল হাসানাত, মাওলানা আমিন মুস্তফা, মাওলানা সাখাওয়াত হোসাইন, মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব, মাওলানা আতাউল্লাহ আমিন, মাওলানা গোলাম মহিউদ্দিন একরাস, মাওলানা শেখ লোকমান হোসাইন, মাওলানা মাঈনুদ্দীন রুহী, মাওলানা শামছুল আলম, মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী, আমানুল কারি, ফজলুল কারি জিহাদি ও মুফতি হারুন ইজহার উপস্থিত ছিলেন। তিনি বলেন, নেতারা ১৩ দফা না মানা পর্যন্ত এবং সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত শাপলা চত্বরে অবস্থান করতে থাকবেন বলে বক্তব্য দিতে থাকেন। নেতারা মাওলানা বাবুনগরীকে জানান তাঁরা ১৮-দলীয় জোটের কাছ থেকে ইতিমধ্যে টাকা পেয়েছেন। আরও টাকা পাবেন। আগামীকাল (৬ মে) শাপলা চত্বরে অবস্থানকালে ঢাকার মেয়র সাদেক হোসেন খোকা সকালের নাশতা ও দুপুরের খাবার সরবরাহ করবেন। তাঁরা বাবুনগরীকে চিন্তা না করতে বলেন। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত তাঁরা শাপলা চত্বরে অবস্থান করবেন।

হেফাজত ইসলামের মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে প্রাপ্ত গোপন তথ্য থেকে এটা স্পষ্ট ছিল যে বিএনপি-জামায়াতপন্থি হেফাজতে ইসলামের কিছু আলেম ১৮-দলীয় জোটের সঙ্গে আঁতাত করে হেফাজতের কর্মী ও সমর্থকদের ব্যবহার করে সরকার পতন ঘটাতে ষড়যন্ত্র করেছিল। সরকার পতন ঘটানো যে এত সহজ নয় তা তাঁদের বোধগম্য ছিল না।

৫ মে সারা রাত মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুলিশি অভিযান তদারক করছিলেন। ওই দিন আমি লক্ষ্য করলাম আলেমওলামাদের প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যথেষ্ট সম্মান, সহমর্মিতা ও ভববষরহমং আছে। প্রাণহানির আশঙ্কায় তিনি শাপলা চত্বরে পুলিশি অভিযান চালাতে অনুমতি দিচ্ছিলেন না, হেফাজত নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার করতে নিষেধ করেছিলেন, আল্লামা শফীকে নিরাপদে হাটহাজারীতে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে আমাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি কওমি মাদরাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের দীর্ঘদিনের দাবি দাওরা হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রির মর্যাদা দিয়েছেন। অথচ একশ্রেণির মাওলানা সংকীর্ণ রাজনৈতিক কারণে জাতির পিতার কন্যা ধার্মিক শেখ হাসিনাকে চিনতে ব্যর্থ হয়েছেন।

২০১৩ সালের পর হেফাজতে ইসলাম তেমন কোনো বড় কর্মসূচি দেয়নি। ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে তারা চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জসহ দেশের অন্যান্য স্থানে যে তান্ডব ও ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা পাক বাহিনীকেও হার মানিয়েছে। হেফাজতের মধ্যে থাকা বিএনপি ও জামায়াতপন্থি আলেমরাই এ তান্ডবের মাস্টারমাইন্ড। মাওলানা বাবুনগরী ২০১৩ সালের তান্ডবের দায় বিএনপি-জামায়াতপন্থি আলেমদের দিলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেননি। তারাই এখন ওই একই কাজ করছে। আসলে এ তান্ডবের দায় হেফাজতের সব নেতার। তাঁদের কঠোর আইনের আমলে আনা অপরিহার্য। জনমত তৈরির মাধ্যমে এ সাম্প্রদায়িক শক্তির উত্থান ঠেকানো না গেলে দেশের গণতন্ত্র, শান্তি-শৃঙ্খলা, নিরাপত্তা, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মধ্যে পড়বে। তাই সরকারকে সংশ্লিষ্ট সবার সহযোগিতা বিশেষ করে স্বনামধন্য আলেমওলামাদের পরামর্শ ও সমর্থন নিয়ে এ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এবং ধর্মব্যবসায়ীদের নিয়ন্ত্রণের পন্থা বের করতে হবে। তাদের ছাড় দেওয়া মানে উগ্রবাদ প্রশ্রয় দেওয়া। ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের দায়ীদের বিরুদ্ধে চলমান অভিযান অব্যাহত রাখাসহ যথাযথ আইন প্রয়োগই বাঞ্ছনীয়।

হেফাজত যদি তাদের সংগঠনে ঘাপটি মেরে থাকা স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-বিএনপিপন্থি আলেমদের বের করতে না পারে তবে তারা এ ধরনের ষড়যন্ত্র করেই যাবে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে হেফাজত দিন দিন সাধারণ মানুষের কাছে একটি জঙ্গি সংগঠন হিসেবে পরিচিতি পাবে এবং জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা শূন্যের কোঠায় পৌঁছবে।

                লেখক : সাবেক ইন্সপেক্টর জেনারেল, বাংলাদেশ পুলিশ।

সর্বশেষ খবর