শুক্রবার, ২১ জানুয়ারি, ২০২২ ০০:০০ টা

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও আমাদের সতর্কতা

ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. বায়েজিদ সরোয়ার এনডিসি (অব.)

মিয়ানমারের গৃহযুদ্ধ ও আমাদের সতর্কতা

২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া মিয়ানমারের নতুন পর্যায়ের গৃহযুদ্ধের আগুন এখন আমাদের বান্দরবান সীমান্তের প্রায় কাছে এসে পৌঁছেছে। যুদ্ধের এ উত্তপ্ত ময়দানটি হলো চিন রাজ্য (স্টেট)। চিন হলো আরাকান ছাড়া মিয়ানমারের অন্য আরেক রাজ্য, যার সঙ্গে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ কিমি সীমান্ত রয়েছে। চিন এখন বাংলাদেশের নতুন মাথাব্যথার কারণ। চিনে গৃহযুদ্ধের প্রচ-তা বাংলাদেশের জন্য নতুন নিরাপত্তাঝুঁকি তৈরি করছে। এর ফলে আমাদের নিরাপত্তা ও কৌশলগত চিন্তা-ভাবনায়ও নতুন অনুষঙ্গ যুক্ত হলো।

চিন রাজ্য মিয়ানমারের পশ্চিমাঞ্চলে অবস্থিত অত্যন্ত অনুন্নত ও দরিদ্রতম একটি অঞ্চল। প্রায় ৩৬ হাজার বর্গকিলোমিটারের এ রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৫ লাখ। পার্বত্য প্রদেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলা, পশ্চিমে ভারতের মিজোরাম, উত্তরে মণিপুর রাজ্য এবং দক্ষিণে মিয়ানমারের আরাকান। পার্বত্য অঞ্চলটিতে প্রায় ৫৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস। মিয়ানমারে চিনই একমাত্র খ্রিস্টানপ্রধান রাজ্য। চিনে জান্তা সরকারের নৃশংসতায় চিনের প্রতিবেশী খ্রিস্টান অধ্যুষিত মিজোরাম, মণিপুর ও নাগাল্যান্ডের খ্রিস্টান অধিবাসীর মধ্যেও ক্ষোভ ও উত্তেজনা বাড়ছে, ধর্মীয় ও জাতিগত ঐক্যের জন্য। ২০২১ সালে চিন থেকে ভারতের মিজোরামে প্রায় ১৮ হাজার শরণার্থী এসেছে। সাবেক গেরিলা নেতা জোরামথাঙ্গার নেতৃত্বাধীন মিজোরাম সরকার তাদের আন্তরিকতার সঙ্গে আশ্রয় দিয়েছে। এর কারণও ধর্মীয় ও জাতিগত। এরা সবাই বৃহত্তর জোমি জাতিসত্তা। পার্বত্য চট্টগ্রামের কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সঙ্গেও চিনের অধিবাসীদের জাতিগত, সংস্কৃতিগত ও ধর্মীয় সম্পর্ক রয়েছে।

বর্ণিল জীবনের অধিকারী কামরুদ্দীন আহমদ (আইনজীবী, রাজনীতিক) বার্মায় রাষ্ট্রদূত থাকাকালে (১৯৫৮-১৯৬১) চিন প্রদেশে গিয়েছিলেন। তিনি এ বিষয়ে লিখেন, ‘চীন স্টেট পূর্ব বাংলার সীমান্ত বান্দরবানের দক্ষিণে অবস্থিত। চীন স্টেটের হেলিপেডে যখন আমরা নামলাম, তখন যেন একটা নতুন জগতে চলে এলাম। বড়দের সবার হাতে বর্শা। মাথায় পাখির পালকের টুপি। কাপড় পরিধানে নেই বললেই চলে। আমি তাদের পাশের দেশেরই লোক। তাই শুনে তারা তো ভারি খুশি।’ (বাংলার এক মধ্যবিত্তের আত্মকাহিনী, কামরুদ্দীন আহমদ)।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় চিন রাজ্যের সঙ্গে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকার যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল এবং চিন আলোচনায় এসেছিল ভিন্ন এক পরিপ্রেক্ষিতে। ১৯৪২ সালে জাপানি বাহিনীর আক্রমণে রেঙ্গুনের পতনের পর সমগ্র বার্মা তাদের দখলে আসে। ১৯৪৩ সালে জাপানি বাহিনীর সঙ্গে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর নেতৃত্বাধীন আজাদ হিন্দ ফৌজ বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (আইএনএ) কয়েকটি সেনা দল চিন ও কালাদান উপত্যকায় অভিযান পরিচালনা করেছিল। জাপানিজ বাহিনী ও আইএনএর সেনা দল এ সময় চিনের পালেটোয়া, দালেতমি দখলের পর বান্দরবানের মোদক (থানচি উপজেলা) দখল করে। জাপান ও আইএনএ ইউনিট মোদক ও আলিকদমের পাশের এলাকায় টহল পরিচালনা করে। আজাদ হিন্দ ফৌজের (সুভাষ ব্রিগেড) মেজর পি এস রাতুরীর পরিচালনায় ১ নম্বর ব্যাটালিয়ন ও মেজর এস এল মিশ্রর সেনা দল এ অঞ্চলে যুদ্ধরত ছিল। আজাদ হিন্দ ফৌজের সেনারা তখন ‘চল দিল্লি’ অগ্রাভিযানে উজ্জীবিত ও স্বাধীনতার স্বপ্নে বিভোর।

আরাকান ফ্রন্টে জাপানি বাহিনীর অগ্রযাত্রার প্রতিক্রিয়ায় তখন দক্ষিণ চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে মোতায়েন ৮১ ওয়েস্ট আফ্রিকান ডিভিশনকে বান্দরবানের উঁচু পাহাড় পেরিয়ে চিনের কালাদান উপত্যকায় যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মেজর জেনারেল উলনারের নেতৃত্বাধীন ৮১ ডিভিশন খুব অল্প সময়ে চকোরিয়া-শিকলঘাটা-মানিকপুর-কাকরা-মোদক হয়ে চিনের লাবাওয়া পর্যন্ত জিপ চলাচল-উপযোগী রাস্তা নির্মাণ করে দুঃসাধ্য কাজ সম্পন্ন করেছিল। ব্রিটিশ বাহিনীর অধিনায়ক ফিল্ড মার্শাল উইলিয়াম স্লিম একে ‘আফ্রিকান ওয়ে’ হিসেবে তাঁর বিখ্যাত বইতে (ডিফিট ইন্টু ভিক্টরি) উল্লেখ করেছেন।

কক্সবাজারের (ডুলাহাজারা) এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারের সন্তান মোমিনুল হক চৌধুরী (প্রয়াত) দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় (১৩-১৪ বছরের বালক) ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে জিপে করে সেই পাহাড়ি সড়কে অনেক পথ অতিক্রম করেছিলেন। (হারিয়ে যাওয়া দিনগুলো ও আমার দেখা দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ)। এদিকে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর অফিসার মেজর মোহাম্মদ আফসার উদ্দিন (প্রয়াত) তরুণ সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট হিসেবে (১৯৪৩) এক কোম্পানি সেনা নিয়ে সাঙ্গু নদ পথে বান্দরবান পেরিয়ে (দুর্গম পথে) কালাদান উপত্যকায় জাপানিদের মুখোমুখি হয়েছিলেন (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও আমার সৈনিক জীবন)। এই নিবন্ধকার উপরোক্ত দুজন ব্যক্তি থেকেই ওই অঞ্চলের যুদ্ধে তাদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার কথা শুনেছেন।

মিয়ানমারের একসময়ের অপেক্ষাকৃত শান্ত রাজ্যটি আজ সবচেয়ে উত্তপ্ত ও সংঘর্ষময় এলাকা। এখানে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর (তাতমাদো) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে চিন ন্যাশনাল আর্মি ও চিনল্যান্ড ডিফেন্স ফোর্স। গড়ে উঠেছে এলাকাভিত্তিক ‘ডিফেন্স ফোর্স’। দক্ষিণ চিনে সক্রিয় রয়েছে শক্তিশালী আরাকান আর্মি। গত তিন মাসে এখানে প্রায় ৬২টি সংঘর্ষ ঘটেছে। বিমান আক্রমণে ধ্বংস হয়েছে চার্চসহ অনেক ঘরবাড়ি। তিনটি শহর মাদুপি, মিনদাদ ও থাটলং যুদ্ধবিমান, হেলিকপটার গানশিপ, আর্টিলারি আক্রমণে ও অগ্নিসংযোগে প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। অভিযান চলাকালে বেসামরিক নাগরিকদের ‘মানববর্ম’ (হিউমেন শিল্ড) হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। অপ্রতিসম এ যুদ্ধে (অ্যাসিমেট্রিক ওয়ারফেয়ার) নিরীহ মানুষ হত্যার জন্য যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ উঠেছে দুর্ধর্ষ তাতমাদোর বিরুদ্ধে।

তাতমাদোর নিষ্ঠুর, মারমুখী ও অমানবিক এ অভিযানে (অপারেশন আনোয়ারাথা) সহজ-সরল ও অতিদরিদ্র হাজার হাজার চিনবাসী দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। অন্যদিকে তাতমাদোর নিষ্ঠুর অভিযানের প্রতিক্রিয়ায় তরুণদের প্রতিরোধও বাড়ছে। আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চিনের বিপুল প্রবাসী আছে। অর্থকড়ি পাঠিয়ে তারাও বিভিন্নভাবে প্রতিরোধযুদ্ধে শামিল হচ্ছে। অসামরিক নাগরিকদের মধ্যেও সংঘর্ষ বাড়ছে। বাংলাদেশ সীমান্তের প্রায় ২০ কিমির মধ্যে যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছে। উল্লেখ্য, সীমান্তে দুই পাশের সাধারণ মানুষের মধ্যে সম্প্রদায়গত আত্মীয়তা ও যোগাযোগ রয়েছে।

প্রায় এক বছর আগেও মিয়ানমার পর্যটন সংস্থা চিনের অসাধারণ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও উপজাতীয় সংস্কৃতির অনন্যতার কথা সগৌরবে প্রচার করত। চিনের সর্বোচ্চ গিরিশৃঙ্গ মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার অপূর্ব দৃশ্য, নয়নাভিরাম জলপ্রপাত, অপরূপ ঝরনা ও এশিয়ার সবচেয়ে বিচ্ছিন্ন উপজাতীয় সংস্কৃতি পশ্চিমা পর্যটকদের আকৃষ্ট করত। মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার ন্যাশনাল পার্কে এখন অপরূপ রডোডেনড্রন ফুল ফোটার সময়। কিন্তু এই সময়ে চিন পুড়ছে হিংসার আগুনে। এ আগুন এখন সীমান্তের এপারে থানচি, রুমা, মোদক জনপদের গায়ে লাগারও উপক্রম।

আরাকানের পর চিনই হতে পারে বাংলাদেশের নতুন মাথাব্যথার কারণ। কোনো কোনো পর্যবেক্ষকের মতে এলাকাটি মিয়ানমার বিষয়ে আন্তরাষ্ট্রীয় ‘পলিটিক্যাল সেন্টার’ হয়ে উঠতে পারে। চিন রাজ্যে গৃহযুদ্ধের ভয়াবহতা বাড়লে বাংলাদেশে কী প্রভাব পড়বে? যুদ্ধের ব্যাপকতা আরও বৃদ্ধি পেলে চিন থেকেও বাংলাদেশে শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটতে পারে। সীমান্তের ওপারে অশান্তি ও সহিংসতা পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রভাব ফেলতে পারে। দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তে দুর্গম অঞ্চলে বাড়তি প্রভাব (স্পিলওভার অ্যাফেক্ট) পড়তে পারে। এ পরিস্থিতিতে চিনের পরিস্থিতি মনিটরিং, মূল্যায়নসহ দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় সীমান্তে সীমান্তরক্ষী বিজিবিকে বিশেষভাবে সতর্ক রাখা প্রয়োজন। দরকার সীমান্তে নজরদারি ও গোয়েন্দা কার্যক্রম বৃদ্ধি। পার্বত্য চট্টগ্রামের সীমান্ত সড়কগুলোর নির্মাণকাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সম্পন্ন করা উচিত।

২০২১-এর সেনা অভ্যুত্থানের পর থেকে দিন দিন মিয়ানমারে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। বিভিন্ন অঞ্চলে চলমান জাতিগত বিদ্রোহের সঙ্গে এক হয়ে সরকারবিরোধী এ আন্দোলন প্রায় গেরিলা কৌশলের রূপ নিচ্ছে। তবে গুণগতভাবে যুদ্ধটি এখনো অবশ্য প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বার্মা সমরাভিযানের বহুল আলোচিত নামগুলো (মেকটিলা, ইরাবতী, মান্দালয়, লিডো, সিতাং, মিটকিনা...) আবার আলোচনায় আসছে। এভাবেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটছে।

মিয়ানমারে পুরোপুরি গৃহযুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশে ও এ অঞ্চলে মারাত্মক প্রভাব পড়বে। এ অবস্থায় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দুটি কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমত. বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ বিশেষত প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কমিটি গঠন করে সম্ভাব্য চিত্র বিবেচনায় ধরে পরিকল্পনা তৈরি ও সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া। দ্বিতীয়ত. মিয়ানমারের রাজনৈতিক ও সামরিক কার্যক্রমের পুঙ্খানুপঙ্খ বিস্তারিত অগ্রগতির প্রতি দৃষ্টি রাখা ও বিশ্লেষণ করা।

মিয়ানমারের চলমান ঘটনাগুলোর কোনোটিই বাংলাদেশের জন্য ভালো খবর নয়। আরাকান রাজ্যে আরাকান আর্মির অপ্রত্যাশিত শক্তিশালী অবস্থান এখন এ অঞ্চলের গেম চেঞ্জার। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন এখন তাই চরম জটিল হয়ে পড়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য কূটনৈতিক ময়দানে রীতিমতো লড়ছে বাংলাদেশ। তবু প্রত্যাশিত ফল আসেনি। এখন তাহলে বাংলাদেশ কী করবে?

এখন প্রয়োজন সঠিক রণকৌশল, দীর্ঘ প্রস্তুতি ও আন্তর্জাতিক চাপ বৃদ্ধি। রোহিঙ্গা বিষয়ে পুরনো, গৎবাঁধা, টিপিক্যাল চিন্তা-ভাবনার পরিবর্তনও প্রয়োজন। কূটনীতিতে প্রথাভাঙা, বিকল্প পথও কাজে আসে। বর্তমানে আসিয়ানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আছেন কম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হুন সেন। উল্লেখ্য, কম্বোডিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের খুবই চমৎকার সম্পর্ক। আসিয়ানের মাধ্যমে মিয়ানমারকে চাপে রাখার এ সুযোগ কাজে লাগানো যেতে পারে।

আমাদের মিয়ানমারচর্চা অবশ্যই বাড়াতে হবে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে নতুন নতুন সম্ভাবনা, আউট অব বক্স ধারণা পরীক্ষা করা যেতে পারে। মূল বিষয়টি হলো, নিজে ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে চাপে রাখা। বাংলাদেশ-অন্তপ্রাণ কবি প্রয়াত শঙ্খ ঘোষের একটি কবিতার লাইন বিশেষভাবে স্মতর্ব্য-

‘চাপ সৃষ্টি করুন/চাপ সৃষ্টি করুন’।

 

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষক।

[email protected]

সর্বশেষ খবর