শনিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩ ০০:০০ টা

বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ও আমার স্কুলজীবন

তপন কুমার ঘোষ

বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ ও আমার স্কুলজীবন

প্রতি বছর ১ জানুয়ারি সারা দেশে উৎসব করে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।  তবে এ বছর বই মুদ্রণ ও বিতরণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। তাড়াহুড়া করে বছরের শেষ দিকে বই ছাপার কাজ শুরু করায় কিছু বইয়ে ভুলভ্রান্তি থেকে গেছে। বইয়ের কাগজ ও ছাপার মান নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছে। এ নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনা হয়েছে। আজকের লেখার বিষয় এটা নয়। আজকের বিষয় ভিন্ন। বছরের প্রথম দিন নতুন বই হাতে আনন্দ-উল্লাসে মেতে ওঠা শিক্ষার্থীদের দেখে স্কুল জীবনের কথা খুব মনে পড়ে। নড়াইলের এক অজগ্রামে আমার জন্ম। স্কুল জীবন কেটেছে গ্রামে। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত সুমেরুখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয়। আমাদের সময় স্কুলের কী দৈন্যদশা! গোলপাতার ছাউনি দেওয়া চৌচালা ঘর। মেঝে কাঁচা। ভাঙা বেড়া। চেয়ার-টেবিল নড়বড়ে। তবে স্কুলের সামনে ছিল খেলার মাঠ। স্কুলের পেছনে লাইন দিয়ে আমরা ছেলেমেয়েরা সুর করে নামতা মুখস্থ করতাম। হাতেখড়ি অনুষ্ঠানে শিশু শিক্ষার্থীকে কাঠের সেøটে অ, আ, ক, খ লেখা শেখানো হতো। শিশু শ্রেণিতে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর প্রণীত ‘বর্ণপরিচয়’ বইটি ছিল অবশ্যপাঠ্য। মুদি দোকানে বইটি কিনতে পাওয়া যেত। সন্তানকে স্কুলে পাঠানোর আর্থিক সংগতি ছিল না অনেক অভিভাবকের। যারা স্কুলে ভর্তি হতো তাদের মধ্যে অনেকে আবার ঝরে পড়ত। স্কুলে শৃঙ্খলাভঙ্গ করলে রক্ষা নেই। চিকন বেতের বাড়ি হাত পেতে নিতে হতো। আরও শাস্তি ছিল নি-ডাউন আর কানমলা। সহপাঠীদের সঙ্গে সামান্যতেই মান-অভিমান, আড়ি দেওয়া-আড়ি ভাঙার খেলা চলত।

মাধ্যমিকে আমার স্কুল সিঙ্গাশোলপুর কে পি ইনস্টিটিউশন। এটা প্রতিষ্ঠাকালীন নাম। পরবর্তীতে নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে সিঙ্গাশোলপুর কে পি মাধ্যমিক বিদ্যালয়। ১৯২১ সালে স্থানীয় জমিদার কালি প্রসন্ন রায় স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। আমাদের সময় দুটি সেমিপাকা ভবনে ক্লাস হতো। আমাদের স্কুলের খুব নামডাক ছিল। দূর-দূরান্ত থেকে ছাত্ররা এসে এ স্কুলে ভর্তি হতো। অনেকে গৃহস্থ বাড়িতে লজিং থেকে থাকা-খাওয়ার বিনিময়ে বাড়ির ছেলেমেয়েদের পড়াত। স্কুলে কোনো ড্রেস কোড ছিল না। লুঙ্গি বা হাফপ্যান্ট পরেও অনেকে আসত। ধুলায় ধূসর গ্রামের কাঁচা রাস্তা। কেউ আসত চপ্পল পায়ে, আবার কেউ বা খালি পায়ে। পুরনো বই পড়েই আমরা স্কুলজীবন কাটিয়ে দিয়েছি। উপরের ক্লাসের ছাত্রদের কাছ থেকে পুরনো বই অর্ধেক দামে পাওয়া যেত। এখনকার মতো প্রতি বছর নতুন বই। তাও আবার বিনামূল্যে! এটা তখন কল্পনাই করা যেত না।

আমাদের প্রধান শিক্ষক বিমলা চরণ চক্রবর্তী স্যারের নাম উল্লেখ না করলেই নয়। নবম ও দশম শ্রেণিতে গণিত ও ইংরেজি পড়াতেন। হেড স্যারকে সবাই বলতেন অঙ্কের জাহাজ। ইংরেজিতেও সমান পারদর্শী ছিলেন। দীর্ঘদেহী হেড স্যার স্কুলে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসতেন। ছাত্রদের পড়ানোই ছিল তাঁর ধ্যান-জ্ঞান। স্কুল ছুটির পর দশম শ্রেণির মেধাবী ছাত্রদের নিয়ে কোচিং ক্লাস নিতেন। পয়সার বিনিময়ে নয়। তাঁর চিন্তা-চেতনায় ছিল স্কুলের সুনাম। শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্ক ছিল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার। নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকদের সমাজের সবাই সমীহ ও সম্মান করতেন। হেড স্যারকে আমরা যমের মতো ভয় করতাম। পড়াশোনায় মনোযোগী না হওয়ায় আমার মা আক্ষেপ করে বলতেন, আমার পেছনে টাকা খরচ করা আর ভস্মে ঘি ঢালা নাকি একই কথা! এটা যে মায়ের অন্তরের কথা নয় তা বোঝার বয়স তখনো আমার হয়নি।

কলেজ জীবন কেটেছে নড়াইল শহরে। গ্রাম ছেড়ে এই প্রথম শহরে আসা। নড়াইল ভিক্টোরিয়া কলেজ ১৮৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত। ভিক্টোরিয়া কলেজে দুই বছর অধ্যয়নের পর ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই। তখন নড়াইল থেকে ঢাকা যাওয়া-আসা ছিল খুবই বিড়ম্বনার! লঞ্চে দুপুর নাগাদ খুলনায় পৌঁছে স্টিমারের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। রাত ৮টার দিকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যেত স্টিমার। মোংলা-বরিশাল-চাঁদপুর হয়ে ঢাকার সদরঘাট পৌঁছাতে পর দিন সন্ধ্যা ঘনিয়ে যেত।

এখন রাজধানী ঢাকা নড়াইলের অনেক কাছে চলে এসেছে। মাত্র আড়াই ঘণ্টার জার্নি। ভাবা যায়! স্বপ্নের পদ্মা সেতু ও নবনির্মিত মধুমতী সেতু কমিয়ে দিয়েছে নড়াইল-ঢাকার দূরত্ব। রাজধানী থেকে ফরিদপুরের ভাঙ্গা পর্যন্ত বিস্তৃত বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে ইউরোপ-আমেরিকার কোনো হাইওয়ে বলে ভ্রম হতে পারে। এটি বাংলাদেশের। চলন্ত গাড়িতে বসে গরম চা খাওয়া যায় নির্দ্বিধায়। শুধু অবকাঠামো নয়, সামাজিক প্রায় সব সূচকে বাংলাদেশ উন্নতি করেছে। স্কুল জীবনের সেই সুমেরুখোলা প্রাথমিক বিদ্যালয় সরকারি হয়েছে স্বাধীনতার পরপরই। দৃষ্টিনন্দন নতুন স্কুল ভবন কচিকাঁচাদের আকর্ষণ করে। সিঙ্গাশোলপুর কে পি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এখন পাঁচতলা ভবনে। বিগত বছরগুলোতে শিক্ষার প্রসারে অনেক কিছুই করেছে সরকার। প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনামূল্যে পাঠ্যবই বিতরণ করা হচ্ছে। মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত মেয়েদের শিক্ষা অবৈতনিক করেছে সরকার। প্রাথমিক শিক্ষা আগে থেকেই অবৈতনিক। দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি দেওয়া হচ্ছে। দেশে শিক্ষার হার বেড়েছে নাটকীয় হারে।  বিশেষ করে নারী শিক্ষার হার। কিন্তু শিক্ষার মান? এটা নিয়ে প্রশ্ন আছে। এ নিয়ে গবেষণা করা যেতে পারে। কেউ কেউ বলেন, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গবেষণার প্রয়োজন পড়ে না।  তাঁদের সাফ কথা, শিক্ষার হার বেড়েছে, কমেছে মান। এ দিকটায় এখন মনোযোগ দেওয়া দরকার।

 

লেখক : সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক, জনতা ব্যাংক লিমিটেড।

সর্বশেষ খবর