ইসলামে গৃহপরিচারক, পরিচারিকা এবং অধীন লোকজনের ওপর সদয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
অধীন এসব মানুষের সঙ্গে নির্মম আচরণ করা ইসলামের দৃষ্টিতে কবিরা গুনাহ। মহান আল্লাহ আদেশ দিয়েছেন, ‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর, তাঁর সঙ্গে আর কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত কর না, পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় ব্যবহার কর, আত্মীয়স্বজন, এতিম, দরিদ্র, নিকট প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী, ভ্রমণের সহজাত্রী, অসহায় মুসাফির এবং নিজের দাস-দাসীর সঙ্গে সদয় আচরণ কর। নিশ্চয় আল্লাহ দাম্ভিক গর্বিত ব্যক্তিকে পছন্দ করেন না।’ সুরা নিসা-৩৬। উপরোক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় ইমাম ওয়াহেদী (র.) বলেন : ‘তোমরা আল্লাহর উপাসনা কর তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক কর না’ এ ব্যাপারে হজরত ইবনে মাসউদ (রা.) বলেন : একবার এক বেদুইন এসে নবী করিম (সা.)-এর কাছে আরজ করল- হে আল্লাহর নবী! আমাকে কিছু উপদেশ দিন। রসুল (সা.) বললেন : “আল্লাহর সঙ্গে আর কাউকে অংশী সাব্যস্ত কর না, যদি তোমাকে কেটেও ফেলা হয় কিংবা আগুনে পোড়ানো হয় তথাপি আল্লাহর ন্যস্ত করা ফরজ নামাজ ত্যাগ কর না, মদ পান কর না, কেননা তা হচ্ছে সকল মন্দের চাবিকাঠি।”
‘পিতা-মাতার সঙ্গে সৎ ও সদয় আচরণ কর’ অর্থ- তাদের সঙ্গে বিনয়াবনত হও, তাঁরা কিছু জানতে চাইলে কঠোর ভাষায় উত্তর দিও না, তাঁদের প্রতি অগ্নি দৃষ্টি নিক্ষেপ কর না, বরং তাঁদের সঙ্গে এমন আচরণ কর, যেমন কর্মচারীগণ মালিকের সঙ্গে করে। ‘আত্মীয়দের সঙ্গে’ অর্থ- তাঁদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রক্ষা করে চল। ‘ইয়াতিমের সঙ্গে’ অর্থ- ইয়াতিমের সঙ্গে স্নেহপূর্ণ ব্যবহার কর, তাদের গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দাও। মিসকিনদের সঙ্গে’ অর্থ- ‘তাদেরকে দান দক্ষিণা দ্বারা সাহায্য সহযোগিতা কর। নিকট প্রতিবেশীর সঙ্গে’ অর্থ- যার সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে, এমন প্রতিবেশীর তোমার ওপর তিনটি অধিকার রয়েছে : আত্মীয়তার, প্রতিবেশীর এবং ইসলামের। ‘দূরের প্রতিবেশীর সঙ্গে’ অর্থ- আত্মীয় নয় কিন্তু প্রতিবেশী। তার সঙ্গে সদয়াচরণ কর, তোমার ওপর তারও অধিকার রয়েছে। হজরত আয়েশা (রা.) কর্তৃক আবু দাউদ ও ইবনে মাজায় বর্ণিত, রসুল (সা.) বলেন : “প্রতিবেশীর ব্যাপারে ওহির মাধ্যমে আমাকে এত বেশি তাকিদ দেওয়া হচ্ছিল যে, আমার মনে হচ্ছিল, হয় তো প্রতিবেশীকে আমার উত্তরাধিকারী বানিয়ে দেওয়া হবে।” ‘ভ্রমণের সহজাত্রীর’ ব্যাপারে হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন : সে তোমার সফর কালীন বন্ধু, তাই তার দুটি অধিকার রয়েছে : প্রতিবেশীর এবং সাহচর্যের। ‘অসহায় মুসাফির’ অর্থ- দুর্বল-যয়িফ কোনো পথিক, সে আপন গন্তব্য পৌঁছা পর্যন্ত তার মেহমানদারি করতে হবে। দাস-দাসী’ অর্থ- কর্মচারীবৃন্দ, তাদেরকে প্রয়োজনীয় ভালো খাদ্য বস্ত্র দিতে হবে। তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখতে হবে। ‘দাম্ভিক ও গর্বিত’ অর্থ- হজরত ইবনে আব্বাস বলেন, দাম্ভিক হচ্ছে- যে নিজেকে বড় মনে করে অথচ আল্লাহর হক আদায় করে না। আর ‘গর্বিত, সেই ব্যক্তি, যে আল্লাহর দেওয়া নেয়ামত লাভ করে আল্লাহর বান্দাদের ওপর গৌরবান্বিত মনে করে। হজরত আবু হোরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) বলেছেন, “তোমাদের পূর্বে এক যুবক জাঁকজমকপূর্ণ পোশাক পরিচ্ছদ পরিধান করে গর্ববোধ করত এবং অহংকার করে ফেরত। সহসা মাটি তাকে গিলে ফেলল। কেয়ামত পর্যন্ত সে মাটির তলে দাবতেই থাকবে।”,
হজরত আলী (রা.) বর্ণনা করেন, রসুল (সা.) ইহলোক ছেড়ে পরলোকে যাত্রার প্রাক্কালে সর্বশেষ অসুস্থাবস্থায়ও নামাজ এবং অধস্তন দাস-দাসীদের সঙ্গে সদয় আচরণের জন্য বিশেষভাবে ওসিয়ত করে বলেছেন, ‘তোমরা নামাজ ও অধীন দাস-দাসীদের বিষয়ে আল্লাহকে ভয় কর।’-আবু দাউদ, ইবনে মাজা।
হাদিসে আছে, ‘অধীনদের সঙ্গে সদয় আচরণ কল্যাণকর অদৃষ্টের উৎপত্তিস্থল, আর তাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার দুর্ভাগ্যের উৎপত্তিস্থল।’ রসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘অধীনদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারকারী জান্নাতে যেতে পারবে না।’- মুসনাদে আহমদ, আবু দাউদ সহিহ মুসলিম উদ্ধৃত এক হাদিসে হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, আমি এক ভৃত্যকে বেত্রাঘাত করছিলাম। এমনি সময়ে পেছন দিক থেকে আওয়াজ শুনতে পেলাম, ‘মনে রেখ, ওহে আবু মাসউদ! মহান আল্লাহপাক এ দাসের ওপর তোমাকে নেতৃত্বদান করেছেন।’ আবু মাসউদ (রা.) বলেন- ‘আমি বললাম, ইয়া রসুলুল্লাহ! আমি আর কখনো চাকর-চাকরানি ও দাস-দাসীকে মারব না।’ আরেক বর্ণনা মতে, হজরত আবু মাসউদ (রা.) বলেন, ‘রসুল (সা.)-এর ব্যক্তিত্বের প্রভাবে আমার হাত থেকে বেতটি পড়ে গেল।’ আরেক বর্ণনা মতে- আমি বললাম, ‘আল্লাহর জন্য সে মুক্ত।’ অতঃপর রসুল (সা.) বললেন, ‘এটা না করলে কেয়ামতের দিন আগুন তোমাকে জ্বালিয়ে ছাই করে ফেলত।’ মুসলিমের আরেক হাদিসে হজরত ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন- রসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আপন দাসকে প্রহার করবে কিংবা তাকে চড় মারবে- এর কাফফারা হচ্ছে তাকে স্বাধীন করে দেওয়া।’ হাকিম ইবনে হোযাম বলেন, রসুল (সা.) বলেছেন- ‘পৃথিবীতে যারা মানুষকে নির্যাতন করে, আল্লাহপাক তাদেরকে কঠোর আজাব দেবেন।’ আরেক হাদিসে আছে, ‘যে কাউকে অন্যায়ভাবে বেত্রাঘাত করবে, কেয়ামতের দিন তার প্রতিশোধ নেওয়া হবে।- বাযযার ও তাবারানী
রসুলুল্লাহ (সা.)-এর সমীপে জানতে চাওয়া হলো, অধীন দাস-দাসীদের কতবার মার্জনা করব? রসুলুল্লাহ (সা.) জওয়াব দিলেন- ‘দৈনিক সত্তর বার।’-আবু দাউদ, তিরমিযি।
লেখক : ইসলামবিষয়ক গবেষক