রবিবার, ২৩ মে, ২০২১ ০০:০০ টা

কূটনীতি : প্রগতি ও সম্প্রীতি

ওয়ালি-উর রহমান

কূটনীতি : প্রগতি ও সম্প্রীতি

১৯৭২ সালে মার্চের শেষে একটি টেলিফোন পেলাম। ওপাশে বঙ্গবন্ধু, বললেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্টের একটি ড্রাফট পাঠালাম, তুই একটু দেখ তো। এই মহান মানুষটি সম্পর্কে যখনই বলতে বা লিখতে যাই তখনই কেমন জানি আনমনা হয়ে যাই। কত কাছ থেকে দেখেছি, জেনেছি, উপলব্ধি করেছি তাঁর অসাধারণ ভাবনাগুলোকে এবং তাঁর সংস্পর্শে থেকে তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী কাজ করেছি, অনেক কিছু শিখতে পেরেছি।  আমি যতবার ভাবী তাঁর কথা, অবাক হই তাঁর চিন্তার পরিধি দেখে, দর্শনের গভীরতা দেখে। মনে হয় ফ্রেডরিখ নিটশের কথা। তিনি বিভিন্ন সময়ে বলতেন, ‘হতাশ হবে না। প্রাথমিক অবস্থায় কষ্ট হবে- সে রাজনীতি হোক, সে অর্থনীতি হোক’। তাই তাঁর বিখ্যাত উক্তি, If you look at the Ravine below, the Ravine will soon look at you and swallow you.. ওপরে তাকাও, সামনে তাকাও।

বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তগুলোও এরূপ দর্শনের ওপরই দাঁড়িয়ে ছিল। তাই তিনি একজন রাজনীতিবিদই ছিলেন না, তিনি একজন দার্শনিকও ছিলেন। ডিপ্লোম্যাসি ও পররাষ্ট্রনীতির চিন্তাভাবনায় ছিলেন সম্পূর্ণ ব্যতিক্রমধর্মী। বঙ্গবন্ধু ও স্বাধীন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি ছিল দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয়।

বঙ্গবন্ধু যে সোনার বাংলা গড়ার ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সেই অসমাপ্ত কাজের নেতৃত্ব দিয়ে দেশকে উপস্থাপন করেছেন এক আদর্শিক মডেল হিসেবে, হোক তা অর্থনীতি কিংবা পররাষ্ট্রনীতি।

একসময় বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করা হতো যে রকমটি বলেছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। জুস্ট ফালেন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ ইজ আ টেস্ট কেস অব ডেভেলপমেন্ট’। সেই জায়গা থেকে বিশ্বব্যাংকের মতে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক উন্নয়নের আদর্শ। আমাদের পর্যবেক্ষণে পর্যায়ক্রমে ২০৩১-এ মধ্যম ও ২০৪১-এর মধ্যেই উন্নত দেশে রূপান্তরিত হব। 

প্রাইস ওয়াটার হাউস কুপার্সের তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশ ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ২৯তম এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ২৩তম অর্থনীতিতে উন্নত দেশে পরিণত হবে। সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ এখন খাদ্য নিরাপত্তা, শান্তিচুুক্তি, সমুদ্র বিজয়, নারীর ক্ষমতায়ন, অর্থনৈতিক উন্নতিতে অনুকরণীয় আদর্শ। বর্তমান সরকার আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সদ্ভাব রেখে ভারসাম্যের কূটনীতি প্রতিষ্ঠা করেছে এবং এর সুফলও পাচ্ছে। বৈশ্বিক ও আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে চীন-ভারত, যুক্তরাষ্ট্র-রাশিয়া, চীন-জাপান এবং চীন-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব এখন আর অজানা বিষয় নয়। বাংলাদেশ প্রভাবশালী এ দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক এবং ক্ষেত্রবিশেষ কৌশলগত সামরিক সহযোগিতারও সম্পর্ক গড়ে তুলতে পেরেছে। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ও কৌশলগত সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে বিগত ১০ বছরে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। চীন, ভারত, জাপানসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্টে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বাংলাদেশ বিভিন্ন দ্বিপক্ষীয় ও আঞ্চলিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। সাফটা, বিমসটেক, আপটা, ডি-৮, পিটিএ, এফটিএ এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশ একটি স্ট্র্যাটেজিক প্লেয়ার হিসেবে ভূমিকা পালন করছে। এটি যেমন আঞ্চলিক সংস্থাসমূহ বিমসটেক, বিসিআইএম, বিআরআই, বিবিআইএনের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনিভাবে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। উল্লেখযোগ্যভাবে চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্রসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশসমূহের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিগত ১০ বছরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ, ন্যামসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় করণীয় বিষয়ে বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সমুন্নত করেছেন। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অপারেশনে বাংলাদেশের প্রথম চুক্তির সময় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল পেরেজ দে কুইলার ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী হুমায়ূন রশীদ চৌধুরী এবং আমি উপস্থিত থেকে চুক্তি করলাম। ১৮ জনের দল দিয়ে শুরু করে ইরাকে, বর্তমানে প্রতি বছর হাজার হাজার বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে যাচ্ছে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনীতে বাংলাদেশ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশ হিসেবে শীর্ষস্থান দখল করে আছে। ভবিষ্যতেও বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রেখে যাবে। রোহিঙ্গা সংকট আমাদের জন্য একটি সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গাম্বিয়ার সৌজন্যে আমরা আইসিজেতে পক্ষে রায় পেয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা এটির শান্তিপূর্ণ সমাধান প্রত্যাশা করি। মিয়ানমার ও ভারতের সঙ্গে কমপিট করে যৌক্তিক সমুদ্রসীমা নির্ধারণের মাধ্যমে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে স্বতন্ত্রভাবে কমপিট করার সক্ষমতা দেখিয়েছে। মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জন্য একটি আদর্শ হিসেবে উপনীত হয়েছে। পাশাপাশি ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট আন্তর্জাতিক আইনের পরিমার্জন ও পরিবর্ধনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। আমি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের অ্যাডভাইজার হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করছি।

পদ্মা সেতু তৈরিতে বিশ্বব্যাংকের পক্ষপাতদুষ্ট নীতির প্রতি নতিস্বীকার না করে বাংলাদেশ বিশ্ব রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে স্বতন্ত্র স্ট্র্যাটেজিক প্লেয়ার হিসেবে সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ করেছে।

আজ আমি পেছন ফিরে দেখি একটা দেশ যখন বড় হয়, দরকার হয় নেতৃত্বের। মার্কিন মুলুকে জর্জ ওয়াশিংটন না থাকলে ডিক্লারেশন অব ইনডিপেনডেন্স হতো না। ঠিক একইভাবে নেপোলিয়ান এবং ডি গল দিয়েছেন আধুনিক ফ্রান্স। আর মজ্জিনি ও গ্যারিবল্ডি দিয়েছেন ইতালি। ম্যাগনাকার্টা ব্রিটেনকে দিয়েছে আধুনিক দেশ, দিয়েছে আইনের শাসন। মাও সে তুং দিয়েছেন চীন। মহাত্মা গান্ধী এবং নেহরু আধুনিক ভারত সৃষ্টি করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দিয়ে গেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।

লেখক : সাবেক সচিব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সর্বশেষ খবর