শনিবার, ১১ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

অর্গানিক মুরগির খামার

শাইখ সিরাজ

অর্গানিক মুরগির খামার

গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার বাঁশতলী গ্রামে প্রকৌশলী ইমরুল তার অর্গানিক মুরগির খামারটিকে আরও বড় পরিসরে সাজিয়ে তুলেছেন। পাঠক, বছর দেড়েক আগে ইমরুলের অ্যান্টিবায়োটিকবিহীন মুরগির খামার নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করেছিলাম চ্যানেল আইয়ের ‘হৃদয়ে মাটি ও মানুষ’ অনুষ্ঠানে। ইমরুল হাসান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে পড়াশোনা শেষে কাজ করেছেন দেশে ও দেশের বাইরের বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে। চাইলেই উন্নত কোনো দেশে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা নিতে পারতেন। উন্নত দেশে উচ্চ বেতনের চাকরি নিয়ে বেশ ভালোভাবেই জীবন কাটিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু তার ভিতর যেমন দেশপ্রেমের বীজবপিত আছে। আছে বাবা-মা-সন্তানের প্রতি দায়িত্ববোধ। ইমরুল হাসানের জীবনবোধে যেমন দায়িত্বশীলতার পরিচয় পাওয়া যায়, কাজের ক্ষেত্রেও তিনি ঠিক তেমনই। করোনায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হয়েছিলেন। সেরে ওঠার পর ভাবলেন, এ যাত্রায় যেহেতু বেঁচে গেছেন, সেহেতু ভালো কিছু করতেই হবে। যা থেকে দশের উপকার হবে, হবে দেশসেবা। সে চিন্তা থেকেই শুরু করেছিলেন অ্যান্টিবায়োটিকমুক্ত মুরগির খামারের যাত্রা।

এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণিজ আমিষের অন্যতম প্রধান উৎস মুরগির মাংস। মুরগির মাংসের চাহিদা দিন দিন বাড়ছেই। বিশেষ করে শহরের নতুন প্রজন্ম আর মাছে-ভাতে বাঙালি নেই। ওরা মুরগিপ্রিয় এক প্রজন্ম। তাই চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মুরগির মাংসের বাণিজ্য দিন দিন বড় হচ্ছে। কিন্তু বাণিজ্যিক মুরগির খামারগুলোতে মুরগিকে দ্রুত বড় করতে ব্যবহার করছে ক্ষতিকর গ্রোথ হরমোন এবং বিভিন্ন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে নিয়মিত ব্যবহার করছে অনিয়মের অ্যান্টিবায়োটিক। প্রাণিখাদ্যে যথেচ্ছ অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার মানব স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর।

দেশের প্রাণিখাদ্য আইন অনুযায়ী, কোনো প্রাণীকে মোটাতাজা করার কাজে ব্যবহৃত খাদ্য ও পোলট্রি ফিডে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্য আইন, ২০১০ এর ১৪ ধারার ১ উপ-ধারায় বলা আছে, ‘মৎস্যখাদ্য ও পশুখাদ্যে অ্যান্টিবায়োটিক, গ্রোথ হরমোন, স্টেরয়েড ও কীটনাশকসহ অন্যান্য ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা যাইবে না’।

আইনগতভাবে নিষিদ্ধ হলেও বাণিজ্যিক খামারগুলোতে থেমে নেই অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের কারণে ডিম-দুধ-মাংসের মাধ্যমে এসব ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়ছে মানুষের শরীরেও। বাড়ছে কিডনি, লিভার জটিলতা, আলসার, হৃদরোগ, ক্যান্সারের ঝুঁকি। আছে মানবদেহে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরির মতো ভয়াবহ আশঙ্কাও। প্রকৌশলী ইমরুল তার প্রকৌশলবিদ্যার কৌশলে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। প্রযুক্তিনির্ভর খামার তৈরির মাধ্যমে গড়েছেন নিরাপদ আমিষের বাণিজ্য। সেই সাফল্যের ধারাবাহিকতায় বেড়েছে এবারের স্বপ্নের পরিসর। স্বপ্ন দেখতে জানলে, তা বাস্তবায়ন করা কঠিন কিছু নয়, যদি নিষ্ঠা আর একাগ্রতা থাকে। ইমরুল ক্রাউড ফান্ডিংয়ের মাধ্যমে মিটিয়েছেন অর্থের জোগান। এখন পৌনে চার একর জমি লিজ নিয়ে সাতটি শেডে খামারের সম্প্রসারণ করেছেন তিনি। শেডগুলো তৈরি করা হয়েছে ফ্রি রেঞ্জ মুরগি পালনের ধারণাকে মাথায় রেখে। ফ্রি রেঞ্জ হলো মুরগিকে শেডের মধ্যে আটকে না রেখে খোলা জায়গায় মাটিতে ছেড়ে লালন-পালন। মুরগি যেন খোলা জায়গায় প্রকৃতির কাছাকাছি পরিবেশে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায়।

বেশ গুছিয়ে শুরু করেছেন ইমরুল। প্রকৌশলবিদ্যার অনেক কিছুই কাজে লাগাচ্ছেন খামারে। স্মার্ট ফার্মিং যেটাকে বলা হচ্ছে, যেমন খামারের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ, আলো-বাতাসের পর্যাপ্ততা নির্ণয়, পানি ব্যবস্থাপনা। সবই নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে কম্পিউটারের মাধ্যমে। নিজের হাতে তৈরি সব প্রযুক্তি। ইমরুলের খামারের চারটি অংশ। একটি অংশে ব্রয়লার মুরগি। খামারের শেডে ছেড়ে মুরগি লালন-পালন করেন তিনি। মুরগিগুলোর চলাফেরার জন্য যথেষ্ট জায়গা রেখেছেন তিনি। মনে পড়ছে এমনটা দেখেছিলাম জাপানের এক মুরগির খামারে। শেডে মুক্ত অবস্থায় মুরগি লালন-পালন করছিলেন তারা। এমনকি শেডের বাইরে উন্মুক্ত স্থানে ঘুরে বেড়ানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল মুরগির জন্য। দেখার সুযোগ হয়েছে, ইল্যান্ডের নিউ ক্যাসেলে টিউলিপ ফ্যামিলির জন্য লিন্ডহাল ফার্মেও মুরগি লালন-পালন করা হয় উন্মুক্ত জায়গায়। নরসিংদীর আর এক তরুণ কামরুল ইসলাম মাসুদকে তার খামারেও মুক্ত অবস্থায় মুরগি লালন-পালন করতে দেখেছিলাম।

আন্তর্জাতিকভাবেই মানব স্বাস্থ্যর কথা ভেবে এখন খোলা পরিবেশে প্রাণী লালন-পালনকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। বছর আটেক আগে ব্রিটেনের নিউ ক্যাসেলের লিন্ডহাল ফার্মের খোলা জায়গায় ছেড়ে মুরগি লালন-পালনের চিত্র তুলে ধরেছিলাম। তারা ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের গাইডলাইন মেনে শতভাগ অর্গানিক উপায়ে মুরগি লালন-পালন করে। এখানেও ঠিক একই চর্চা। দেখলাম ইমরুলের খামারে মুরগিকে দানাদার খাবারের পাশাপাশি লালশাক, শজনে পাতা ইত্যাদি খাবারও দেওয়া হচ্ছে। দেশি জাতের মুরগির বাচ্চাগুলোও সে খাবার ঠোকরে খাচ্ছে শেডে। আরেক শেডে সোনালি জাতের মুরগি আছে। আবার অন্য শেডে আছে লেয়ারসহ হরেক জাতের মুরগি। জানতে চাইলাম, ‘গতবার বলছিলেন বিপর্যয়ের কথা, কী ধরনের বিপর্যয়ের ভিতর দিয়ে যেতে হয়েছে আপনাকে?’

‘একবার ৪০% মুরগি মারা পড়ল। বেশ বড় হয়েছিল মুরগিগুলো। আর দিন দশেক পর বিক্রি উপযোগী হয়ে উঠত। ফলে আমার লোকসান হলো ৬ লাখ টাকা। আরেকবার ৬০% মুরগি মারা পড়ল, ছোট অবস্থায় মারা যাওয়ার কারণে সেবার অবশ্য লোকসান কম হয়েছে, ১ লাখ ২৫ হাজার টাকার মতো। এ রকম ট্রায়াল অ্যান্ড অ্যাররের ভিতর দিয়ে এগোচ্ছি।’ জানালেন ইমরুল।

এখানে কী সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছেন? বললেন, অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করি না বলে মর্টালিটির হার এখনো বেশি। অন্যদিকে মুরগির জন্য ২০-২৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বেশ উপযোগী। কিন্তু আমাদের দেশে তাপমাত্রা গরমকালে অনেক বেশি বেড়ে যায়। আবার শীতেও নেমে আসে নিচে। ফলে তাপমাত্রা কন্ট্রোল করাটাই সবচেয়ে চ্যালেঞ্জের। প্রতিটি সংকট থেকেই ইমরুল শিখছেন সমাধানের পথ। নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের আনন্দ তাকে জোগাচ্ছে সামনে এগোনোর অনুপ্রেরণা। দারুণ কিছু একটা করে ফেলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। স্বপ্নটা তার অনেক বড়। নিরাপদ খাদ্যের নিজস্ব একটা ব্র্যান্ড তৈরি করতে চান। এ দেশের সন্তানের মুখে তুলে দিতে চান নিরাপদ খাদ্য। বেশ উদ্যমী ইমরুল। নিজের কাজের জায়গাটা যেমন গোছানো, চিন্তাটাও পরিচ্ছন্ন। জানতে চাইলাম, বেচাবিক্রির অবস্থা কী? জানালেন অনলাইনেই বিক্রি হয়ে যায় তার সব মুরগি। জবাই করে ফ্রিজিং ভ্যানে করে বাড়ি বাড়ি পৌঁছে দেন। ইমরুলের উদ্যোগটা নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। আমরা চাই প্রতিটি খাবারই হোক নিরাপদ। খাদ্য উৎপাদন ব্যবস্থা উন্নত হলে, শতভাগ নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা গেলে আমাদের কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে সমাদৃত হবে। কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে আমাদের অর্থনীতি হবে কৃষি রপ্তানিভিত্তিক। এমন স্বপ্নই তো আমরা দেখে আসছি দিনের দিন। ফলে কৃষিতে সমৃদ্ধি আসবে। তরুণ প্রজন্ম নিজেদের কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারবে। দেশ এগিয়ে যাবে, নিশ্চিত হবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি আজকের দিনে ‘নিরাপদ খাদ্যের’ বিষয়টিকেও বৈশ্বিক অঙ্গনে সমানভাবে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। একদিকে মানুষের স্বাস্থ্যের বিষয়টি যেমন ভাবতে হবে, অন্যদিকে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন করা না গেলে আমাদের উৎপাদিত কৃষিপণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশ করতে পারবে না-এ সত্যটিও উপলব্ধিতে রাখতে হবে। তাই খাদ্য উৎপাদনে শুদ্ধতার চর্চা জরুরি। দীর্ঘমেয়াদি সুপ্রসারিত কৃষি বাণিজ্যের পরিকল্পনার প্রথম পদক্ষেপ হওয়া প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন, যা আমাদের এগিয়ে রাখবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা পূরণে। তাই ইমরুল হাসানের মতো উদ্যোক্তাদের উদ্যোগগুলো এগিয়ে নিয়ে যেতে সব সমস্যা সমাধানে তাদের পাশে সরকারি-বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলোর নীতিগত অবস্থান প্রত্যাশা করি।

লেখক : মিডিয়া ব্যক্তিত্ব  

[email protected]

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর