মঙ্গলবার, ৩০ নভেম্বর, ২০২১ ০০:০০ টা

সুনীল অর্থনীতির বহুমুখী গবেষণা

শাইখ সিরাজ

সুনীল অর্থনীতির বহুমুখী গবেষণা

বলা হচ্ছে সমুদ্রই আগামীর খাদ্যের আধার। বর্ধিত জনসংখ্যার পুষ্টিকর খাদ্যের জোগান দিতে সমুদ্রের ওপর নির্ভর করতে হবে আমাদের। এ জায়গাটিতে এসে বঙ্গোপসাগর নিয়ে আমাদের আশার জায়গাটি অনেক বেড়ে গেছে। বিশেষ করে ২০১২ সালের ১৮ মার্চ মিয়ানমারের সঙ্গে এবং ২০১৪ সালের ৭ জুলাই ভারতের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ মামলায় বাংলাদেশের জয়লাভ বিরাট এক সম্ভাবনার দরজা খুলে দিয়েছে। বাংলাদেশ ১ লাখ ১৮ হাজার ৮১৩ বর্গকিলোমিটার সমুদ্র অঞ্চল, ২০০ নটিক্যাল মাইলের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং চট্টগ্রাম উপকূল থেকে ৩৫৪ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত মহীসোপানে অবস্থিত সব ধরনের প্রাণিজ ও অপ্রাণিজ সম্পদের ওপর সার্বভৌম অধিকার লাভ করেছে। সমুদ্রসীমায় রচিত হয়েছে আরেক বাংলাদেশ। পৃথিবীর অর্থনীতিতে সমুদ্রের অবদান ১ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার। ৬০ মিলিয়ন বা ৬ কোটি মানুষ সমুদ্রকেন্দ্রিক জীবিকার ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। ২০১৮ সালের এক হিসাবে দেখা যায় সমুদ্র ক্ষেত্র থেকে মাছ ও মাছের উপাদান অর্জিত হয়েছে প্রায় ১৮ কোটি টন। যার বাজারমূল্য ৫০ হাজার কোটি মার্কিন ডলারের মতো। তিন ভাগ পানি ও এক ভাগ স্থলভাগের পৃথিবীতে ৮৩টি দেশের আয়তনের চেয়ে বড় সমুদ্রসীমা রয়েছে। ৫৪টি দেশের ৮০ ভাগ রয়েছে সমুদ্রসীমায়। এর মধ্যে বহু দেশের অর্থনীতিই সমুদ্রনির্ভর। সমুদ্রকেন্দ্রিক অর্থনৈতিক অর্জনের অনেক জায়গা এখনো হিসাব পরিসংখ্যানের বাইরে রয়ে গেছে। এখন সমুদ্রকেন্দ্রিক বহুমুখী গবেষণা তৎপরতা চলছে। একদিকে সমুদ্রে যে সম্পদ রয়েছে তা অনুসন্ধানের গবেষণা, আরেকদিকে সে সম্পদ সুরক্ষার গবেষণা। একই সঙ্গে সমুদ্রসীমায় প্রান্তিক মানুষের জীবন-জীবিকা ও অর্থ উপার্জনভিত্তিক কর্মকান্ড চালুর জন্যও চলছে নানামুখী প্রয়াস। এ প্রয়াসে যুক্ত হয়েছে চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয় (সিভাসু)। সিভাসুর ভিসি গৌতম বুদ্ধ দাশের সঙ্গে আমার পরিচয় গত শতকের আশির দশক থেকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে ‘মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠান করার সময় থেকে। তিনি তখন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা। তার মোটরসাইকেলে চড়ে বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় অনুষ্ঠান ধারণ করার অভিজ্ঞতা হয়েছে। যা হোক, গৌতমের আমন্ত্রণে কক্সবাজারের দারিয়ানগর বহুছড়ায় গড়ে তোলা চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন ‘কোস্টাল বায়ো ডাইভারসিটি অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ ইনস্টিটিউট’ দেখতে গিয়েছিলাম। এরই মধ্যে শুরু হয়েছে এ ইনস্টিটিউটের গবেষণা কার্যক্রম। দারিয়ানগর সমুদ্রতটে গিয়ে চোখে পড়ল নানা আয়োজন। পানির ওপরে বাঁশের অবকাঠামো তৈরি করে সেখানে চাষ হচ্ছে ঝিনুকের। যার আরেক নাম ‘গ্রিন মাসল’। সেখানকার গবেষকরা বলছেন এ এলাকায় গ্রিন মাসলের পরিকল্পিত চাষ দারুণ সম্ভাবনাময়। এখানে গবেষক হিসেবে যারা কাজ করছেন তারা সবাই চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের চতুর্থ বর্ষের ইন্টার্ন শিক্ষার্থী। গ্রিন মাসলের চাষ ও সম্ভাবনার সব দিক নিয়ে বিস্তর গবেষণার আলোকেই শিক্ষার্থীদের নিয়মিত ধারণা দিচ্ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক ড. আসাদুজ্জামান। তিনি গ্রিন মাসল চাষের নানা বিষয় তুলে ধরলেন। ড. আসাদ বলেছেন এর বিরাট অর্থনৈতিক সম্ভাবনা, বাজার চাহিদা ও উৎপাদন প্রক্রিয়ার গল্প। ঝিনুক যেমন পুষ্টিকর, তেমনি স্বাদযুক্ত দামি খাবার। বাইরের দেশে এর বিশাল চাহিদা। গ্রিন মাসল চাষ করার মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণের একটা বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে। তিনটি পদ্ধতিতে গ্রিন মাসল চাষ করে দেখছেন কোন পদ্ধতিটি সবচেয়ে লাগসই। ঘুরে ঘুরে দেখালেন কোথাও বাক্স পদ্ধতিতে, কোথাও নেট ব্যবহার করে আবার কোথাও রশি পদ্ধতিতে ঝিনুক চাষ করছেন তারা। চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘কোস্টাল বায়ো ডাইভারসিটি অ্যান্ড মেরিন ফিশারিজ ইনস্টিটিউট’-এর আওতায় এ গ্রিন মাসলের উৎপাদন সম্প্রসারণ ও প্রান্তিক জেলেদের জীবন-জীবিকার ব্যাপারেও চলছে নানামুখী গবেষণা। স্থানীয় লোকজন যারা অনিয়ন্ত্রিতভাবে সমুদ্র থেকে ঝিনুক সংগ্রহ করতেন তাদের কাজে লাগিয়েছেন। তাদের প্রশিক্ষিত করার মাধ্যমে প্রাকৃতিক ঝিনুক যেমন সংরক্ষণ করা সম্ভব হচ্ছে, তেমনি বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যাচ্ছে। ড. আসাদ জানালেন ঝিনুক চাষে তেমন খরচই নেই। শুধু একটা বাঁশের কাঠামো তৈরি করা। সমুদ্রের পানি থেকেই যথেষ্ট খাবার পায় তারা। সাত থেকে আট মাসে হার্ভেস্ট উপযোগী হয়ে ওঠে। সামুদ্রিক শৈবাল ও গ্রিন মাসল পরিবেশবান্ধব। সমুদ্রের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখতে ভূমিকা রাখে। ইন্টার্ন শিক্ষার্থীরা তাদের একাডেমিক গবেষণার অংশ হিসেবে যেসব কাজ শুরু করেছেন তার একটি হচ্ছে বাগদা চিংড়ির কৃত্রিম প্রজননের পোনা নিয়ে গবেষণা। এ বিষয়ে কথা হলো শিক্ষার্থী অন্তর সরকারের সঙ্গে। তিনি জানালেন, অনেকেই বলে হ্যাচারি থেকে নেওয়া চিংড়ির পোনার চেয়ে প্রাকৃতিক উৎস থেকে পাওয়া চিংড়ি পোনা বেশি ভালো। কিন্তু অন্তর সরকার এ পর্যন্ত গবেষণার মধ্য দিয়ে যে ফল অনেকটা হাতে আনতে পেরেছেন তা হলো চিংড়ি চাষিরা প্রাকৃতিক উৎসের পোনার ওপর অধিক মাত্রায় নির্ভরশীল। তাদের এ নির্ভরশীলতার কারণে চিংড়ির রেণু পোনা ধরতে গিয়ে প্রতিনিয়ত ধ্বংস করা হচ্ছে সমুদ্রের বেশ কিছু মাছ ও অন্যান্য প্রাণীর রেণু পোনা। কিন্তু হ্যাচারির কৃত্রিম প্রজননের রেণু পোনা থেকেও সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে একই ফল পাওয়া সম্ভব। পাঠক! বলে রাখি বছর বিশেক আগেও প্রাকৃতিক উপায়ে চিংড়ি পোনা সংগ্রহের কারণে সামুদ্রিক প্রাণীর জাত ধ্বংস হচ্ছে বলে প্রতিবেদন ধারণ করেছিলাম। চিংড়ির রেণু পোনার সঙ্গে অন্যান্য প্রাণীর পোনা ধরে এনে চামচে করে চিংড়ির পোনা আলাদা করে রাখা হতো। আর বাকি পোনাগুলো নষ্ট করে ফেলা হতো। এতে অন্যান্য প্রাণীর জাত বিনষ্টের আশঙ্কার কথা বলেছিলাম। এরই প্রমাণ মিলল আবিদা সুলতানার গবেষণায়। আবিদা সুলতানা জানালেন, তাদের গবেষণা বলছে বাগদার রেণু পোনা ধরতে গিয়ে সব মিলিয়ে ৩৩ প্রজাতির মাছ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিভিন্ন প্রজাতির মাছের চারিত্রিক গঠন নিরূপণ, মাছের জীবন্ত প্রাকৃতিক খাদ্যের গবেষণাসহ নানান গবেষণা চলছে সেখানে। যেমন স্বাদু পানির কৃত্রিম প্রজনন যেমন সম্ভব হয়েছে, তারা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন সামুদ্রিক মাছের কৃত্রিম প্রজননের। এসব গবেষণা তত্ত্বাবধান করছেন মাৎস্যবিজ্ঞান অনুষদের সহযোগী অধ্যাপক শেখ আহমদ আল নাহিদ। তিনি জানালেন গবেষণার মাধ্যমে সমুদ্রের নতুন দিগন্ত উন্মোচনের চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে নতুন প্রতিষ্ঠিত এ ইনস্টিটিউটের গবেষণার সুযোগ-সুবিধা আরও বাড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তাদের দাবি লাইব্রেরি ফ্যাসিলিটি আরও বাড়ানোর। আমাদের দেশে সমুদ্রবিজ্ঞান নিয়ে তরুণ শিক্ষার্থী ও বিজ্ঞানীদের এ তৎপরতা আশা জাগানিয়া। মনে পড়ে দুই বছর আগে চীনের চিংদাওয়ে ওশান ইউনিভার্সিটিতে গিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞানের বৈচিত্র্যময় গবেষণার চিত্র দেখে দারুণ আশাবাদী হয়েছিলাম। সেখানে বাঙালি শিক্ষার্থীরা অপরিসীম স্বপ্ন নিয়ে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণায় নিয়োজিত। এ শিক্ষার্থীদের জন্য এখন সুযোগ তৈরি হচ্ছে দেশের মাটিতে এসে সমুদ্রবিজ্ঞান গবেষণার। বিশেষ করে শত বছরের যে ‘ডেল্টা প্ল্যান’ সেখানে সমুদ্রসম্পদের প্রাচুর্য নির্ধারণ ও বহুমুখী সম্ভাবনার দ্বার খোলার সুযোগ রয়েছে। বিষয়গুলো নিয়ে কথা বলেছি চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি ও এনিম্যাল সাইন্সেস বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. গৌতম বুদ্ধ দাশের সঙ্গে। তিনি জানালেন, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের গবেষণা কীভাবে করতে হয় তা শেখাচ্ছে, পাশাপাশি এ গবেষণাগুলো থেকে প্রাপ্ত ফলাফল তলিয়ে দেখছে। নতুন গবেষণার ক্ষেত্র চিহ্নিত করছে। জলবায়ু পরিবর্তন আর বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য সম্প্রসারণের এ যুগে প্রাকৃতিক সম্পদই একটি দেশের টেকসই অর্থনীতির সবচেয়ে বড় নিয়ামক। এ ক্ষেত্রে স্থলভাগের সর্বোচ্চ ব্যবহার এবং বহুমুখী কৃষি সাফল্য আমাদের খাদ্য নিরাপত্তায় এখন পর্যন্ত নিশ্চয়তা দিচ্ছে। আগামীর অর্থনৈতিক সম্ভাবনা রচনায় আমাদের সমুদ্রসম্পদের সুপরিকল্পিত ব্যবহার সময়ের সবচেয়ে বড় দাবি। এ বিবেচনায় আমাদের যতটুকু গবেষণা শুরু হয়েছে তা একেবারে প্রাথমিক বলা যায়। সমুদ্রসম্পদের আরও গভীরে গিয়ে আমাদের গবেষণার গতি বাড়ানোর তাগিদ এসেছে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠান যুগোপযোগী গবেষণার উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে যাবে- এ প্রত্যাশা আমাদের। পর্যায়ক্রমে সমুদ্রসম্পদের বহুমুখী গবেষণার চিত্র তুলে ধরার ইচ্ছা রইল।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব। [email protected]

সর্বশেষ খবর