বৃহস্পতিবার, ২২ ডিসেম্বর, ২০২২ ০০:০০ টা

পুঁজিবাদী উন্নতির শত্রু সৃষ্টিশীলতা

সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

পুঁজিবাদী উন্নতির শত্রু সৃষ্টিশীলতা

জাতির প্রধান ভিত্তি তো ভাষা, সে হিসেবে ভারতীয় উপমহাদেশ কখনই এক জাতির দেশ ছিল না, ছিল বহু জাতির বিরাট একটি জনবসতি। জাতিগত পরিচয়ে বাঙালি মুসলমানরা বাঙালি নাকি মুসলমান- এ প্রশ্ন একসময় উঠেছিল। স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ওই প্রশ্নের সমাধান হয়ে গেছে,  বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমান ও হিন্দু সবাই, জাতিগত পরিচয়ে বাঙালি, যদিও ধর্মীয় পরিচয়ে তারা স্বতন্ত্র। ভারতে জাতি প্রশ্নের সমাধান হয়নি; আর সেই না-হওয়াটাই কিন্তু প্রতিফলিত হয়েছে; ভারতের অন্যান্য জাতিসত্তার তুলনায় বাঙালি পিছিয়ে গেছে। পিছিয়ে-পড়া বাঙালির জাতিগত পরিচয়টা ভারতীয় নয়, বাঙালি বটে। এর ফলে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের নামে হিন্দুত্ববাদীরা ধর্মভিত্তিক জাতীয় পরিচয়টাকে খাড়া করে অ-হিন্দুদের অ-ভারতীয় বলার, এমনকি তাদের বিতাড়িত করার, আওয়াজ তোলার সুযোগ করে নিচ্ছে।

আর সাহিত্যের উন্নয়নের জন্য সম্প্রতি দেশ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে জগজ্জননীর কাছে যে প্রার্থনা করা হয়েছে সেটাও যে খুব ফলপ্রসূ হবে এমন ভরসা করা যায় কি? জগজ্জননী যদি কোনো কাজ করেন তবে সেটা তিনি করে থাকেন তাঁর সন্তান, অর্থাৎ মানুষের মধ্য দিয়েই। ওই মানুষদের উদ্বুদ্ধ করা দরকার; মানুষদের বলতে এ ক্ষেত্রে বাংলাভাষী মানুষদেরই বোঝাবে। চেষ্টা করা চাই তারা যাতে কেবল সাহিত্যের নয়, বাঙালির অবস্থা উন্নয়নের জন্য মনেপ্রাণে কাজে নামে।

সন্দেহ কী যে বাঙালি এখন ভারি অসুবিধার মধ্যেই আছে- পশ্চিমবঙ্গে যেমন, বাংলাদেশেও তেমনি। পশ্চিমবঙ্গে তাদের অসুবিধার একটি কারণ কেন্দ্রীয় সরকারের নানাবিধ নিপীড়ন। তা ছাড়া পুঁজিবাদের দুঃশাসন তো রয়েছেই। বস্তুত পশ্চিমবঙ্গে বাংলা ভাষার চর্চা যে বিঘ্নিত হচ্ছে তার প্রধান কারণ পুঁজিবাদের অমানবিক বাড়বাড়ন্ত। ওই একই তৎপরতায় বাংলাদেশের মানুষও যে বিধ্বস্ত-বিপর্যস্ত তাতে কোনো সন্দেহ নেই। ঘটনাটা দাঁড়িয়েছে এই যে, বাংলাভাষী মানুষ ও বাংলা ভাষা উভয়েই বিদেশেও মর্যাদা লাভে বঞ্চিত হচ্ছে। ধরা যাক বিবিসির বাংলা ভাষা সার্ভিসের ব্যাপারটা। ৮১ বছর আগে ওটির প্রচলন করা হয়। তার পর থেকে বাঙালি মহলে রেডিওর ওই সার্ভিসের জনপ্রিয়তা ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিবিসি বাংলার সংবাদ ঘরে ঘরে শোনা হতো। পরবর্তীতেও ঘরের ভিতরে তো বটেই, দোকানপাটে, হাটে বাজারে বিবিসির বাংলা অনুষ্ঠানের জন্য লোকে অপেক্ষা করে থাকত। এর প্রধান কারণ তাদের খবর ছিল বস্তুনিষ্ঠ এবং পক্ষপাতিত্বহীন হয়েও মানবিক, অর্থাৎ কি না বিপন্ন বাঙালির দিকে ঝুঁকে থাকা, কারণ সম্পাদকীয় নীতি অন্যরা স্থির করলেও উপস্থাপকরা সবাই ছিলেন বাঙালি। আট যুগ পরে বিবিসির বাংলা সার্ভিস জানাচ্ছে যে এ বছরের শেষ নাগাদ ওই সার্ভিস আর চালু থাকবে না, নিশ্চুপ হয়ে যাবে। কারণ ওই একই। অর্থনৈতিক সংকট, যার সম্পূর্ণ দায়িত্ব পুঁজিবাদেরই। অর্থনৈতিক দুর্দশায় পড়েছে গ্রেট ব্রিটেনও; অনেক কিছু তারা বন্ধ করে দিচ্ছে, বিবিসি বাংলা সার্ভিসও। কেবল বাংলা নয়, সর্বমোট ১০টি ভাষার অনুষ্ঠানই আর শোনা যাবে না বিবিসিতে। তার পরেও ১৭টি ভাষার সার্ভিস কিন্তু চালু থাকবে। প্রশ্ন হলো, বাংলা কেন বাদ পড়ল? বাংলা তো এখন বিশ্বের কমপক্ষে ৩০ কোটি মানুষের মাতৃভাষা, বিশ্ব পরিসরে এর স্থান পঞ্চমে না হলেও কাছাকাছি বটে। অন্য যে নয়টি ভাষার সম্প্রচার বন্ধ হবে তারা বাংলা ভাষার ধারেকাছেও নেই। তাহলে? বোঝাই যাচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে বাংলা ভাষার প্রতি অবজ্ঞার বিদ্যমানতারই এটি একটি নিকট প্রতিফলন বইকি।

শেষ বিচারে বাঙালি ও বাংলা ভাষার মর্যাদা ঘাটতি-বৃদ্ধি অন্য কারও ওপর নির্ভর করছে না, করছে বাঙালির ওপরই। এবং সে কাজে স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ যে ভূমিকা পালন করতে পারবে, কেন্দ্রশাসিত পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে তেমনটা করা সম্ভব নয়। কলকাতা থেকে প্রকাশিত ঐকতান গবেষণাপত্র নামের একটি পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা আমাদের হাতে এসেছে; এ সংখ্যার আওয়াজটা হচ্ছে, ‘আক্রান্ত মাতৃভাষা, আসুন প্রতিরোধ করি’। সংখ্যাটির বক্তব্যগুলোর মূল সুরটি হচ্ছে, ‘বিপন্ন মাতৃভাষা, বিপর্যস্ত আত্মপরিচয়’। এ আওয়াজটা কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীরা ১৯৪৭-এ তোলেননি, তখন তারা- যাঁদের ব্রাহ্মণ্যবাদী বলা মোটেই অন্যায় নয়- মাতৃভাষা তথা আত্মপরিচয় বিপর্যস্ত হওয়ার আশঙ্কা দেখে আজ যেমন শঙ্কিত হচ্ছেন ১৯৪৭-এর দেশভাগের সময় তেমন শঙ্কা একেবারেই পোষণ করেননি। যা-ই হোক, সেটা অতীতের কথা। বর্তমানে তাঁরা দেখতে পাচ্ছেন এমনকি রবীন্দ্রনাথের নিজের হাতে-গড়া শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও বাংলা ভাষা বিতাড়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ চেয়েছিলেন শিক্ষাদান করা হবে মাতৃভাষাতেই; পরবর্তীতে আপস করে ঠিক করা হয়েছিল যে বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষাতেই বিদ্যাচর্চা করা যাবে। পত্রিকাটি জানাচ্ছে যে, সেখানে এখন শুধু ইংরেজির মাধ্যমেই শিক্ষা প্রদান চলছে। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন আর তার নিজের ইচ্ছানুসারে চলে না, চলে গেছে সে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসনাধীনে, কেন্দ্রীয় সরকার পারলে হিন্দিকে মাধ্যম করবে ইংরেজিকে সরিয়ে, অবস্থান দেবে না বাংলাকে। কারণ হিসেবে দেখাবে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণকে। পশ্চিমবঙ্গকে তাই লড়তে হবে, এবং হচ্ছে, কেন্দ্রীয় শাসনের বিরুদ্ধেই।

মেহনতিদের মেহনতই যে বাংলাদেশের উন্নতির চাবিকাঠি তার প্রমাণ প্রতিনিয়তই পাওয়া যাচ্ছে। এমনকি খেলাধুলায়ও। সাফ নারী ফুটবল প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের কিশোরীরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারা গোল দিয়েছে ২৩টি, খেয়েছে মাত্র ১টি। গোলরক্ষক হিসেবে যে মেয়েটি দুর্ভেদ্য প্রাচীরের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছে- রূপনা চাকমা নাম, সে এসেছে পার্বত্য চট্টগ্রামের দুর্গম এলাকা থেকে। সে থাকে যে ঘরটিতে তাকে বাড়ি বলা যায় না, বাঁশের একটা কাঠামো মাত্র। মেয়েটির বাবা নেই, দুই ভাই জুম চাষ করে সংসার চালানোর চেষ্টা করে। রূপনা বের হয়ে আসতে পেরেছে অন্য কোনো কারণে নয়, দুর্দমনীয় ইচ্ছাশক্তির জোরেই। গ্রামের বাইরে প্রাইমারি স্কুলে বিনা বেতনে পড়ত সে, থাকত এক শিক্ষকের বাসায়। আর খেলত। খেলতে খেলতেই খেলোয়াড়। জানা গেল যে মেয়েদের এই জাতীয় ফুটবল দলের ২৩ সদস্যের মধ্যে আটজন এসেছে গারো পাহাড়ের পাদদেশের এক গণ্ডগ্রাম থেকে। তাদেরও মনের জোর ছিল। খেলার অনুশীলন করেছে, তাই পেরেছে। দলের সদস্যদের একজন- মাসরুরা পারভিন; তার বসবাসের উপযুক্ত কোনো বাড়ি নেই। কাঠমান্ডু থেকে ফেরত এসে গরমে নিজেদের ঘরের ভিতর সে ঘুমাতে পারেনি, গাছতলায় বসে রাত কাটিয়েছে। নারী দলের আরেক কৃতী খেলোয়াড় আঁখির বাবার সঙ্গে পুলিশের দুই সদস্য ‘অশোভন’ আচরণ করেছে বলে খবর বের হয়েছে। ওই দুই পুলিশ গেছিল আঁখিদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ করতে।

গরিব ঘরের এই নারী খেলোয়াড়রাই বাংলাদেশের জন্য দুর্লভ উচ্চসম্মান নিয়ে এসেছে। তার পরে কী হলো? মহা হইচই মহা হট্টগোল। বিমানবন্দরে সাংবাদিক তো অবশ্যই, কৌতূহলী মানুষের এমনই ভিড় যে মেয়েরা বের হতেই পারে না। কোনোমতে বের হয়ে এসে দেখে কয়েকজনের লাগেজ কাটা। কী ব্যাপার? না, লাগেজ কেটে ডলার হাতিয়ে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এর পরে দেখা গেল খেলোয়াড়দের সংবর্ধনা জানানোর জন্য বিমানবন্দরে যে আয়োজন তাতে যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী, তাঁর সচিব ও ফুটবল ফেডারেশনের যে কর্মকর্তা উপস্থিত তাঁদের গলায় ঝুলছে ফুলের মালা। যেন তাঁরাই জিতেছেন। এটা প্রথম ছবি। দ্বিতীয় ছবি সংবাদ সম্মেলনের। তাতে দেখা গেল কর্তাব্যক্তিরা সবাই সামনের সারিতে বসে আছেন, পেছনে দণ্ডায়মানদের সারিতেও তাঁরাই; খেলোয়াড় দলের অধিনায়ক সাবিনা খাতুন দাঁড়িয়ে আছে এক কোণে, কোচকে খুঁজেই পাওয়া যাচ্ছে না!

এর পরে মহাউদযোগ। ছাদখোলা বাসে রাজধানীর রাস্তায় খেলোয়াড়দের অভিনন্দন ও সম্মাননা। সেখানে আরেক ঘটনা অপেক্ষা করছিল। অভিনন্দিত ও দণ্ডায়মান খেলোয়াড়দের মধ্যে একজনের- পার্বত্য চট্টগ্রামের ঋতুপর্ণা চাকমার মাথায় আঘাত করল বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের ঝুলন্ত পেরেক। রক্তারক্তি ঘটনা। ঋতুপর্ণাকে নিয়ে যাওয়া হলো কম্বাইন্ড মিলিটারি হাসপাতালে; মাথায় সেলাই দিতে হলো তিনটি। ঋতুপর্ণা শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারল না।

এই যে নারী খেলোয়াড়দের প্রান্তবর্তিতা, সম্মান জানানোর অসিলায় তাদের অসম্মানিত করা, এবং একজনের মাথায় আঘাত প্রাপ্তির বন্দোবস্ত- এসব শুধু যে ঘটনা তা তো নয়, বাস্তবতার উন্মোচনও বইকি। প্রথম উন্মোচনটা এ বাস্তবতার যে, এ দেশের আয়-অর্জন যা ঘটছে তা মেহনতি মানুষের শ্রমের কারণেই। দ্বিতীয় উন্মোচনটি এই যে, সেই মেহনতিরাই সর্বত্র অসম্মানিত হচ্ছে। তৃতীয়ত, উন্নতির নিজে তো অবশ্যই, তার প্রচার-প্রচারণাও আঘাত করছে সৃষ্টিশীলতাকে, ঋতুপর্ণারা যে জন্য রক্তাক্ত হচ্ছে বিজ্ঞাপনী বিলবোর্ডের পেরেকের ঘায়ে। আর এটা তো প্রমাণিত হলোই যে, রাষ্ট্রক্ষমতায় যারা প্রতিষ্ঠিত সব জাতীয় অর্জন কুক্ষিগত করাতেও তারাই সর্বাগ্রে।

উন্মোচিত হলো আরও একটি সত্য; সেটা এই যে, মেয়েরাও পারে। মেয়েরা খেলবে, তা-ও আবার ফুটবল, এবং ফুটবল খেলে আন্তর্জাতিক সম্মান নিয়ে আসবে- এসব তো অল্প দিন আগেও অকল্পনীয় ছিল। মেয়েরা পারে; কিন্তু মেয়েদের সেই সৃষ্টিশীলতাকে দমন করে রাখা হয়েছে। পিতৃতান্ত্রিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থাই সেটা করেছে। ফুটবল দলের এই মেয়েরা যা করতে পেরেছে তার পেছনে একটা কারণ অবশ্যই এই যে, তারা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সদস্য, পিতৃতান্ত্রিকতার শাসন যেখানে কিছুটা হলেও শিথিল।  রাজধানীর মেয়েরা কিন্তু পারে না। ওদিকে রাজধানীতে দেখেছি মেয়েদের নিজস্ব স্টেডিয়ামে ফুটবল খেলার ব্যাপারেও ধর্মব্যবসায়ীরা প্রতিবাদ জানিয়েছে। বলেছে ওই কাজ শরিয়তবিরোধী। তাহলে উপায়!

লেখক : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ খবর