বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০২৩ ০০:০০ টা

ব্যারিস্টার তাপসের ভাষ্য, ব্যারিস্টার আমীরের কর্মকাণ্ড

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

ব্যারিস্টার তাপসের ভাষ্য, ব্যারিস্টার আমীরের কর্মকাণ্ড

ওপরে উল্লিখিত বিষয় নিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে চলছে প্রচুর আলোচনা-সমালোচনা, লেখালেখি এবং সামাজিক মাধ্যমে প্রচণ্ড ঝড়। এ ঝড়ের ঢেউ পশ্চিম বাংলার গণমাধ্যমেও পৌঁছেছে। সর্বশেষ খবর অনুযায়ী, ব্যারিস্টার তাপসের বিরুদ্ধে একটি আদালত অবমাননার দরখাস্ত করা হয়েছে। তাই ভাবলাম এ বিষয়ে আমার লেখা উচিত, কেননা ওপরের দুজন ব্যারিস্টারের সঙ্গেই আমার বহু বছরের গভীর নৈকট্যের কারণে আমি যতটা নির্মোহ এবং নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে লেখতে পারি, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। প্রথমেই অভিভাবকতুল্য ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের কথা দিয়ে শুরু করতে হয়, যিনি আমাদের ইতিহাসের অংশ। শুধু মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে সে যুদ্ধের পটভূমিতে তাঁর অবদানের জন্যই নয়, মুজিবনগরের প্রথম সরকার গঠনে তাঁর ভূমিকার জন্যই নয়, ১৯৭১-এর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের লেখক হিসেবে তাঁর চিরঞ্জীব থাকার কথা, যে দলিলটি আমাদের সংবিধানে সংযোজন করা হয়েছে। তাই তাঁকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীদের জন্য নমস্ব ব্যক্তি বলা মোটেও অতিরঞ্জন নয়। ১৯৭১-এ তিনি পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের পোষ্য রাজাকার-আলবদর-শান্তি কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সংগঠক হিসেবে অমূল্য অবদান রেখেছেন, কাজ করেছেন জামায়াত, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামসহ অন্যান্য ধর্মান্ধ, ধর্ম ব্যবসায়ীদের এবং কট্টর চীনপন্থিদের বিরুদ্ধে। কিন্তু আমরা এটা দেখে গভীরভাবে বিক্ষুব্ধ হলাম যে, সম্প্রতি তিনি সেই ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির লোকদের সঙ্গেই হাত মিলিয়ে সুপ্রিম কোর্ট বারের রাজনীতির জন্য একটি তথাকথিত মোর্চা তৈরি করেছেন এমন এক ব্যক্তির নেতৃত্বে যিনি দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার কিছুদিন আগে পাকিস্তান চলে গিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর ফিরে এসেছিলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বিএনপি-জামায়াত নেতাদের পক্ষে আইনি লড়াই করবেন এমন কথা বলেই ক্ষান্ত হননি, তাদের সঙ্গে নিয়ে আদালতেও দাঁড়িয়ে ছিলেন। সোজা কথায় তাদের সঙ্গেই হাত মেলালেন, যাদের বিরুদ্ধে ’৭১-এ তিনি যুদ্ধ করেছিলেন। আমরা কখনো চিন্তাও করিনি যে, এ ধরনের চিত্র দেখা যাবে। আমরা বিস্ময়ে হতভম্ভ হয়েছি। এটা কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। কেউ যদি বলেন এর দ্বারা তাঁর সমস্ত জীবনের অর্জন ভূলুণ্ঠিত হলো, তিনি ভুল বলবেন না। যে ব্যক্তি সবসময় পূজনীয় হয়ে থাকতেন, এসব কর্মকাণ্ডের কারণে তাঁর সে পরিচয়ে চির ধরার উপক্রম হয়েছে।

তাঁর মনে ব্যথা রয়েছে, যা অনস্বীকার্য। বিগত বার কাউন্সিল নির্বাচনে তিনি সর্বাধিক ভোট পাননি বলে তাঁকে সহসভাপতি পদটি দেওয়া হয়নি। বলতে দ্বিধা নেই যে, সেটি ছিল ভুল সিদ্ধান্ত। তাঁর গৌরবময় ইতিহাস এবং বয়োজ্যেষ্ঠতার কারণে পদটি তাঁকেই দেওয়া উচিত ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে দেশের ঐতিহ্যবাহী এবং সর্বপ্রাচীন গবেষণা সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লিগ্যাল অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (বিলিয়া) চেয়ারম্যান পদে বসানো হয়েছে ড. কামাল হোসেনের ক্ষমতা খর্ব করে। সংস্থাটি সরকারি অর্থায়নে পরিচালিত বিধায় এটি বলার অপেক্ষা রাখে না যে, সরকার চেয়েছে বলেই তিনি ওই সম্মানজনক পদটি পেয়েছেন। এ পদটি কোনোক্রমেই বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যানের পদ থেকে নিম্নমানের নয়। তাই এরপর আর তাঁর ক্ষোভ জিইয়ে রাখা উচিত হয়নি। বিলিয়ার চেয়ারম্যান (আমি নিজেও যার বিকল্প চেয়ারম্যান) হিসেবে তিনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উজ্জীবিত রাখার জন্য অনেক কিছু করেছেন, যা মনে রাখার মতো। তাঁর সমর্থন নিয়ে আমরা বিলিয়ায় ধর্মান্ধদের প্রবেশ বন্ধ করেছি। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করার ব্যাপারে তিনি সব সময়ই সোচ্চার ছিলেন। এসবের পর হঠাৎ সুপ্রিম কোর্ট বার সমিতির নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে তাঁর হাত মেলানো যেন বিনা মেঘে বজ্রপাতসম, যে বজ্রাঘাতে অনেক কিছু পুড়ে ছারখার হওয়ার অবস্থা। জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট মশিউজ্জামান, যিনি সুপ্রিম কোর্ট বারের নির্বাচন কমিশনার ছিলেন, তাঁর শ্বশুর যে-ই হন না কেন তিনি নিজে একজন ভালো মানুষ। কিন্তু কমিশনে যারা ভোট গণনায় নিয়োজিত ছিলেন তাদের প্রায় সবাই জামায়াতের লোক এবং ভোট গণনার রাতেই গণনায় নয়-ছয়ের অভিযোগ আনা হয়েছিল। সভাপতির পদে সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মমতাজ ফকিরের বিষয়ে নয়-ছয়ের সুযোগ ছিল না, কারণ তিনি বিপুলসংখ্যক ভোটে এগিয়ে ছিলেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদে আবদুর নুর দুলাল তুলনামূলকভাবে অল্প ভোটে এগিয়ে থাকার কারণে জামায়াতপন্থি গণনাকারীরা প্রতারণার আশ্রয় নেন অনেকের দৃষ্টিসীমার মধ্যেই। চ্যালেঞ্জ হলে, যথাযথই পুনর্গণনার দাবি ওঠে। পুনর্গণনার আগেই কমিশনের চেয়ারম্যান পদত্যাগ করেন, যে কারণে সময়মতো গণনা হয়নি। তবে পরবর্তীতে নতুন চেয়ারম্যানের তদন্তাধীনে পুনর্গণনায় দেখা গেল- অ্যাডভোকেট আবদুর নুর দুলালই জয়ী হয়েছেন, যে কথাটি প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে নির্বাচন কমিশনের জামায়াতি ভোট গণনাকারীরা চেপে রেখেছিলেন। যথাসময়ে নতুন কমিটির নাম ঘোষণা করার পর মাননীয় প্রধান বিচারপতিসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সেটিকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, কিন্তু সেই প্রেক্ষাপটেই ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম একজন চিহ্নিত দেশত্যাগী রাজাকারের নেতৃত্বে একটি মনগড়া কমিটি করে বিতর্কের সৃষ্টি করলেন, যা তাঁর জন্যও মঙ্গলকর হয়নি বলে তাঁর সব ভক্তরাই বলছেন। জামায়াত-বিএনপি-রাজাকারদের সঙ্গে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে দেখার জন্য আমরা কখনো প্রস্তুত ছিলাম না বিধায়, শুধু বিস্মিতই হইনি, মর্মাহতও হয়েছি।

এমন পরিস্থিতিতে ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস কিছু বক্তব্য দিয়েছেন। নাম উল্লেখ না করে তিনি সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার পতনের কথা উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা প্রকাশ্য আদালতে স্বীকার করেছেন যে, তিনি শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন এবং পাকিস্তানি সৈন্যদের সাহায্য করতেন, যে কথা পরদিনই বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় গুরুত্বসহকারে প্রকাশিত হয়েছিল, বিশেষ করে আদালতে উপস্থিত সাংবাদিক জুলফিকার মানিক বিষয়টি নিয়ে ঢাকা ট্রিবিউন পত্রিকায় শীর্ষ খবর হিসেবে প্রকাশ করেছিলেন। এ কথা জানার পরই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জনতা বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে ক্ষেপে ওঠেন। পরবর্তীতে প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর তিনি প্রকাশ্যেই বলতে থাকেন যে, পাকিস্তান সুপ্রিম কোর্ট স্টাইলে তিনি নির্বাচিত আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সরকারকে হটিয়ে দেবেন। তিনি সে পথে এগোচ্ছিলেনও। কিন্তু এরই মধ্যে তাঁর বিরুদ্ধে গণদাবির কারণে একটি গোয়েন্দা সংস্থা দুর্নীতির বস্তাবন্দি প্রামাণ্য দলিল বের করতে সক্ষম হলে আপিল বিভাগের অন্য পাঁচজন মাননীয় বিচারপতি তাঁর সঙ্গে আদালতে না বসার সিদ্ধান্ত নিলে পদত্যাগ করা ছাড়া কোনো পথ না থাকায় তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছিলেন। একই সঙ্গে দেশত্যাগ করেছিলেন এই ভয়ে যে, তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা হলে তাঁকে কারাগারে পাঠানো হবে। এ বিষয়ে ব্যারিস্টার তাপস যা বলেছেন তাতে ভাষাগত কিছুটা ত্রুটি থাকলেও তত্ত্বগত কোনো ভুল ছিল না, কেননা গণদাবির মুখেই তাঁর দুর্নীতির খোঁজে নেমে পড়েছিল গোয়েন্দা সংস্থাটি। উল্লেখ্য, ১/১১-এর সময় বিএনপি মনোনীত রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনও বিচারপতি সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতির নথিপত্রের পাহাড় দেখিয়ে তাঁকে পদত্যাগ করতে বললে, তিনি সেই যাত্রা, সে সময়ের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা ড. কামাল হোসেনের কৃপা পেয়ে বেঁচে গিয়েছিলেন।

ব্যারিস্টার তাপস সব সুশীলকে কটাক্ষ করেননি, শুধু তাদের দিকেই অঙ্গুলি তাক করেছিলেন রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিই যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য। যারা ব্যারিস্টার তাপসকে বেয়াদব, অহংকারী বলছেন, তারা জানেন না যে তিনি কত অমায়িক এবং বিনয়ী। গত সপ্তাহে সর্বজন শ্রদ্ধেয় ইতিহাসবিদ এবং গবেষক, গণহত্যা জাদুঘরের প্রধান, অধ্যাপক ড. মুনতাসীর মামুন, যিনি ব্যারিস্টার তাপসের সঙ্গে হেরিটেজ নিয়ে কাজ করছেন। বললেন, ‘ক্ষমতায় উপবিষ্ট খুব কম মানুষই তাপসের মতো বিনয়ী।’ অধ্যাপক মামুনের সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। আমি হাই কোর্ট বিভাগে বিচারপতি থাকাকালে তিনি প্রায়ই আমার নেতৃত্বের বেঞ্চে আসতেন। তিনি তৈরি না হয়ে কখনো আদালতে আসতেন না। তাঁর বয়সী খুব কম আইনজ্ঞের মধ্যেই তাঁর মতো আইনি পারদর্শিতা দেখেছি। তাঁর সবচেয়ে বড় গুণ ছিল তিনি মামলা জয়ের জন্য কখনো আদালতকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করতেন না। একটি ঘটনার উল্লেখ করছি। জাহাজ ভাঙার সময় মালিকদের গাফিলতির কারণে বেশ কয়েকজন শ্রমিক নিহত হলে আমি স্বপ্রণোদিত রুল জারি করলে আসামিদের পক্ষে ব্যারিস্টার তাপস হাজির হয়ে প্রথমেই স্বীকার করেন আসামিরা যা করেছে তা অমার্জনীয়, আমি যে সাজা দেব তা-ই মাথা পেতে নেওয়া হবে। এমনি অনেক দৃষ্টান্ত রয়েছে। এত সুন্দর সাবমিশন খুব কম আইনজ্ঞই করতেন। বছর দুয়েক আগে (আমার অবসরের বহু পরে) শুনলাম দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের কিছু লোক হাই কোর্টের নিষেধাজ্ঞা এবং পশু রক্ষা আইন অমান্য করে পথকুকুরদের হত্যা করছে। এ বিষয়ে আমি ব্যারিস্টার তাপসকে ফোন করলে তিনি অতি বিনয়ের সঙ্গে বলেছিলেন, ‘স্যার আমি মহামান্য হাই কোর্টের নির্দেশ অমান্য করেছি, আপনি কি তা বিশ্বাস করতে পারেন?’ তিনি শুধু ক্ষমতার উচ্চাসনেই উপবিষ্ট নন, তিনি জাতির জনকের পরিবারের অংশও। কিন্তু সে জন্য তাঁর শরীরে কখনো উত্তাপ দেখা যায়নি, দেখা গেছে অভূতপূর্ব বিনয়, যে কথা অধ্যাপক মামুন বলেছেন। এটি তাঁর পারিবারিক ঐতিহ্যের কারণেই। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ঘরানার কয়েকজন, যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত কাজ করছি, তারাও ব্যারিস্টার তাপস সম্পর্কে কিছু কটু কথা বলেছেন তাঁকে না জেনেই। তাঁকে গভীরভাবে জানার সুযোগ হলে এ ভুলটি নিশ্চয়ই করতেন না। অন্যদিকে জীবন সায়াহ্নে এসে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাহেব কেন ’৭১-এর পরাজিত অপশক্তির লোকদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে আমাদের হতভম্ভ করলেন, যার কারণে তাঁর সারা জীবনের গৌরবময় অর্জন আজ ভূলুণ্ঠিত হওয়ার পথে, সে প্রশ্নের জবাব খুঁজে বেড়াচ্ছি। সাজাপ্রাপ্ত সাবেক প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে কথা বলা কীভাবে আদালত অবমাননা হয় তাও বুঝতে পারছি না।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

সর্বশেষ খবর