বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

১০ ডিসেম্বর রাজনীতির গতিপথ তৈরি হবে

মেজর আখতার (অব.)

১০ ডিসেম্বর রাজনীতির গতিপথ তৈরি হবে

সরকার গো ধরেছে ১০ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে পল্টনে পার্টি অফিসের সামনে বিএনপিকে জনসভা করতে দেবে না। সরকার জেনেশুনে খুবই ঠাণ্ডা মাথায় দেশের রাজনীতিতে নতুন করে রোমাঞ্চ তৈরি করছে। গত কয়েক বছর সরকার বিএনপিকে যেখানে কোথাও নামতে দিচ্ছে না, সেখানে গত কয়েক মাসে সব বিভাগীয় শহরে ঘটা করে জনসভা করতে দিয়ে যাচ্ছে।  গণতন্ত্রের এখন যেন পূর্ণযৌবন। চারদিকে বিএনপির গরম বাতাস। যে কোনো সময় সরকার পড়ে যায় যায় অবস্থা। জাতীয় সরকার গঠন নিয়ে এখন সবাই সরব। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে, জাতীয় সরকারের কাঠামো প্রায় চূড়ান্ত। এখন শেষ মুহূর্তের চূড়ান্ত সমাপনী দেওয়ার আগে তর্ক হচ্ছে জাতীয় সরকারে আওয়ামী লীগ থাকবে কি না বা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে নিরাপদ পলায়নের পথ দেওয়া হবে কি না! আলোচনাগুলো খুবই চমকপ্রদ ও উত্তেজনাময়। সবার কাছেই সরকার পতনের শেষ খবর আছে- কেউ প্রকাশ করছে, আবার কেউ কেউ রহস্যজনকভাবে গোপন রাখছে। কিন্তু ভাবখানা হলো তিনি সবই জানেন এবং সরকার কীভাবে পালাবে তার স্পষ্ট খবরটিও ভদ্রলোকের কাছে রয়েছে!

সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী খেলা জমিয়ে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারাও এখন খেলা হবে বলা শুরু করে দিয়েছেন। এখন আওয়ামী লীগ নেতা ও সরকারের মন্ত্রীরা বক্তৃতার শেষে পুরনো স্লোগান ভুলে খেলা হবে স্লোগান দিয়ে তাদের বক্তব্য শেষ করেন। রাজনীতির নতুন স্লোগান-খেলা হবে। দৃশ্যত মনে হচ্ছে, খেলা জমে গেছে। খেলার এই রোমাঞ্চকর নাটকটিকে জমিয়ে দিচ্ছে পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘটের খেলা। রাস্তাঘাটে নিজেদের দলীয় নেতা-কর্মী বা উগ্রদের মাঠে বা পথে-ঘাটে নামিয়ে অযথা বিশৃঙ্খলা বা অশান্তি সৃষ্টি করার সুযোগ না দিয়ে সরকার যে বিএনপির সমাবেশে সত্যিই (!) ভয় পেয়েছে তা দেখানোর জন্য পরিবহন মালিকদের সব যানবাহন মাঠ থেকে তুলে নিয়েছে। এতে একদিক দিয়ে সমাবেশে আসার পরিবেশ প্রতিকূল করা হলো, দ্বিতীয়ত রাস্তাঘাটে যাতে পরিবহন ধ্বংস করে কোনো প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টির আশঙ্কা তৈরি না হয়, সেই সুযোগ বন্ধ করা হলো এবং তৃতীয়ত, দেখানো হলো সরকার বিএনপির সমাবেশে যথেষ্ট ভীত ও সন্ত্রস্ত। খেলা জমে গেল। পুরনো সেই খেলা। বাধা যেখানে আগ্রহ সেখানে; কিন্তু সাধারণ মানুষ বাধা থেকে দূরে থাকে। রাজনীতির এই সূত্রের সফল কায়িক পরীক্ষা হলো এবারের এই সমাবেশগুলোতে। দলীয় নেতা-কর্মী ছাড়া সাধারণ মানুষ অনুপস্থিত। সভায় কোনো উত্তেজনা নেই। নেই দাবি পূরণের কোনো চূড়ান্ত নামা। একই বক্তা এবং একই অনুসারী। সবার লক্ষ্য সভায় উপস্থিত হওয়া। সভায় এক দিন দুই দিন আগে পৌঁছে যাওয়া। তারপর ছবি, সেলফি, ফেসবুক, ইউটিউব। তারপর সভা; যে সভায় কোনো উত্তেজনা নেই, দাবি আদায়ের কোনো স্পষ্ট লক্ষ্য নেই, আন্দোলনে লেগে থাকার কোনো অঙ্গীকার নেই। শুধু নিয়ম মাফিক বক্তৃতা। সবচেয়ে চমকপ্রদ ও লক্ষ্যণীয় মজা হলো- সভা শেষে সবার শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদে ঘরে ফিরে যাওয়া হলো। এর জন্য পুলিশকে একটি বিশেষ ধন্যবাদ দেওয়া যেতে পারে।

সরকারকে মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সেই নির্বাচন নিয়ে বেশি  উচ্চবাচ্য না হয়। সরকারের এই লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করতে হলে অবশ্যই বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ কিছুটা হলেও ছেড়ে দিতে হবে
সব সমাবেশ দেখে স্ফটিকের মতো পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়, দেশটি প্রধানমন্ত্রীর শক্ত হাতের মুঠোয় নিয়ন্ত্রিত। এখানে সবকিছুই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি অঙ্গুলি হেলনে। দেশের অভ্যন্তরীণ সবকিছু প্রধানমন্ত্রীর সম্পূর্ণ একক নিয়ন্ত্রণে। যদিও চরম বাস্তব সত্য হলো, প্রধানমন্ত্রী ও তার দলের জনপ্রিয়তা প্রধানমন্ত্রীর কাক্সিক্ষত পর্যায়ে নেই। এই জনপ্রিয়তা না থাকাটাই প্রধানমন্ত্রীর জন্য বাড়তি সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে। তিনি এখন সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত এককভাবে নিতে পারেন। তার আশপাশের সবাই ভালো করে জানে প্রধানমন্ত্রীর পা পিছলালে শুধু উনার একার পা পিছলাবে না। উনার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সবারই পা পিছলাবে। তাই প্রধানমন্ত্রীর চারপাশের সাঙ্গোপাঙ্গো এবং দেশি-বিদেশি সব শুভাকাক্সক্ষী তাদের নিজ নিজ স্বার্থ ও অস্তিত্বের তাগিদেই সব শক্তি দিয়ে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ পালনে সর্বদা এগিয়ে আসে। একক সিদ্ধান্তের কারণে কেউই আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাজের কোনো আভাস পায় না ও কোনো তথ্য ফাঁস হয় না। ফলে প্রধানমন্ত্রীর কাজের দুর্বলতার কোনো সুযোগ কেউ নিতে পারে না।

১০ ডিসেম্বরের জনসমাবেশ বিএনপির অফিসের সামনে নয়াপল্টনের রাস্তার ওপরই হবে। প্রধানমন্ত্রীর রাজনীতি বিএনপির সঙ্গে নয়। তিনি রাজনীতি করছেন বিশ্ব শক্তিদের সঙ্গে। তিনি ভারতের বিজেপি সরকারকে বোঝাতে চান প্রধানমন্ত্রীর জন্য বিজেপির প্রয়োজন নেই। বরঞ্চ বিজেপি তথা উত্তর-পূর্ব ভারতের নিরাপত্তার জন্য শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারকে তাদেরই প্রয়োজন। প্রধানমন্ত্রী ভারতকে বোঝাতে চান, বিএনপি বা অন্য কোনো দল ক্ষমতায় এলে ভারতেরই মাথাব্যথা বাড়বে। এবার লক্ষ্য রাখার বিষয় হলো ২০২৪ সালের মে মাসে ভারতের জাতীয় নির্বাচন। কাজেই ২০২৪ সালের বাংলাদেশের নির্বাচনে ভারতের নাক গলানোর সুযোগ সীমিত হয়ে যাবে। তা ছাড়া ২০২৪ সালের জানুয়ারির নির্বাচনে যদি আওয়ামী লীগের ভরাডুবি হয়, তাহলে তার তীব্র প্রভাব ভারতের নির্বাচনেও পড়তে পারে। এ জন্য প্রধানমন্ত্রী বিএনপির সঙ্গে বোঝাপড়াটি আগেই সেরে নিতে চাচ্ছেন। ১০ ডিসেম্বর এর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ প্রধানমন্ত্রীকে তাই আরেক ডিগ্রি উচ্চতায় তুলে দেবে।

নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে জানুয়ারি ২০২৪ সালে আগামী জাতীয় নির্বাচন হবে। সরকারের এখন দুটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আগাচ্ছে। তার প্রথম লক্ষ্যটি হলো গত নির্বাচনের মতো এবারও বিএনপিকে নির্বাচনের জালে আটকানো। বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে হলে অবশ্যই একটি পরিবেশ সৃষ্টি করে এমন ফাঁদ পাততে হবে, যাতে বিএনপি সেই পাতানো ফাঁদে হুড়হুড় করে ঢুকে পড়ে। দ্বিতীয়ত, সরকারকে মোটামুটি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সেই নির্বাচন নিয়ে বেশি উচ্চবাচ্য না হয়। সরকারের এই দুটি লক্ষ্য সফলভাবে অর্জন করতে হলে অবশ্যই বিএনপিকে রাজনীতির মাঠ কিছুটা হলেও ছেড়ে দিতে হবে। বিএনপির সামনে নির্বাচনে জয়ের মুলা ঝুলাতে হবে, যাতে নির্বাচনে আসতে বিএনপি উৎসাহিত হয়।

সে লক্ষ্যেই সরকার বিভাগীয় সমাবেশের সুযোগ করে দেয় বলেই অনেকে মনে করেন। ইতোমধ্যে ঢাকার বাইরে সব বিভাগীয় সমাবেশ শান্তিপূর্ণ এবং সরকারের সন্তোষজনকভাবেই সমাপ্ত হয়েছে। এই সমাবেশগুলোর মাধ্যমে উভয়ের লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বিদেশিদের সামনে দেখিয়ে দিলেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্রের রমরমা অবস্থা। এখানে বিরোধী দল দেশব্যাপী জনসভা-জনসমাবেশ করতে পারে। বাধা-নিষেধ তো থাকতেই পারে। কিন্তু সরকার তো শান্তিপূর্ণ সভা-সমাবেশ করতে বাধা দিচ্ছে না। কাজেই বাংলাদেশে গণতন্ত্রের কোনো ঘাটতি নেই।

আবার অন্যদিকে বিএনপিও মহাখুশি। তারা অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে এবং সূচারুভাবে সমাবেশগুলো সম্পন্ন করে তাদের সাংগঠনিক দক্ষতার প্রমাণ রেখে দিল। সমাবেশগুলো সফল করতে অনেক কষ্ট ও বিড়ম্বনা হয়েছে; কিন্তু তৃণমূল নেতা-কর্মীদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় প্রতিটি সমাবেশ দারুণভাবে সফল হয়েছে। যার বেশির ভাগ কৃতিত্ব মহাসচিব পেতেই পারেন। এখন সবার দৃষ্টি ঢাকার সমাবেশ নিয়ে। তবে আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, ঢাকার সমাবেশটি নয়াপল্টনে বিএনপির অফিসের সামনেই হবে। পুলিশ একটু বাড়াবাড়ি করে তাদের গুরুত্ব বাড়াতে চাচ্ছে আর কিছু নয়। ঢাকা মহানগর উত্তরের আহ্বায়ক জননেতা আমান সাহেব যে বলিষ্ঠ ও যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছিলেন সেই বক্তব্য থেকে বিএনপি ইতোমধ্যে সরে গেছে। মহাসচিব স্পষ্ট করে দিয়েছেন, ১০ ডিসেম্বর শান্তিপূর্ণ সমাবেশ হবে এবং সেই সমাবেশ থেকে পরবর্তী সমাবেশের ঘোষণা দিয়ে সবাই যার যার ঘরে ফিরে যাবে। এ রকম স্পষ্ট ঘোষণার পর সরকারের অস্বস্তি হওয়ার তো কোনো কারণ নেই। শনিবার, অফিস-আদালত বন্ধ। নয়াপল্টন এলাকায় বড় কোনো বিপণি বিতানও নেই যে, ছুটির দিন ঢাকাবাসী দলবেঁধে সেখানে কেনাকাটা বা ঘোরাঘুরি করতে যায়। নয়াপল্টনের রাস্তার বিকল্প অনেক পথ আছে। তা ছাড়া নয়াপল্টনের রাস্তায় বিএনপি অতীতে অনেক জনসভা করেছে তখন ডিএমপি কোনো দিন বাধা দেয়নি।

নির্বাচন গ্রহণযোগ্য করতে হলে বিএনপির অংশগ্রহণ লাগবে। আগামী নির্বাচনে রাতের ভোটে পার পাওয়া যাবে না। আর যদি নির্বাচন গ্রহণযোগ্য না হয়, তাহলে অনেক বিদেশি পক্ষ অন্য সুরে কথা বলতে পারে, যা হয়তো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্য সম্মানজনক নাও হতে পারে। ইতোমধ্যে অনেক বিদেশি পক্ষ বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসার জন্য চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করছে। যদিও বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসবেন না বলে প্রধানমন্ত্রী সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। সাফ জানিয়ে দেওয়াটাই সমস্যা নতুন করে সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ সংলাপ সংঘাতের পূর্বশর্ত। সংঘাত এড়াতে হলে সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। যেমন সংঘাত মেটাতে হলে সংলাপ লাগবে তেমনি সংলাপ ব্যর্থ হলে সংঘাত অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশটি নয়াপল্টন থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ বিএনপির এখন আর নেই। বিষয়টি এখন পুলিশের ক্ষুদ্র আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। এটি এখন অতি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ইস্যু যার সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। বিএনপিকে সর্বোচ্চ গো ধরতে হবে। নেতা-কর্মীরা নয়াপল্টনের জনসমাবেশে আসতে শুরু করে দিয়েছে। নয়াপল্টনের জনসমাবেশ বানচাল করার ক্ষমতা অবশ্যই পুলিশ রাখে। তবে যদি কোনো কারণে সংঘাত বেধে যায়, তাহলে এর দায়-দায়িত্ব কিন্তু ডিএমপি নেবে না। কিন্তু ক্ষতি হবে জনগণের। ক্ষতি হবে গণতন্ত্রের। ঝুঁকিতে ফেলে দেবে নির্বাচনকে। ইতোমধ্যে বিএনপি নির্বাচনের ফাঁদে পা ঢুকিয়ে দিয়েছে। যদি ১০ ডিসেম্বর বিএনপি নয়াপল্টনে জনসমাবেশ করতে না পারে, তাহলে এই সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচনে বিএনপির যাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যাবে এবং দেশ সংঘাতের দিকে চলে যাবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকার সেই ঝুঁকি নেবে না। তবে ঝুঁকি নিতেই হবে বিএনপিকে। হয় মুক্তি- না হয় বন্দি।

লেখক : সাবেক সংসদ সদস্য।

সর্বশেষ খবর