সোমবার, ২০ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

একাত্তরের নভেম্বরেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা

 লে. কর্নেল (অব.) জাফর ইমাম বীরবিক্রম

একাত্তরের নভেম্বরেই বিধ্বস্ত হয়ে পড়ে পাকিস্তানিরা

বাংলাদেশে গণহত্যার প্রতিবাদে এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে ২৮টি দেশ সফর করেন। সেদিন ভারত সরকার ও ভারতের জনগণ আমাদের মুক্তি সংগ্রামে যে সহযোগিতা এবং অবদান রাখেন আমরা কখনো তা খাটো করে দেখি না, কারণ তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতার ফলেই আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়।  এ ছাড়া যুদ্ধ শুরুর প্রথম পর্যায়ে (অর্থাৎ ২৫ মার্চ থেকে জুলাই মাস পর্যন্ত) এই পর্বে ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বিএসএফের সহযোগিতায় মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান, অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহসহ রণাঙ্গনে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীকে আর্টিলারি সাপোর্ট প্রদান করে এবং এই সহযোগিতা অব্যাহত রাখে।

আমাদের বিশাল মুক্তিবাহিনী তথা সেক্টর ফোর্স ও সেক্টর-ভিত্তিক দেশব্যাপী ব্যাপক গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ সংঘটিত হয় এবং অব্যাহত থাকে। পাকিস্তান-প্রশিক্ষিত সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিক ও অফিসার, ইপিআর, পুলিশ, আনসার, মুজাহিদ ও প্রশিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত ৯টি বেঙ্গল রেজিমেন্ট নিয়ে গঠিত তিনটি সামরিক ব্রিগেডের (কে, এস ও জেড ফোর্স) পরিচালিত ব্যাপক গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ মুক্তিযুদ্ধের গতিকে আরও তীব্রতা প্রদান করে। আমাদের নবগঠিত বিমান বাহিনী অত্যন্ত মামুলি বিমান নিয়ে রাতের অন্ধকারে রাডার ছাড়াই ‘কিলো ফ্লাইট’ অপারেশনে চট্টগ্রাম রিফাইনারি ও নারায়ণগঞ্জের তেলের ডিপো বোমা ফেলে ধ্বংস করে এবং নৌ বাহিনীর ‘জ্যাকপট’ অপারেশনে আমাদের ফ্রান্সে প্রশিক্ষিত নেভাল কমান্ডোরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে মাইন দিয়ে চট্টগ্রাম হারবার ও মোংলা বন্দরে ২৮টি জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। এ ছাড়া আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সেক্টর ফোর্সের একটি অংশের সঙ্গে পৃথকভাবে ভারতীয় সেনাবাহিনী অনেকগুলো যৌথ অপারেশনের মাধ্যমে যুদ্ধের গতি ও তীব্রতা বৃদ্ধি পায় এবং এই যৌথ অপারেশনের পাশাপাশি আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও সেক্টর ফোর্স এবং গেরিলাদের দেশব্যাপী ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানি বাহিনীকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে ফেলি। এ পর্যায়ে (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর) এই অপারেশনগুলোতে আমাদের মুক্তিপাগল জনগণের ব্যাপক সহযোগিতা ও অংশগ্রহণে যুদ্ধের নতুন গতি সঞ্চার হয় ও তীব্রতা দিন দিন বৃদ্ধি পেতে থাকে। যৌথ অপারেশনগুলোতে আমাদের ও ভারতীয় বাহিনীর উভয় পক্ষের ব্যাপক সংখ্যক সৈন্য ও অফিসার হতাহত হন। যৌথ অপারেশনগুলোতে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অনেক অফিসার ও সৈনিকের রক্তে সেদিন বাংলার মাটি রঞ্জিত হয়েছিল। এর পাশাপাশি পৃথকভাবে দেশব্যাপী আমাদের নয় মাসের চলমান ব্যাপক গেরিলা যুদ্ধ ও বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেক্টর ফোর্সসহ নৌ বাহিনীর নেভাল কমান্ডোদের দুঃসাহসী ‘অপারেশন জ্যাকপট’ এবং বিমান বাহিনীর ‘কিলো ফ্লাইট’ অপারেশন এবং সেই সঙ্গে দেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধা ও জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতা অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ একটি গণযুদ্ধে রূপলাভ করে। সেই যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর অবদান, ত্যাগ, সাহসিকতা, যুদ্ধ জয়, রণনৈপুণ্য ও তাদের অসামান্য বীরত্বের কথা এখনো সঠিকভাবে এবং পূর্ণাঙ্গভাবে লিপিবদ্ধ ও সংরক্ষিত হয়নি। যেমন- ঢালাই যুদ্ধ, বিলোনীয়া যুদ্ধ, গরীবপুর যুদ্ধ, বয়রা যুদ্ধ, গাজীপুর যুদ্ধ, হিলি যুদ্ধ, কামালপুর যুদ্ধ, সালদা নদী যুদ্ধ, কসবা যুদ্ধ, আখাউড়া যুদ্ধ, ফুলগাজী যুদ্ধ, রৌমারি যুদ্ধ, নৌ বাহিনীর ‘অপারেশন জ্যাকপট’ ও বিমান বাহিনীর ‘অপারেশন কিলো ফ্লাইট’ প্রভৃতি। এই বিখ্যাত যুদ্ধগুলোর পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের নৈপুণ্য, রণকৌশল ও সাহসিকতা এবং তাদের ত্যাগ ও অবদান-এগুলোও সঠিকভাবে লিপিবদ্ধ হয়নি বিধায় ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই সাড়ে আট মাসের যুদ্ধের ইতিহাস হারিয়ে যেতে বসেছে। ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৩ দিন ছিল মিত্রবাহিনীর কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্ব (মিত্রবাহিনী গঠিত হয়েছিল ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার পর, মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে)। ফলে দেখা যাচ্ছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত একটানা নয় মাস ছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, যা কখনোই ‘পাক ভারত’ যুদ্ধ বা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না। এই একটানা নয় মাসের যুদ্ধই ছিল আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ। তথাকথিত এই লেখকদের ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ আখ্যা দান তাই শুধু মিথ্যাচারই নয়, জাতিসংঘে যুদ্ধ ইতিহাস বিকৃতকরণ সংক্রান্ত ঘোষণা অনুযায়ী এটি যুদ্ধাপরাধও বটে এবং তাদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হীন অপচেষ্টা ও চক্রান্ত।

সম্প্রতি একজন বিদেশি সাংবাদিক কথা প্রসঙ্গে আমাকে যখন বলেন যে, ১৯৭১-এ এটি ছিল ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’। তার কঠোর জবাবে আমি বলি, ‘তোমরা একটি জাতির জন্ম-ইতিহাস বিকৃত করে গোটা জাতির সঙ্গেই প্রতারণা করছো।’ আমি যখন সংক্ষেপে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং কীভাবে এ যুদ্ধ সংঘটিত হয় তা সংক্ষেপে তার সামনে তুলে ধরলাম, তখন সে অনুতপ্ত বোধ করে এবং আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করে যে, এই যুদ্ধ যদি ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ না হয়ে থাকে, তাহলে এত বড় রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ নিয়ে তোমাদের দেশে তথ্যপূর্ণ ও গবেষণাধর্মী প্রকাশনা বা বিশ্বমানের ডকুমেন্টারি নির্মাণের উদ্যোগ নিতে দেখি না কেন? তোমাদের দেশে কি লেখক, গবেষক বা সাংবাদিক নেই, যাদের জ্ঞানগর্ভ গবেষণা থেকে যুদ্ধের সঠিক ইতিহাস উঠে আসে বা ইতিহাস যারা বিকৃত করছে, তাদের ঠিকমতো জবাব দেওয়া সম্ভব হয়?

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতকারী এসব দেশি-বিদেশি জ্ঞানপাপী কতিপয় লেখক, ভাষ্যকার ও চিত্রনির্মাতার কেউ কেউ হয়তো এককভাবে ভারতের কাছে পাক বাহিনীর আত্মসমর্পণের মনগড়া ধারণা দিয়ে থাকে পাকিস্তানের পরাজয়ের গ্লানি ঢাকা দেওয়ার জন্য এবং পাকিস্তানকে জাতে তোলার জন্য, যা উদ্দেশ্যমূলক একটি মিথ্যাচার ছাড়া আর কিছুই নয়। পাশাপাশি ভারতেরও কিছু কিছু লেখক এ ধরনের ইতিহাস বিকৃতির প্রতিবাদ না করে পাকিস্তানের পরাজয়ের কৃতিত্ব এককভাবে তাদের ঝুড়িতে নেওয়ার জন্য আমাদের এই নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলে ধারণা দিয়ে থাকে, যা কখনোই ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ ছিল না। কারণ, নয় মাসের মধ্যে সাড়ে আট মাসের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থায় তৃতীয় পক্ষের মধ্যস্থতায় সম্মানজনক ও নিরাপদ একটি আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে। এই সাড়ে আট মাসের যুদ্ধে আমাদের মুক্তিবাহিনী তথা যুদ্ধরত মুক্তিযোদ্ধারা রণাঙ্গনে হাজার হাজার এবং দেশের ভিতরে এই গণযুদ্ধ সমর্থনের কারণে মোট ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হন এবং ২ লাখ মা-বোন সম্ভ্রম হারান। পাশাপাশি ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসার ও সৈনিকসহ সর্বমোট ৪ হাজার হতাহত হন। এই সাড়ে আট মাসের পর যখন ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধের ঘোষণা আসে এবং মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে ‘মিত্রবাহিনী’ গঠিত হয়, ৩ ডিসেম্বর থেকে নিয়ে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৩ দিনের মাথায় অর্থাৎ ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ১৩ দিনের মাথায় পাকবাহিনীর মিত্রবাহিনীর কাছে তথা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ একটানা নয় মাসের যুদ্ধ বিজয়ের ফসল। তাই এই যুদ্ধ কখনো ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ কিংবা ‘তেরো দিনের যুদ্ধ’ ছিল না। এই ১৩ দিন ছিল মূলত পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের Operational Phase..

পাকিস্তান ও ভারতের শীর্ষ যুদ্ধ বিশারদগণ (ওয়ার ভেটারেনস্) যা তাঁদের মূল্যায়নে ও স্মৃতিচারণে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন এবং তাঁদের ’৭১-এর যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থে’ ও বক্তব্যে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর বীরত্বগাথাকে যথার্থভাবে স্মরণ করেছেন ও স্বীকৃতি প্রদান করেছেন, যার কিছু নমুনা এখানে তুলে ধরছি :

লে. জেনারেল জয় ভগবান সিং যাদব-এর বক্তব্য :

‘১৯৭১ এর যুদ্ধকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলে অভিহিত করা সঠিক নয়।’ তাঁর মতে, ‘ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যে যুদ্ধগুলো হয় সেগুলোকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলা যেতে পারে। কিšুÍ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে এটি ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ‘মিত্রবাহিনী’ যুদ্ধ (মিত্রবাহিনী গঠিত হয় ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী এবং বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে)। বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর সাহসিকতায় মুগ্ধ হন ভারতীয় যুদ্ধবিশারদগণ (ওয়ার ভেটারেন)। যুদ্ধের শেষে দেশে ফিরে যাবার সময় তাঁরা বাংলাদেশ বাহিনীর অত্যন্ত ইতিবাচক স্মৃতি সঙ্গে নিয়ে যান।’ ওপরের মূল্যায়নে দেখা যাচ্ছে, ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিল পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণ অপারেশনের অধ্যায়। এই অধ্যায়ে বড় কোনো যুদ্ধ সংঘটিত হয়নি। তবে কোথাও কোথাও মিত্রবাহিনীকে স্থানীয় প্রতিরোধের মুখোমুখি হতে হয়।

এই ১৩ দিন (৩ ডিসেম্বর-১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১) ছিল পাক-বাহিনীর আত্মসমর্পণ প্রস্তুতি পর্ব, কখনোই তা ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ ছিল না। যদি হয়েও থাকে, সেটি ছিল ভারত ও পশ্চিম পাকিস্তান (বর্তমান পাকিস্তান) সীমান্তে।

জেনারেল জয় ভগবান সিং যাদবের বক্তব্য এ জন্যই সম্পূর্ণ সঠিক যে, পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয় ৩ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধ ঘোষণার পর। তিনি যথার্থই বলেছেন, ভারত-পাকিস্তান সীমান্তে যে যুদ্ধগুলো হয় সেগুলোকে ‘পাক-ভারত যুদ্ধ’ বলা যেতে পারে। কিšুÍ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর নয় মাসের একটানা মুক্তিযুদ্ধ, যা শুরু হয়েছিল ২৫ মার্চ থেকে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর, এই সময়কালে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন যৌথ অপারেশনে সীমিত আকারে অংশগ্রহণ করতে থাকে এবং এর পাশাপাশি আমাদের সংগঠিত ১১টি সেক্টরের অধীনে গেরিলা এবং সম্মুখযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ১১টি সেক্টরের ঊর্ধ্বে রণাঙ্গনে যুদ্ধরত পাকিস্তান-প্রশিক্ষিত সৈনিক ও অফিসারদের দ্বারা সংগঠিত ‘এস’, ‘কে’ এবং ‘জেড’ ফোর্স গঠিত হয়, যা আমাদের সম্মুখযুদ্ধের তীব্রতা ও গতি আরও বৃদ্ধি করে। সেপ্টেম্বর-অক্টোবর-নভেম্বর ভারতীয় বাহিনীর সক্রিয় সহযোগিতায় একক এবং বিভিন্ন যৌথ অপারেশন পরিচালিত হয়। নভেম্বরের মধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে আমরা পর্যুদস্ত করে তুলি এবং এই পর্যায়ে পাকিস্তান বাহিনী এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ে যে, তাদের সৈন্য এবং সামরিক সরঞ্জাম ও রসদ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ও সামরিক মনোবল এতটাই কমে যায় যে, তারা নভেম্বর মাসের শেষনাগাদ আক্রমণাত্মক থেকে রক্ষণাত্মক ভূমিকায় নেমে আসে।

এই পর্যায়ে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধীর যুদ্ধ ঘোষণা থেকে ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এই ১৩ দিন ছিল পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি পর্ব, যখন মিত্রবাহিনী জেলা-মহকুমাগুলো এড়িয়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে পাকবাহিনীর আত্মসমপর্ণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিল। জেনারেল জে. এফ. আর. জ্যাকব তাঁর বহুল-পঠিত ‘১৯৭১ এর যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থে’ লিখেছেন, মিত্রবাহিনী জেলা ও মহকুমা শহর অর্থাৎ বিল্্ড-আপ এলাকা বাদ দিয়ে বিভাগীয় শহরগুলোতে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের জন্য সমবেত হচ্ছিল এবং দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের এই রণনীতি তাঁরা বাংলাদেশেও অনুসরণ করেন। জেনারেল জ্যাকব সঠিক বলেছেন, মিত্রবাহিনী দেশের থানা, মহকুমা ও জেলাগুলো এড়িয়ে বিভাগীয় সদরগুলোতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের জন্য সমবেত হচ্ছিল, সেখানে তাদের সঙ্গে আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং সেক্টর ফোর্স ও মুক্তিবাহিনী মিত্রবাহিনীর অংশ হিসেবে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সঙ্গে Vanguard (অগ্রগামী দল) হিসেবে বিভাগীয় সদরগুলোতে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্বে অংশগ্রহণ করে। যেমন- চট্টগ্রাম বিভাগে ভারতের ২২ মাউন্টেন ডিভিশনের জিওসি জেনারেল আর. ডি. হীরার নেতৃত্বে ১০ম ও ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্ট চট্টগ্রাম বিভাগে Vanguard (অগ্রগামী দল) হিসেবে অংশগ্রহণ করে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় আত্মসমর্পণের পর দিন ১৭ ডিসেম্বর চট্টগ্রামে পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে তারা যৌথভাবে সমবেত হন। তেমনি অন্যান্য বিভাগীয় সদরেও অনুরূপভাবে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানের বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও মুক্তিবাহিনী যৌথভাবে সমবেত হয়।

উল্লেখ্য, জেনারেল জ্যাকব সঠিক বলেছেন, এ ছাড়াও বাংলাদেশের থানা, মহকুমা ও জেলাগুলো অর্থাৎ সমগ্র দেশে  ইতোমধ্যে মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ দখল প্রতিষ্ঠিত হয়। জেনারেল জে. এফ. আর. জ্যাকব যখন ১৫ ডিসেম্বর ঢাকার উপকণ্ঠে প্রবেশ করেন বা পৌঁছান ঢাকার উপকণ্ঠের সম্পূর্ণ এলাকা তখন মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তা ভেবে তাঁর ওপরও গুলি চালানো শুরু করে। তিনি হাত তুলে ‘মিত্রবাহিনী’ বলে চিৎকার করে ওঠায় তারা তাঁকে অভিনন্দন জানায়।

৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর এই ১৩ দিন ছিল আমাদের একটানা নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে শামিল এবং অংশবিশেষ এবং দীর্ঘ নয় মাসের যুদ্ধের শেষ পর্ব। তাই এই ১৩ দিনকে নয় মাসের যুদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। এমনকি এই ১৩ দিনের আগেই পাকবাহিনী সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং তারা আত্মসমর্পণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

একই প্রসঙ্গে ১৯৭১-এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ গবেষক ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন এস. কে. গার্গ তাঁর যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থ’ Spotlight : Freedom Fighters of Bangladesh-এ লিখেছেন : ‘১৯৭১-এর জুন-জুলাই নাগাদ পাকিস্তানি সেনাকর্মকর্তারা দেহরক্ষী সেনাদল ছাড়া শহরের আশেপাশে যেতে পারতেন না। প্রত্যেক অফিসারের সঙ্গে কমপক্ষে তিন থেকে চারজন সৈন্য তার গাড়িতে থাকতে হতো আর সন্ধ্যার পর বাইরে বের হওয়া ছিল অসম্ভব’ (পৃষ্ঠা-৩১৮)

এখানে প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, ২৫ মার্চ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই মুক্তিবাহিনী ভারতীয় সহযোগিতায় যখন রণাঙ্গনে যুদ্ধরত, সেই সময় এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাপ্রধান ম্যানেকশ’কে কেবিনেট মিটিংয়ে ডাকেন। এ প্রসঙ্গে ১৯৭১ এর বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিখ্যাত গ্রন্থ ‘Blood Telegram’ গ্রন্থে উল্লেখ রয়েছে। গ্যারি জে. বাস লিখিত ‘দি ব্লাড টেলিগ্রাম’ বইতে উল্লেখ করা হয়, ‘১৯৭১ সালের এপ্রিলে তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম-এর উপস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাপ্রধান জেনারেল স্যাম ম্যানেকশ’কে ডেকে নেন। প্রধানমন্ত্রী তাকে প্রশ্ন করেন ‘আপনি কি কিছু করতে পারেন না?’ ম্যানেকশ উত্তর দেন, ‘আপনি আমাকে কী করতে বলেন?’ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে ঢুকতে।’ জেনারেল জবাব দেন, ‘এর মানে তো যুদ্ধ।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সেটা আমি জানি। যুদ্ধ করতে আমাদের আপত্তি নেই।’ কিন্তু এই পর্যায়ে জেনারেল ম্যানেকশ আপত্তি করেন। তিনি শীত আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন। কারণ শীতের সময় হিমালয়ের বরফ ঢাকা গিরিপথে চীনা সৈন্যরা আটকা পড়বে। জেনারেল বলেন, ‘এর পরও যদি আপনি আমাকে এগিয়ে যেতে বলেন, যাব... ‘তবে আমি আমাদের পরাজয়ের ১০০% নিশ্চয়তা দিচ্ছি। এ যুদ্ধে আমরা হারবো। জগজীবন রাম তারপরও তাকে চাপ দিতে থাকলে তিনি প্রত্যাখ্যান করেন এবং প্রয়োজনে পদত্যাগ করবেন বলে ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন। জেনারেল স্যাম ম্যানেকশ’র এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত হয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এপ্রিলের ছয় মাস পর ৩ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সেনাপতি ম্যানেকশ’কে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় দিয়েছিলেন বটে, কিন্তু আমাদের বিশাল মুক্তিবাহিনীর মরণপণ মুক্তিযুদ্ধ ২৫ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণা পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। একদিনের জন্যও এই যুদ্ধ থামেনি। আমাদের যুদ্ধ ছিল ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত একটানা নয় মাসের। তাই ৩ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই ১৩ দিনকে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বলা সঠিক নয়। এটি একটি উদ্দেশ্যপ্রণোদিত চক্রান্ত বটে।

ভারত সরকার ও ভারতীয় সেনাবাহিনীর সর্বাত্মক সহযোগিতায় আমাদের অসীম সাহসী বিশাল মুক্তিবাহিনী জনগণের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও স্বতঃস্ফূর্ত সহযোগিতায় ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ ঘোষণার আগেই সাড়ে আট মাস সফলভাবে যুদ্ধ পরিচালনা করে পাকিস্তানি বাহিনীকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে পরাস্ত ও তাদের মনোবল সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত করে দেয়। এ পর্যায়ে পাকবাহিনীর সৈন্য সংখ্যা, গোলাবারুদ ও রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ায় তারা আক্রমণাত্মক থেকে আত্মরক্ষামূলক ভূমিকায় নেমে আসে এবং নিজ নিজ অবস্থানে সীমাবদ্ধ থেকে সম্মানজনক আত্মসমর্পণের পথ খুঁজতে থাকে।

পাকিস্তানি জেনারেল শওকত রাজা তার ১৯৭১ এর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ওপর লেখা “The Lightining Champaign” বইতে লেখেন যে, নভেম্বর ’৭১ নাগাদ পাকবাহিনীর সামরিক শক্তি ও মনোবল সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে :

“নভেম্বর (১৯৭১) নাগাদ পাক-বাহিনীর যুদ্ধ বিপর্যয়ের শেষ পর্যায়ে নেমে আসে: মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২৩৭ জন অফিসার ও ৩৬৯৫ জনেরও বেশি সৈনিক নিহত বা জখম হয়। পাকবাহিনী প্রায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাদের একদিকে আগাবার সময় যেমন শত্রুর (মুক্তিবাহিনীর) হামলার মোকাবেলা করতে হতো; অন্যদিকে গেলে তাদের ঘিরে ফেলা হতো। পাকিস্তানি সৈন্যদের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সময় ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়তে হতো এবং এর ওপর ছিল গোলাগুলি মোকাবেলা করা। আমাদের বেশির ভাগ সৈন্যই নয় মাস ধরে যুদ্ধ করেছে। তারা দিনে ও রাতে শুধু আসা যাওয়ার ওপরই থেকেছে। মুক্তিবাহিনীর দ্বারা পুঁতে রাখা মাইনের সামনে তারা ছিল অরক্ষিত এবং সারাক্ষণ থাকত গুপ্ত হামলার ভয়ে তটস্থ। ১৯৭১-এর নভেম্বর নাগাদ পুরো সময়ই তাদের কেটেছে জলাবদ্ধ ব্যাংকারে, তাদের পায়ে পচন ধরে কাদা পাঁকে, কেঁচো ও বিচ্ছুর আক্রমণে তাদের ত্বকে ঘা হয়ে যায় আর তাদের মন অবর্ণনীয় এক যুদ্ধের তাণ্ডবে ও আতঙ্কে বদ্ধ হয়ে পড়ে।”

পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযোগ অফিসার মেজর সিদ্দিক সালেক তাঁর যুদ্ধ স্মৃতিগ্রন্থ’ ‘Witness to Surrender’ এ লেখেন, “১৯৭১-এর অক্টোবর নাগাদ মুক্তিবাহিনী এতটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠে যে, এমনকি শক্তিশালী পাঠান ও পাঞ্জাবিরাও তাদের ভয় করতে শুরু করে।  ঢাকা এবং এর শহরতলি থেকে আরও ভিতরে যেতে এটা যে কেউই অনুভব না করে পারতো না যে, তারা একটি শত্রু কবলিত এলাকায় এসে পড়েছে। দেহরক্ষী সেনাদল ছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলে যাওয়ার কথা ভাবাই যেত না এবং সেটা বিদ্রোহীদের আরও ক্ষেপিয়ে তুলত। মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানি সেনাদলের ওপর ‘অ্যামবুশ’ বা অতর্কিত হামলা চালাত কিংবা তাদের আসা-যাওয়ার পথে ‘মাইন’ পুঁতে রাখত। যদি কেউ অক্ষত অবস্থায় গন্তব্যে পৌঁছতে সক্ষম হতোও, তারা সেই নিরাপদ যাত্রাকে একটা ইতিবাচক সাফল্য বলে ভাবত।  এই একই বাঙালিরা যারা যুদ্ধের শুরুতে পাকিস্তানিদের ভয় পেতো, তারা এতটাই শক্তি এবং ক্ষমতা অর্জন করে যে, তারা তাদের শত্রু বাহিনীর গমনাগমনকে সীমাবদ্ধ করে দেয় এবং তাদের সম্পর্কে শত্রু বাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে তোলে।” (পৃষ্ঠা/ ১৯৫)

 

লেখকের সাম্প্রতিক বই LIBERATION WAR ’৭১-এর সারসংক্ষেপের একাংশ।

লেখক : মুক্তিযুদ্ধের সাব-সেক্টর কমান্ডার ও দশম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রতিষ্ঠাতা-অধিনায়ক

সর্বশেষ খবর