রবিবার, ২ এপ্রিল, ২০২৩ ০০:০০ টা

সিয়াম সাধনার তাৎপর্য

ড. মোহাম্মদ আবদুল মজিদ

সিয়াম সাধনার তাৎপর্য

আত্মশুদ্ধি আর খোদার নৈকট্য অর্জনের অসীম রহমত ও কল্যাণের সওগাত নিয়ে সিয়াম সাধনার মাস মাহে রমজান আমাদের মাঝে সমুপস্থিত। আল কোরআনে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মাহে রমজানে রোজা পালন বা সিয়াম সাধনাকে পরহেজগারী অর্জনের জন্য ফরজ বা অবশ্য পালনীয় বলে বিধান দিয়েছেন। বলা হয়েছে, পূর্ববর্তী সম্প্রদায়ের জন্যও একই বিধান ছিল। অর্থাৎ রোজা পালন শুধু কোরআনের বিধান ঘোষিত হওয়ার পর থেকে প্রবর্তিত হয়নি। আত্মশুদ্ধি ও বিধাতার নৈকট্য লাভের জন্য কৃচ্ছ্রতা সাধন ইবাদত হিসেবে শুধু ইসলামে পরিপালনীয় নয়, স্থান কাল পাত্র ভেদে সব সম্প্রদায়ের মধ্যে আত্মিক নির্বান লাভের এ সাধনা বিদ্যমান। ইসলামের পাঁচ প্রধান পালনীয় বিধানের মধ্যে মাহে রমজানে রোজা পালন অন্যতম। কেননা মাহে রমজানেই হুদাল্লিনাছি (মানুষের জন্য হেদায়েত) বায়্যিনাতিম-মিনাল হুদা (সৎপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথনির্দেশ) এবং  ফুরক্কান (ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য নির্দেশকারী) হিসেবে আল কোরআন অবতীর্ণ হয়। মহিমানি¡ত মাহে রমজানের মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে আল কোরআনে। বলা হয়েছে, রমজান মাস এমন একটি মাস, এই মাসেই কোরআন মাজিদ নাজিল করা হয়েছে। (২ সুরা বাকারা আয়াত ১৮৫)। এই আয়াতের পরবর্তী বাক্যে উল্লেখ করা হয়েছে, কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে যেন অবশ্যই এ মাসের রোজা পালন করে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে সর্বশ্রেষ্ঠ আসমানি কিতাব আল-কোরআন অবতীর্ণ হওয়ার গৌরবে দীপ্ত ও তাৎপর্যমন্ডিত মাহে রমজান। এ মাসে রোজা পালন আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের তরফ থেকে এক বিশেষ নির্দেশ। কেননা, এ রোজা পালনের মধ্যে রয়েছে অধিকতর কল্যাণ (২ সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৪)।

শুধু আল-কোরআন নয়, মাহে রমজানে অন্যান্য আসমানি কিতাবও অবতীর্ণ হয়েছিল। হজরত ওয়াসেলাহ ইবনে আসকা (রা.) বর্ণিত হাদিসে উল্লিখিত আছে, রসুলে করিম (সা.) বলেছেন, হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সহিফামস রমজান মাসের প্রথম রাতে নাজিল হয়েছে। তাওরাত হজরত মুসা (আ.)-এর প্রতি রমজান মাসের ৬ তারিখে দিবাগত রাতে, হজরত ঈসা (আ.)-এর প্রতি ইঞ্জিল কিতাব এই মাসের ১৩ তারিখে এবং মহানবী (সা.)-এর প্রতি কোরআন শরিফ রমজান মাসের ২৪ তারিখে নাজিল করা হয়েছে। (মসনদে আহমদ)। হজরত জাবের (রা.) বর্ণিত অপর এক হাদিসে উল্লিখিত হয়েছে, জবর রমজান মাসের ১২ তারিখে নাজিল হয়েছে।

আল কোরআনে মানবের সার্বিক কল্যাণের যাবতীয় পন্থা ও পথনির্দেশ রয়েছে। সে কারণেই সুরা বাকারার ১৮৫ সংখ্যক আয়াতে এ কথা জোর দিয়ে বলা হয়েছে, কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা পালন করবে। তবে মাহে রমজানে রোজা পালনের আবশ্যিক এ বিধান এ মাসে অসুস্থতার মুসাফিরদের জন্য শিথিল করে দিয়ে বলা হয়েছে, অন্য সময়ে সে রোজা পূরণ করে নিতে হবে। আর এটিও যাদের জন্য অত্যন্ত কষ্টদায়ক হবে, তারা এর পরিবর্তে একজন মিসকিনকে খাদ্য দান করবে। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন সিয়াম সাধনার এ সুযোগকে তার প্রিয় বান্দাদের জন্য সহজ করতে চান, তিনি কোনো জটিলতা কামনা করেন না। আর এ মহাসুযোগ এনায়েত করার জন্য কোরআনই শিখিয়ে দিয়েছে তোমাদের হেদায়েত দান করার জন্য আল্লাহতায়ালার মহত্ত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। সিয়াম সাধনা বস্তুত কৃচ্ছ্রতা সাধনের এমন এক পর্যায় যা আত্মশুদ্ধির সুযোগকে করে অবারিত এবং আনে সৃষ্টিকর্তার অসীম রহমতের প্রাপ্তিতে গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশের সুযোগ লাভে অনাবিল আনন্দ। আত্মিক, শারীরিক, মানসিক ও সর্বোপরি সামাজিক কল্যাণ নিশ্চিতকারী এমন কল্যাণপ্রদ পরিপালনীয় বিষয় আর নেই। সাহরি ও ইফতার রোজার দুই গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়। মহানবী (সা.) সাহরি খাওয়াকে মুস্তাহাব বা খুবই পছন্দনীয় কাজ বলে অভিহিত করেছেন। বস্তুত রোজা রাখার জন্য শেষরাতে কিছু পানাহার করা চাই। নবী করিম (সা.) বলেছেন, তোমরা সাহরি খাও। সাহরি খাওয়ায় নিশ্চয়ই বরকত রয়েছে। তিনি বলেছেন, যে লোক রোজা রাখতে চায়, তার কিছু খেয়ে সাহরি পালন করা কর্তব্য। তিনি আরও বলেছেন, মুসলমানদের ও অন্য ধর্মাবলম্বীদের রোজা রাখার একটি পার্থক্য হলো সাহরি খাওয়া। অর্থাৎ মুসলমানগণ সাহরি খেয়ে রোজা রাখে আর অমুসলমানরা সাহরি না খেয়ে রোজা থাকে। হজরত আবুজর গিফারী (রা.) থেকে বর্ণিত হয়েছে, রসুলে করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন আমার উম্মত যতদিন ইফতার ত্বরান্বিত করবে এবং সাহরি বিলম্বিত করবে ততদিন তারা কল্যাণকর হয়ে থাকবে। সূর্যাস্তের মুহূর্তে ইফতার করার সময়। এ মুহূর্ত উপস্থিত হওয়া মাত্রই রোজা খুলে ফেলা কর্তব্য। ইফতার করতে অকারণ বিলম্ব হওয়া উচিত নয়।

যদি কেউ এ বিলম্বকে অধিক সওয়াব পাওয়ার উপায় কিংবা অধিক তাকওয়া দেখানোর শামিল মনে করেন তা আদৌ সঠিক নয়। ইফতার ত্বরান্বিত করা কেবল রসুল (সা.)-এর পছন্দ নয় আল্লাহর কাছেও তা অধিকতর প্রিয়। হাদিসে কুদসিরূপে উল্লিখিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালা বলেছেন, আমার কাছে ওই ব্যক্তি সর্বাধিক প্রিয় যে শিগগিরই ইফতার করে। সিয়াম সাধনার ফলে রোজাদারের জীবনযাপন প্রণালি শৃংখলা মন্ডিত হয়ে ওঠে। যথামুহূর্তে ইফতার করা এবং শেষ রাতে সাহরি খাওয়া সেই শৃংখলা বিধান ও নিয়মতান্ত্রিকতারই অংশ। ইফতার করার আগে ইফতার সামগ্রী সামনে নিয়ে সময়ের অপেক্ষা করার মধ্যে ধৈর্যশীলতা ও নিয়মনিষ্ঠার পরিচয় নিহিত।  সাহরি ও ইফতার উভয়ই বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে স্বাস্থ্যসম্মত ও বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।

লেখক : সাবেক সচিব ও এনবিআর চেয়ারম্যান

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর