বৃহস্পতিবার, ৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত পবিত্র হজ

এম এ মান্নান

আর্থিক ও শারীরিক ইবাদত পবিত্র হজ

আল্লাহ-প্রদত্ত জীবন-বিধান ইসলাম পাঁচটি রোকন বা স্তম্ভের ওপর প্রতিষ্ঠিত। কলমা, নামাজ, রোজা, হজ ও জাকাত ইসলামের স্তম্ভ। সব মুসলমানের জন্য কলমা, নামাজ, রোজা অবশ্যপালনীয়। আর্থিক সামর্থ্যবান যারা তাদের জন্য হজ ও জাকাতের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। মুসলিম জাহানের দারুস সালতানাত কাবা মক্কা নগরীতে অবস্থিত। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্মস্থানও এ পবিত্র নগরী। ভৌগোলিক হিসেবেও কাবা পৃথিবীর মধ্যস্থল। হজরত আদম (আ.) বেহেশত থেকে দুনিয়ায় অবতীর্ণ হলে সর্বশক্তিমান আল্লাহর ইবাদতের জন্য একটি মসজিদের জন্য প্রার্থনা করেন। আল্লাহর আদেশে ফেরেশতারা ‘বায়তুল মামুর’-এর নুরানি নকশা বা আলোকময় প্রতিবিম্ব দুনিয়ার মধ্যস্থলে ফেলে দেন। ‘বায়তুল মামুর’ হলো চতুর্থ আসমানের ওপর আকিক পাথরের তৈরি একটি মসজিদ যেখানে ফেরেশতারা আল্লাহর ইবাদত করেন। হজরত আদম (আ.)-এর ছেলে শিশ (আ.) ওই নকশার অনুকরণে মক্কার ওই স্থানে একটি মসজিদ তৈরি করেন। এটিই বায়তুল্লাহ বা আল্লাহর ঘর। হজরত নুহ (আ.)-এর সময় তুফানে কাবাঘরের কতকাংশ মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। হজরত ইবরাহিম ও তাঁর ছেলে ইসমাইল (আ.) এটি পুনর্নির্মাণ করেন। কাবাঘর দুনিয়ার সর্বপ্রথম মসজিদ। এর দক্ষিণ -পূর্ব কোণে কিছু উঁচুতে গ্রোথিত রয়েছে বেহেশতি পাথর বা হাজরে আসওয়াদ। এ পাথরটি বেহেশতেরই একটি স্মৃতিচিহ্ন। এটিকে চুম্বন করলে সে চুম্বন এখানেই সীমাবদ্ধ থাকে না। বহুস্তরের মধ্য দিয়ে আল্লাহর দিকে অগ্রসর হয়। হাজরে আসওয়াদ আল্লাহর প্রতি বান্দার অকৃত্রিম প্রেমের কেন্দ্রভূমি। বেহেশতের সঙ্গে মাটির পৃথিবীর সংযোগ, একাত্মবাদ বা তৌহিদি চেতনা, বিশ্বমানবতা, তথা ভ্রাতৃত্বের প্রতীক কাবা শরিফ। এটি মহান আল্লাহর রহমতের স্থান, কেয়ামত পর্যন্ত পবিত্র ও নিরাপদ থাকবে। অসহায়, নির্বাসিত ইসমাইল- জননী হজরত হাজেরার প্রতি আল্লাহর রহমতের স্মৃতিচিহ্নস্বরূপ জমজম কূপ ও সাফা-মারওয়া পাহাড় এখানেই বিরাজমান। এখানকার আরাফাহ ভূমি আদি পিতা-মাতা হজরত আদম ও হাওয়া (আ.)-এর পুনর্মিলনস্থান। পবিত্রতা ও মাধুর্যে জগতে এটি অদ্বিতীয়।

কাবাঘর কেন্দ্র করে আমরা হজ পালন করি। আল্লাহর হুকুম হিসেবে আমরা যেসব ইবাদত করি তা সাধারণত তিন প্রকার। প্রথমত, শারীরিক ইবাদত- যেমন নামাজ, রোজা ইত্যাদি। এখানে আর্থিক কোনো বিষয় নেই, শুধু শারীরিক শ্রম রয়েছে। দ্বিতীয়ত, আর্থিক ইবাদত যেমন জাকাত আদায়। এখানে শারীরিক কোনো শ্রম নেই, শুধু অর্থ ব্যয় রয়েছে। তৃতীয়ত, শারীরিক ও আর্থিক উভয়টি। অর্থাৎ এমন কিছু ইবাদত রয়েছে যাতে আর্থিক ইবাদতের সঙ্গে সঙ্গে শারীরিক পরিশ্রমও জড়িত। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হজ। এতে একদিকে যেমন অর্থ ব্যয় রয়েছে তেমনি রয়েছে দীর্ঘ সময়সাধ্য কঠোর পরিশ্রম। হজের বিধানগুলো আদায় করা এতটাই কঠিন ও কষ্টসাধ্য যা দুর্বল মুসলমানের পক্ষে সাধারণত সম্ভব হয় না। আর্থিক ও শারীরিক উভয় প্রকার ইবাদত হজের মধ্যে থাকায় অন্যান্য ইবাদতের তুলনায় এটি অধিক গুরুত্বপূর্ণ এবং মর্যাদাপূর্ণ। মহান আল্লাহর নৈকট্য লাভেরও এটি একটি মাধ্যম। আল কোরআনে আল্লাহতায়ালা হজের বিষয়ে ঘোষণা করেন, ‘মানুষের পক্ষে আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করা ফরজ, যার পথের সামর্থ্য আছে।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ৯৭) অর্থাৎ যে ব্যক্তি হজে যাওয়া-আসার যাবতীয় ব্যয় বহন করতে সামর্থ্য রাখে এবং শারীরিক-ভাবেও হজের আহকামগুলো পালন করতে সক্ষম তার ওপর হজ ফরজ। তবে সে ফিরে আসা পর্যন্ত তার পরিবারের ব্যয়ভারের ব্যবস্থা করে যেতে হবে। এমন যেন না হয় যে সে হজে গেলে তার স্ত্রী ও নাবালেগ সন্তানরা খাওয়া-পরায় কষ্ট করবে। কারণ আল্লাহ তাঁর বান্দার কষ্ট চান না। পুরুষদের মতো নারীদের মধ্যে যারা সামর্থ্যবান তাদের ওপরও হজ ফরজ। তবে নারীদের জন্য হজে যাওয়ার বিষয়ে শর্ত জড়িত। তা হলো, মাহরাম পুরুষের সঙ্গে যেতে হবে। মাহরাম পুরুষ হলো নিজের স্বামী, বাবা, ছেলে, আপন ভাই ইত্যাদি। ইসলামের এ ফরজ হুকুম পালন করার জন্য যারা কাবা তথা মক্কার উদ্দেশে রওনা করে তারা আল্লাহর মেহমান তথা তাঁর প্রতিনিধি। এ বিষয়ে আবু হোরায়রা (রা.) বলেন, আমি রসুল (সা.)-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেছেন, ‘আল্লাহর প্রতিনিধি হলো তিন ব্যক্তি। হাজি, গাজি ও ওমরাহকারী।’ (বায়হাকি ও নাসায়ি) এমনকি তারা যদি এ কাজ করার সংকল্প করে ঘর থেকে বের হওয়ার পর ইন্তেকাল করে, তবু সেই সওয়াব পেয়ে যাবে। আবু হোরায়রা (রা.) আরও বলেন, হুজুর (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি হজ, ওমরাহ অথবা আল্লাহর রাস্তায় জিহাদের উদ্দেশ্যে বের হয়েছে, এরপর সে পথিমধ্যে মারা গেছে, তার জন্য হাজি, গাজি অথবা ওমরাহকারীর সওয়াব লেখা হবে।’ (বায়হাকি) হজ পালনকারী যদি হজ সম্পন্ন করে ফিরে আসে তাহলে নিষ্পাপ হয়ে ফিরে আসবে। রসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর উদ্দেশ্যে হজ করেছে এবং তাতে অশ্লীল কোনো কথা বলেনি বা অশ্লীল কোনো কাজ করেনি সে হজ থেকে (গুনাহ থেকে মুক্ত হয়ে) ফিরবে সেদিনের মতো যেদিন তার মা তাকে প্রসব করেছিল।’ (বুখারি, মুসলিম) অর্থাৎ সন্তান ভূমিষ্ঠের সময় তার যেমন কোনো গুনাহ থাকে না, তেমনি হজ সম্পন্নকারীরও কোনো গুনাহ থাকে না।

 

লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক।

সর্বশেষ খবর