সোমবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ‘সেবা’ আদর্শ

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিমের ‘সেবা’ আদর্শ

জাতীয় অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ ইব্রাহিম (১৯১১-১৯৮৯) চিকিৎসসেবা সম্পর্কে একটি অভিনব-অনুপম এবং বিশিষ্টতায় মতি আদর্শের প্রবক্তা, যা ‘ইব্রাহিম মডেল’ নামে পরিকীর্তিত। আজীবনের রোগ ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ ও চিকিৎসা উপলক্ষে এ রোগের আধুনিকতম গবেষণার সঙ্গে ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার বাস্তব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার পথিকৃৎ ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। ঢাকার সেগুনবাগিচাতে নিজস্ব চিকিৎসা কক্ষে এবং নিজের ব্যক্তিগত যন্ত্রপাতি দিয়ে তিনি ডায়াবেটিস চিকিৎসালয়ের সূচনা করেছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বিশ্বের অন্যতম ডায়াবেটিক সমিতি। তার এ অনন্য ও মেধাবী প্রয়াস শুধু গবেষণাতে সীমিত থাকেনি তিনি এটিকে একাধারে গবেষণা ও গবেষণা ফলাবর্তনানুসারী ক্লিনিক্যাল চিকিৎসার উপায় ও উপলক্ষ নির্মাণ করেছিলেন, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। প্রাথমিকভাবে মাত্র ২৩ জন রোগীর ওপর গবেষণা ও তাদের চিকিৎসা অগ্রগতি তথা তাদের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মাত্রা ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থাও তিনি চালু করেছিলেন। পরবর্তীকালে রোগীর সংখ্যা বেড়ে গেলে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও অন্যান্য চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সমন্বয় সমঝোতার মাধ্যমে রোগী রেফার করে চিকিৎসা করতেন। উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় শাহবাগে সরকার প্রদত্ত জমিতে সরকারি অর্থায়নে ১৯৮২ সালে যে বিশাল স্থাপনা ক্রমান্বয়ে গড়ে ওঠে তা পরবর্তীকালে ইব্রাহিম সেন্টার তথা অধুনা বারডেম নামে সুনাম ও সুখ্যাতি অর্জন করে। সেখানে তিনি ডায়াবেটিক চিকিৎসাকে সহযোগী রোগভিত্তিক (চোখ, লিভার, কিডনি, হার্ট, হাইপারটেনশন, ইএনটি, দাঁত প্রভৃতি) ক্ষেত্রেও সাধারণ চিকিৎসাব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন। শুধু ডায়াবেটিস রোগীদের বিনামূল্যে বিশেষ কয়েকটি ল্যাবটেস্ট (রক্তের গ্লুকোজ, ইউরিয়া, ক্রিটেনিন, টিজি, কোলেস্টেরল, ইউরিন) ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাইকে ফ্রি এবং তাদের আউটডোরে চিকিৎসকদের কাছ থেকে ফ্রি (ইদানীং একটি টোকেনমানি গ্রহণ করা হয়) পরামর্শ দেওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। শুধু বারডেমের আউটডোরে বর্তমানে প্রতিদিন গড়ে প্রায় চার হাজার ডায়াবেটিস রোগী বিনামূল্যে ল্যাবটেস্ট ও চিকিৎসা পরামর্শ পেয়ে আসছেন। দেশব্যাপী ডায়াবেটিক সমিতির ৬৩টি জেলায় অধিভুক্ত ও ১৪টি উপজেলায় সাব অধিভুক্ত সমিতি এবং ঢাকা মহানগরী ও এর উপকণ্ঠে বিস্তৃত আরও ২৮টি স্যাটেলাইট চিকিৎসা কেন্দ্রে প্রতিদিন গড়ে প্রায় আরও ১০ হাজার ডায়াবেটিস রোগী চিকিৎসাসেবা পরামর্শ পাচ্ছেন। ডায়াবেটিস রোগের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক সংশ্লিষ্ট অন্যান্য অসংক্রামক রোগসমূহের চিকিৎসাব্যবস্থা (অ্যান্ডোক্রাইনোলজি, জিএইচপিডি, মেডিসিন, ইএনটি, ডেন্টাল, হার্ট, কিডনি, লিভার, চোখ, চর্ম, ফুটকেয়ার, নেফ্রোলজি, নিউরোলজি. ফিজিওথেরাপি প্রভৃতি) বারডেমসহ সমিতির সব প্রতিষ্ঠানে গড়ে তোলা হয়েছে যাতে ডায়াবেটিস ও নন ডায়াবেটিস রোগী নির্বিশেষে ওয়ান স্টপ চিকিৎসাসেবা পেতে পারে। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির মিশন ও ভিশনে গবেষণাপ্রসূত বাস্তবানুগ জেনারেল চিকিৎসাসেবার এ দর্শনটি উৎকলিত আছে। তিনি মনে করতেন সার্বিক এবং সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যতিরেকে একজন ডায়াবেটিস রোগী ডায়াবেটিক রোগ নিয়ন্ত্রণে সক্ষম হবে না বা তার পক্ষে দীর্ঘমেয়াদে সার্বিক সুস্থতাবোধ করা সম্ভব নয়। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসাব্যবস্থাকে তাঁর সামাজিক আদর্শের দর্শনের সঙ্গে একীভূত করেছিলেন বলেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির চিকিৎসাসেবায় ‘আমাদেরকে সেবা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য আমরা কৃতজ্ঞ’ মূল মর্মবাণীতে রূপান্তরিত হয়েছে। অর্থাৎ সেবা গ্রহণকারীই সেবকের কাছ থেকে কৃতজ্ঞতার স্বীকৃতি পাচ্ছে যেটি সচরাচর কোথাও কখনো পরিলক্ষিত হয় না বা হয়নি। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিমের সেবা আদর্শের মূল্যবোধ ও উজ্জ্বল্য এখানেই নিহিত। জাতীয় অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ডায়াবেটিক রোগের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় প্রত্যেক রোগীকে স্বাবলম্বী, সচেতন ও দায়িত্বশীল করে তোলার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেছেন। যদ্দরুন বারডেমে যখন একজন নতুন রোগী আসে তখন তাকে পর্যায়ক্রমে একটা সচেতনতা কর্মসূচি (রোগীর হিস্ট্রি গ্রহণ, একটি সব্যাখ্যাত গাইডবইয়ে সবকিছু লিপিবদ্ধকরণের ব্যবস্থা করা, একটি বিশেষ লেকচার সেশনে যোগ দিয়ে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের বিভিন্ন দিক জানার সুযোগ দান) এবং তাকে নির্ধারিত সময়ান্তে নিয়মিত পরীক্ষা পরামর্শের জন্য হাসপাতালে আসার ব্যবস্থা প্রবর্তন করেন। গাইডবই কনসেপ্টটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত কার্যকর এবং অর্থবহ। প্রতিটি রোগীর চিকিৎসা অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য এটি শুধু চিকিৎসক নয় রোগীর জন্য একটি স্বপ্রণোদিত ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট। ডায়াবেটিক চিকিৎসায় ইতবিক্ষিপ্তভাবে, অনিয়মিত অবসরে প্রেসক্রিপশন প্রদানের কোনো ব্যবস্থা নেই। সবকিছুই গাইডবইয়ে রেকর্ডকরণের সুন্দর ব্যবস্থা রয়েছে। গাইডবইটি নিয়ে ডাক্তারের কাছে গেলেই রোগীকে কিছুই বলতে হয় না। চিকিৎসক গাইডবই দেখলে রোগীর আদ্যোপান্ত চিকিৎসার ইতিহাস ও সারমর্ম জানতে পারেন। প্রতিটি রোগীর গাইডবইয়ে একটি রেজিস্ট্রেশন নম্বর আছে। যেটি ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে তার আইডি নম্বর। এ গাইড বই নিয়ে রোগী ডায়াবেটিক সমিতির যে কোনো প্রতিষ্ঠানে (ঢাকা শহরে ২৮টি স্যাটেলাইট সেন্টার, ঢাকার বাইরে ৬৩টি এফিলিয়েটেড অ্যাসোসিয়েশন ও ১৪টি সাব এফিলিয়েশন কেন্দ্র) গিয়ে চিকিৎসা গ্রহণ করতে পারবে। সমিতির প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে রোগীকে আইডি নম্বর দেওয়া ও গাইডবই নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। এ বই বহনকারী যে কোনো রোগী প্রয়োজনবোধে (ভ্রমণকালীন) নিকটস্থ প্রতিষ্ঠানে চিকিৎসা নিতে পারবে। এটি একটি দেশব্যাপী বিস্তৃত চিকিৎসা নেটওয়ার্ক। জাতীয় অধ্যাপক ইব্রাহিম চিকিৎসা মানব সম্পদ তৈরির স্থায়ী ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য বারডেম একাডেমি এবং নার্সিং ইনস্টিটিউট, আরভিটিসি ও বারটান গড়ে তোলেন। এরই সূত্র ধরে বা ভিত্তিতে পরবর্তীকালে সমিতি ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ, নর্থবেঙ্গল মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস (বিইউএইচএস), বারডেম নার্সিং কলেজসহ বহু প্রতিষ্ঠানে গবেষণা ও চিকিৎসা ডিগ্রি প্রদানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।

লেখক : সরকারের সাবেক সচিব, বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির কাউন্সিল সদস্য।।

সর্বশেষ খবর