সোমবার, ৩০ আগস্ট, ২০২১ ০০:০০ টা

শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সংস্কৃতি

ফনিন্দ্র সরকার

শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী সংস্কৃতি

জন্মাষ্টমী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের প্রাণের উৎসব। কেননা শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন সনাতন ধর্মের প্রাণপুরুষ। শ্রীকৃষ্ণ পুরুষোত্তম স্বয়ং ভগবান হিসেবে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের হৃদয় মন্দিরে উদ্ভাসিত। পৌরাণিক কাহিনিতে শ্রীকৃষ্ণের জন্ম বৃত্তান্তে অলৌলিকত্বের মহিমা দেদীপ্যমান। সনাতন ধর্ম একটি পথ। ভক্ত ও ভগবানের নৈকট্য স্থাপনে সনাতন ধর্ম সহজতর পথ হিসেবে ভূমিকা রেখে আসছে। এ পথের শিক্ষা হচ্ছে- ভক্তি ও প্রেম। ব্যাপক অনুভূতি এবং গাঢ় শিহরণ জেগে ওঠে ভক্তিপ্রেমে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভক্তি ও প্রেমের ধরা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। মহাশক্তি এক ঈশ্বরই যুগে যুগে নতুন নতুন রূপ ধারণ করে ভক্তের কল্যাণে আবিভর্‚ত হন ধরাধামে। সব বৈরিতা, তমসা অপসারণে প্রেম ও ভক্তিরসে ভরিয়ে দিতে ঈশ্বর নিজেই নিজেকে সৃষ্টি করেন মানবরূপে। তাঁর বৈচিত্র্যময় লীলাবিলাসে মানব সভ্যতার সংস্কৃতিকে পরিপুষ্টি দান করে। পরম সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে কবি নজরুল বলেছেন, ‘তুমি বহুরূপী, তুমি রূপহীন তব লীলা হেরি অন্তবিহীন।’ এ ধরণীতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ওই একই উদ্দেশ্যে ঘটেছে। শ্রীমদ্ভাগবতে আছে- ‘অণুগ্রহায় ভূতানাং মানুষং দেহমাস্থিতঃ

ভজতে তাদৃশীক্রীড়া যাঃ শ্রুত্বা তৎপরো ভবেৎ’||

অর্থাৎ ভক্তের প্রতি অনুগ্রহ করে মনুষ্যদেহ ধারণ করত মানুষের মতো আচরণগত বৈশিষ্ট্যে মানবকে আকৃষ্ট করেন। আবার গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- ং‘যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত।

অভ্যুত্থানধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্’||’

এর অর্থ হচ্ছে- যখন ধর্মের গ্লানি এবং অধর্মের প্রার্দুভাব ঘটে তখন ধর্ম রক্ষার্থে আমি নিজেকে সৃষ্টি করি। শ্রীকৃষ্ণে আবির্ভাব এরই ফলশ্রুতি। আত্মমায়া অবলম্বনে তিনি জন্মগ্রহণ করেন বলে একে অ-প্রকৃতি বলা হয়। উল্লেখ্য শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাবকালটি ছিল খুবই গ্লানিময়, ধর্মের জন্য অবমাননাকর; প্রজা নিপীড়নে মত্ত অত্যাচারী রাজাগণ মুনি-ঋষিদের এবং ভক্তদের ধর্মানুশীলনে বাধা সৃষ্টি করে মানবজীবনকে দুর্বিষহ করে তুলেছিল। এ ধরণীমাতা পাপাচার সহ্য করতে পারছিল না। এর প্রতিবিধানকল্পে ধরিত্রীমাতা দ্বারস্থ হলেন ব্রহ্মসত্তায় সত্তান্বিত পরম সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার কাছে। তখন ধরিত্রীমাতা এই জেনে আশ্বস্ত হলেন যে, পরম বিষ্ণু শ্রীকৃষ্ণ নামে অবতার হয়ে মানব কল্যাণে আবিভর্‚ত হবেন। ভগবানের লীলা বিলাসের পরিপূর্ণতার লক্ষ্যে সব দেবতাও জন্মগ্রহণ করতে লাগলেন মথুরা বৃন্দাবনে। এদিকে ভারতবর্ষের মথুরা নগরীর অত্যাচারী রাজা উগ্রসেন যদু বংশীয় মানব। তার পুত্র কংস রাজত্ব গ্রহণ করে মথুরাকে পাপাচারে ভরিয়ে দেন। উগ্রসেনের এক ভ্রাতার নাম দেবক। দেবকের কন্যা দেবকী। সমদৃষ্টিসম্পন্ন চরিত্রবান, ন্যায়পরায়ণ বসুদেবের সঙ্গে দেবকীর বিবাহ হয়। উল্লেখ্য, দেবকীকে কংস খুবই স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। জাঁকজমকভাবে বিবাহ সম্পন্ন করে দেবকীকে রথে করে শ্বশুরালয়ে নিয়ে যান কংস। পথিমধ্যে কংস দৈববাণী শুনতে পান যে, এই দেবকীর অষ্টম গর্ভে যে সন্তানের জন্ম হবে সে-ই কংসকে বধ করবে। কংস সব মায়া মমতা ত্যাগ করে ভগ্নি দেবকীকে হত্যা করতে উদ্যত হন। বসুদেব প্রতিশ্রুতি দেন সব সন্তানই তিনি কংসের হাতে তুলে দেবেন। কংস বসুদেবসহ দেবকীকে কারাগারে বন্দী করে। এভাবে ষষ্ঠ সন্তান পর্যন্ত হত্যা করে কংস। সপ্তম গর্ভ নষ্ট বলে প্রচার করা হয়। তবে অচিন্তনীয় লীলার স্বার্থে শক্তিরূপা যোগমায়ার আদেশে দেবকীর গর্ভ আকর্ষণ করে বসুদেবের অপর পত্নী রোহিনীর গর্ভে স্থাপন করেন এবং বলরাম রূপে জন্মগ্রহণ করেন। অষ্টম গর্ভের সন্তানকে চুপিসারে গোকুল নগরীর নন্দপত্নী যশোদার কাছে রেখে আসে আর যশোদার কন্যা সন্তান যোগমায়াকে দেবকীর কোলে স্থাপিত করে কংসের হাতে তুলে দিলে কংস তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে যোগমায়া অদৃশ্য হয়ে কংসকে বলে, ‘তোমাকে বধিবে যে গোকুলে বাড়িছে সে।’ এসবই ভগবানের লীলা বৈচিত্র্য। পৌরাণিক উপাখ্যানে ব্যাপক কাহিনি লিপিবদ্ধ আছে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যদুবংশীয় সন্তান হয়ে বেড়ে ওঠতে থাকে। এরপর ভগবান লীলায় অত্যাচারের নানা উপাখ্যান দৃশ্যত হয়। সে উপাখ্যান স্বল্প পরিসরে বর্ণনা করা সম্ভব নয়। ভাদ্র মাসের রোহিনী নক্ষত্রযোগে অষ্টমী তিথিতে শ্রীকৃষ্ণের আবির্ভাব ঘটে বলে এই তিথিকে শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী তিথি বলা হয়।  প্রকৃতপক্ষে মহাশক্তি ভগবানের জন্ম-মৃত্যু বলতে কিছু নেই। মানব জাতিকে শিক্ষার জন্যই এই জন্মতিথি। অনাচার, পাপাচার ধ্বংসকল্পে ভগবান যুগে যুগে অবতার হয়ে জন্ম নেন মানুষরূপে। সনাতন ধর্মে এ বিশ্বাসই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ভগবান যিনি সদাসর্বদা জ্ঞান, ঐশ্বর্য, শক্তি, বল, বীর্য ও তেজের অধিকারী যিনি তাঁর সর্বব্যাপী মায়া মূল প্রকৃতিকে তার ত্রিগুণ (সত্ত¡, রজঃ তমঃ) সহ বশীভূত করে রাখেন, তিনি স্বয়ং জন্মরহিত, অব্যয়, সর্বভূতের ঈশ্বর এবং স্বরূপ নিত্য-শুদ্ধ-মুক্ত স্বভাব হয়েও মায়ার মাধ্যমে যেন জাত ও দেহধারীরূপে প্রতীয়মাণ হন। জগৎ কল্যাণের জন্য তাঁকে ক্রিয়াশীল থাকতে দেখা যায়। ভগবানের নিজের কোনো প্রয়োজন না থাকলেও শুধু জীবের মঙ্গলের জন্য তিনি আবিভর্‚ত হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা উপদিষ্ট সনাতন ধর্ম সর্বজ্ঞ বেদ ব্যাসের মাধ্যমে ৭০০ শ্লোকবিশিষ্ট গ্রন্থ সুপ্রসিদ্ধ গীতায় রূপান্তিরত হয়েছে। গীতা একটি বিজ্ঞান, বেদসমূহের সমগ্র শিক্ষার সার সংগ্রহ কিন্তু এর অর্থ দুর্বোধ্য। শ্রীকৃষ্ণ জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানটি বিভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পারস্পরিক ভাব বিনিময় ঘটাতে অপরিহার্য। এ পার্বণ সম্পূর্ণভাবে জীবনমুখী করতে প্রয়োজন দূরদর্শী আন্দোলনের সেই সঙ্গে দূরদর্শী নেতৃত্বের। ধর্মীয় বহুবিধ সংস্কৃতির পারস্পরিক আদান-প্রদানের ভাবটি অতি মহৎ। বস্তুত এ রকম আদান-প্রদানের কালেই উৎপন্ন হয়েছে আধুনিক সভ্যতা। মানব প্রগতি সম্বন্ধে এক সার্বিক ভাবনার বিস্তার ঘটায় জন্মাষ্টমী সংস্কৃতি। ভক্তি ও প্রেমভাবে মানব জাতি ধর্মীয় উৎসবগুলো পালন করতে পারলে দুই দিক থেকেই কল্যাণকর।

লেখক : কলাম লেখক।

সর্বশেষ খবর