শিরোনাম
রবিবার, ৯ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

মা দিবসে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা

নাফিসা বানু

মা দিবসে মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা

প্রতি বছর মে মাসের দ্বিতীয় রবিবার বিশ্ব মা দিবস হিসেবে পালিত হয়। সে হিসেবে এ বছর ৯ মে বিশ্ব মা দিবস, মা-বাবার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের কথা সন্তানদের স¥রণ করিয়ে দেওয়ার জন্য পালিত হয়ে থাকে। ১৯১৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট উইলসনের সময় থেকে মা দিবস যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর বহু দেশে পালিত হয়ে আসছে।

আমাদের সমাজে একটি পরিবারের প্রধান থাকেন সাধারণত বাবা, কোনো কারণে বাবার অনুপস্থিতিতে বা অন্য কোনো আবশ্যিক কারণে মাকেও অনেক সময় পরিবারের দায়িত্ব নিতে হয়। প্রতিটি পরিবারের মা-বাবার সাফল্য সেখানেই যেখানে মা-বাবা তাঁর সন্তান-সন্ততিকে সঠিক ও সফলভাবে মানুষ করতে পারেন। পরিবারে মা-বাবা সংসারের জন্য যে পার্থিব কাজ করেন তার পেছনে কাজ করে ছেলেমেয়েকে সঠিক শিক্ষা দেওয়া এবং সঠিক পথে পরিচালিত করার মানসিকতা। কীভাবে ছেলেমেয়েকে সঠিক ও সফলভাবে মানুষ করা যায় তা নিয়ে মা-বাবা সাধারণত সব সময় ব্যস্ত থাকেন এবং ছেলেমেয়ের সফলতাকেই মা-বাবা তাদের সার্থকতা ও সফলতা মনে করেন।

মা-বাবা হলো সবার জীবনে প্রথম শিক্ষাগুরু। প্রথম শিক্ষাগুরু হিসেবে মা-বাবার ভূমিকাই প্রত্যেক সন্তানের জীবনে অনেক বেশি প্রভাব বিস্তার করে। পারিবারিক শিক্ষার শুরু হয় মামা-বাবার মাধ্যমে। এ শিক্ষার প্রভাব জীবনের সব ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়। মানুষের চালচলন, কথাবার্তা, আচার-আচরণ ইত্যাদির বহিঃপ্রকাশ দেখে আমরা সাধারণত মন্তব্য করি সেই ব্যক্তির পারিবারিক শিক্ষা কেমন, ভালো না মন্দ। তাই উল্লেখ করা যায়, পারিবারিক শিক্ষাই একজন মানুষকে যাচাই করার প্রথম ও প্রধান মাধ্যম। পারিবারিক সুশিক্ষা কারও জীবনে যদি প্রতিফলিত হয় তখন মানুষ বলে লোকটি নিশ্চয়ই কোনো সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্ম নিয়েছে।

আমরা মা-বাবার চার সন্তান। আমার বড় বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এমএ পাস করে কিছুদিন স্কুলে পড়াতেন। স্বামীর  চাকরির বদলি এবং মেয়েদের লালনপালনের জন্য তিনি চাকরি ছেড়ে দেন। তাঁর স্বামী বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত কমোডর। আমার বড় ভাই ডাক্তার, তিনি সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের শিশু বিভাগের অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব পালন করে সম্প্রতি অবসরে গেছেন। এরপর আমি আমার বাবা-মার তৃতীয় সন্তান। আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্সে এমকম পাস করে বর্তমানে বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষের (বেপজার) নির্বাহী বোর্ডের একজন সদস্য হিসেবে কর্মরত আছি। স্বামী বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আমার ছোট ভাই বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি (বুয়েট) থেকে সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ¯œাতক পাস করে যুক্তরাষ্ট্রের আইডাহো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করেছে। বর্তমানে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কর্মরত আছে ফ্লোরিডায়। তার স্ত্রী অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসএস সম্মানসহ এমএসএস পাস করে বর্তমানে ফ্লোরিডায় একটি স্কুলে কর্মরত। আমরা মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছি। আমাদের সন্তানরা যে রকম সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে বড় হয়েছে সে সুবিধা আমরা আমাদের ছাত্রজীবনে পাইনি। কিন্তু আমাদের বাবা-মা আমাদের তাঁদের সাধ্যমতো সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে মানুষ করতে চেষ্টা করেছেন। আমরা সবাই নিজ নিজ জায়গায় সফলতার সঙ্গে কাজ করার চেষ্টা করছি।

আমার বাবা ছিলেন একজন নিরেট সজ্জন ভদ্রলোক। তিনি ছিলেন একজন পরোপকারী মানুষ। বাবা সব সময় অন্যের উপকারের জন্য ব্যস্ত থাকতেন। আমি মাঝেমধ্যে বলতাম, আব্বু আপনি কেন অন্যের জন্য এত ব্যস্ত হয়ে পড়েন। তিনি বলতেন, মারে! কারও জন্য কিছু করতে পারলে মনে শান্তি পাই। আমি বাবাকে আব্বু এবং আপনি বলে সম্বোধন করতাম। তিনি নিজের অবসর ভাতা এবং আমাদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে কোনো দরিদ্র মেয়েদের বিয়ের খরচ, কারও সংসারে অভাব, চাল-ডাল এনে দেওয়া, কারও লেখাপড়ার জন্য অর্থ সাহায্য প্রদান করে মানুষকে সাহায্য করতেন। আমার বাবাকে দেখেছি তিনি খুব হিসাব করে আহার গ্রহণ করতেন। তিনি খুব স্বল্পভোজী ছিলেন। তরকারি ভালো বা স্বাদ লাগলেও পরিমাণমতো খেতেন, কখনো অতিরিক্ত খেতেন না। কাপড়-চোপড়ের প্রতিও আকর্ষণ ছিল কম। মৃত্যুর আগেও নিজের কাপড়-চোপড় দেশের বাড়িতে গিয়ে গরিব আত্মীয়স্বজনকে বিলিয়ে দিয়ে এসেছিলেন।

আব্বু চাকরি করতেন বীমা কোম্পানিতে। অফিসের পর আমাদের সময় দিতেন। আমাদের নিয়ে গল্প বলতেন, খেলাধুলা করতেন, চাকরির বদৌলতে আব্বু যখন বগুড়ায় বদলি হলেন তখন সেখানে আমাদের পরিচিত কোনো পরিবার না থাকায় আব্বু আমাদের বাসার বাইরে খুব বেশি মিশতে দিতেন না। তিনি আমাদের জন্য নিজের হাতে মনোপলি বোর্ড তৈরি করে দিয়েছিলেন, ক্যারম ও বেগাডুলি কিনে দিয়েছেন এবং সময় পেলে আমাদের সঙ্গে খেলতেন। আব্বু সব সময় আমাদের পড়াশোনার ব্যাপারে উৎসাহ দিতেন। আমাদের কারও পরীক্ষা একটু খারাপ হলে বাসায় আসার পর আমাদের নিয়ে বসতেন এবং হিসাব কষে দেখতেন আমরা কত নম্বর পাব। দেখা যেত তিনি যা হিসাব করে দিয়েছেন তার থেকে ১ কি ২ নম্বর হয়তো কমবেশি হয়েছে। আমরা যদি পড়াশোনার জন্য জেগে থাকতাম রাতে আব্বুও আমাদের সঙ্গে জেগে থাকতেন। আমরা কখনো অসুস্থ হলে আব্বু-আম্মু রাত জেগে আমাদের পরিচর্যা করতেন। আমার বাবা আমাদের নিয়ে বিভিন্ন দর্শনীয় জায়গা ভ্রমণ করেছেন। আমার মনে পড়ে আমরা তখন খুব ছোট, সে সময় বঙ্গবন্ধু কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ঢাকায় নিয়ে এসেছেন এবং ধানমন্ডির একটি বাড়িতে কবিকে থাকতে দিলেন। আব্বু আমাদের বগুড়া থেকে ঢাকায় নিয়ে এসে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করাতে নিয়ে গিয়েছিলেন। আমার বাবা আমাদের সব প্রেরণার উৎস। আমাদের মানুষ করে গড়ার পেছনে আমার মা-বাবার অবদান সবচেয়ে বেশি। আমার বাবার লেখার অভ্যাস ছিল। তিনি বহু ধর্মীয় গান এবং কবিতা লেখেন, যার মধ্যে কিছু লেখা আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। আব্বু ২০০৬ সালের জুলাইয়ে আমাদের ছেড়ে না-ফেরার দেশে চলে যান। আব্বু আপনাকে আমরা ভুলিনি, আমাদের সব সাফল্যে আপনাকে আমরা মনে করি। আপনি আমাদের প্রেরণা, প্রতিদিন প্রতি ক্ষণে আপনাকে আমরা মনে করি। আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসিব করুন।

আমার মা একজন সংগ্রামী মহিলা। মা আমাদের খুব কষ্ট করে মানুষ করেছেন। মধ্যবিত্ত পরিবারে বেড়ে ওঠা আমরা কখনই সংসারের কোনো অসুবিধার কথা বুঝতে পারিনি। মা আমাদের সংসারের কথা ভাবতে মানা করতেন। তিনি বলতেন, তোমরা ভালোভাবে লেখাপড়া করে ভালো মানুষ হও, শুধু লেখাপড়া করলে হবে না, তোমাদের সৎ ও আদর্শবান মানুষ হতে হবে। মা আমাদের সব সময় সত্য কথা বলতে, অন্যায় কাজ থেকে বিরত থাকতে শিক্ষা দিতেন। সব মা-ই হয়তো তাই করেন। মা বলতেন ভুলবশত তোমাদের দ্বারা কোনো অন্যায় হয়ে থাকলে তোমরা তা অন্তত বাবা-মাকে বলবে, তাদের কাছে কিছু লুকাবে না, আমরা যদি মার কাছে কোনো কিছু আবদার করতাম আম্মু সব সময় বলতেন আমি তোমার আবদার রক্ষা করব। একদিন তাঁকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি তো আমাদের সব আবদার রক্ষা করতে পারবে না, তবে কেন বল আবদার রক্ষা করবে। তখন আমার মা বলেছিলেন, আমি চেষ্টা করব যখন সেটা সম্ভব হবে পূরণ করব। মা আমাদের লেখাপড়ার ব্যাপারেও বেশ সচেতন ছিলেন। আমাদের বাসায় নিয়ম ছিল সন্ধ্যার পর সব ভাইবোন একসঙ্গে পড়তে বসব। পড়া শেষ করে তবেই টেলিভিশন দেখার সুযোগ হবে। তখন টেলিভিশনই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। এ ছাড়া আমার মা আমাদের রেজাল্ট ভালো হলে মাঝেমধ্যে কোনো ইংরেজি বা ভালো বাংলা সিনেমা দেখাতে নিয়ে যেতেন। আম্মু নিজেও খুব বই পড়তেন। ধর্মীয় বই ছাড়াও গল্পের বই পড়তেন প্রচুর। আমাদেরও গল্পের বই কিনে দিতেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে আমার মায়ের খুব ভালো সম্পর্ক। আমার মা আমাদের আত্মীয়স্বজনের খুব প্রিয় মানুষ। ছোটবেলায় আমাদের সব সময় আত্মীয়স্বজনের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যেতেন এবং বলতেন আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা দরকার। ছোটবেলায় এঁদের সঙ্গে যোগাযোগ না থাকলে বড় হয়ে তোমরা আত্মীয়স্বজন চিনবে কী করে। আমার মা শুধু আত্মীয়স্বজন নয়, বাবা ও আমাদের বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রেখে চলেছেন সব সময়। মা আমাদের আদর্শ। আমরা তাঁর শিক্ষায় আমাদের ছেলেমেয়েদের শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছি। তাঁর আদর্শে তাদের বড় করেছি। মা এখনো আমাদের কাছে আমাদের মধ্যমণি হয়ে আছেন। মা দিবসে আল্লাহ রব্বুল আলামিনের কাছে প্রার্থনা- তিনি যেন আমার মাকে অনেক হায়াত দান করেন। অনেক দিন যেন আমাদের মা আমাদের সঙ্গে থাকেন। এ দোয়া করি আল্লাহর কাছে। আব্বুর জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা- রব্বির হাম হুমা কামা রব্বাইয়ানি সাগিরা।

লেখক : সদস্য (অর্থ), নির্বাহী বোর্ড, বাংলাদেশ রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকা কর্তৃপক্ষ।

সর্বশেষ খবর