যে কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও নেতিবাচক অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। আপন দেশের ভিতরে বিশৃঙ্খলা পরদেশে ভুল বার্তা পৌঁছায়। এতে সংশ্লিষ্ট দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌম শক্তির দুর্বলতা প্রকাশ পায়। দূরের বা কাছের আধিপত্যবাদী শক্তি সেই দুর্বলতার সুযোগ নেওয়ার চেষ্টা করতে পারে। বিশ্বের ইতিহাসে তার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। আর বিষয়টি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন হয় না।
ছাত্র গণ অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে কর্তৃত্ববাদী শাসনাবসান-উত্তর চার মাসের ঘটনাপ্রবাহের দিকে তাকালেও এ সত্যটি অনুধাবন করা যায়। আমাদের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের অনেকটাই অবনতি ঘটেছে অতি সাম্প্রতিককালে। আমেরিকার নির্বাচনি প্রচারণার সময় ডোনাল্ড ট্রাম্প যে মনোভাব ব্যক্ত করেছিলেন, তাও হতাশাব্যঞ্জক। তিনি বাংলাদেশে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে মন্তব্য করেছিলেন। অন্যদিকে জুলাই-আগস্ট আন্দোলন চলাকালে ভারত পালন করেছে নীরব দর্শকের ভূমিকা। ভারতীয় মিডিয়া আন্দোলনের খবর প্রকাশ করেছে পক্ষপাতহীনভাবে। শেখ হাসিনাকে ভারতে অনানুষ্ঠানিক আশ্রয় দিলেও দিল্লি বাংলাদেশের প্রশ্নে বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করেনি। কিন্তু এখন বৈরিতা করছে বলেই মনে হয়। এসবের কোনোটিই সম্পর্কসূত্রহীন নয়। ছাত্র গণ আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোতে আমরা ঐক্যবদ্ধ ছিলাম, জনতার ঐক্যের শক্তি হয়ে উঠেছিল বিপুল ও দুর্নিবার। তখন প্রতিবেশী বাংলাদেশ প্রশ্নে একভাবে চিন্তা করেছে, এখন আরেকভাবে চিন্তার সুযোগ পেয়েছে। হয়তো অভ্যন্তরীণ এনার্কিক সিচুয়েশন বাংলাদেশের সার্বভৌম শক্তিকে অবমূল্যায়ন করতে প্রলুব্ধ করেছে তাদের।
আগস্টের ৮ তারিখ ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর আশা করা গিয়েছিল, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। কিন্তু বাস্তবে খুব কম সময়ের জন্যও সেটা হয়নি। জনসমর্থনের প্রাচুর্য, দেশ-বিদেশের অজস্র অভিনন্দন বার্তা নোবেল লরিয়েট অধ্যাপকের সরকারের মনের শক্তি যে বহুগুণে বাড়িয়ে দিয়েছিল, সে বলাই বাহুল্য। কিন্তু মনের শক্তির সমান্তরাল রেখায় কেন যেন এগোতে পারছে না সরকারের কাজের শক্তি। নৈরাজ্য চারদিক থেকে হিংস্র শ্বাপদের মতো এই সরকারকে দংশন করে চলেছে নিরন্তর। হাইস্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, সচিবালয়, পথ-ঘাট, হাটবাজার আদালতপাড়া, সাংবাদিক-এলাকা, উপাসনালয়- কম বেশি বিশৃঙ্খলা সবখানে। স্কুলের কোমলমতি ছেলেমেয়েরা অভিভাবকতুল্য শিক্ষকদের অনেককে মেরেছে, গলায় জুতার মালা পরিয়ে লাঞ্ছিত করেছে। সাদা কাগজে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছে।
আদালতপাড়ায় আসামিদের কিলঘুসি মারা হয়েছে, ডিম মারা হয়েছে। সেই অতিবিপ্লবীদের প্রকাশ্যে নিন্দা করার সাহসও যেন বা তথাকথিত সুশীল সমাজ হারিয়ে ফেলেছে। মানসিক প্রতিবন্ধী ক্ষুধার্ত তফাজ্জলকে হত্যা করা হয়েছে মব জাস্টিসের নামে।
আজ দেশজুড়ে যে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি বিরাজ করছে, তাকে শুধু বিশৃঙ্খলা বলে আখ্যায়িত করা যায় না। এটা সিন্ডিকেটেড এনার্কিজম নয়, তাও বলা যায় না। রাজনীতি বিজ্ঞানের ছাত্রমাত্রই জানেন নৈরাজ্যবাদও একটা রাজনৈতিক তত্ত্ব। স্বার্থান্বেষী কোনো মহল সুনির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য অর্জনের কৌশল হিসেবে নৈরাজ্যকে উসকে দিতে পারে। দেশ ও বিশ্বের ইতিহাসে এমন নৈরাজ্যবাদী প্রচেষ্টার বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবকালে মিখাইল বাকুলিল বলশেভিক হয়েও নৈরাজ্যবাদী লাইন ধরেছিলেন। ২০১৪ সালে ইউক্রেন ও ক্রিমিয়ার নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সুযোগে রাশিয়া ক্রিমিয়া গ্রাস করে নিয়েছে। বলশেভিকরা নৈরাজ্যবাদীদের কঠোর হস্তে দমন করেছিল। কিউবা ও ভিয়েতনামেও নৈরাজ্যবাদের আস্ফালন দেখা গেছে। কিউবায় ফিদেল কাস্ত্রো কঠোর হস্তে নৈরাজ্যবাদীদের দমন করেছিলেন।
নৈরাজ্যবাদীরা একই সঙ্গে নানা দিক থেকে আঘাত হানতে পারে। মেহনতি ও দরিদ্র কৃষক-শ্রমিক, অসন্তুষ্ট ও সুবিধা প্রত্যাশী খেটে খাওয়া মানুষ, নিজেদের বঞ্চিত মনে করা আমলা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং আবেগচালিত তরুণদের নৈরাজ্যবাদীরা ব্যবহার করে থাকে বিবিধ কৌশলে। বাংলাদেশে এখন সেটাই হচ্ছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। সরকারের ভিতরের ও বাইরের তাত্ত্বিকদের মধ্যেও চলমান এনার্কির কার্যকারণ প্রশ্নে মতভিন্নতা রয়েছে। উপদেষ্টা মাহফুজ আলম বলেন, ‘বাম ও ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব ও ব্যক্তি গণ অভ্যুত্থান এবং পরবর্তীতে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত করতে না পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা ও বিপ্লবী জোশ দেশটাকে অস্থির করে রেখেছে।’ অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলন মনে করে, পতিত সৈ¦রাচার ও তার দোসরদের পুনর্বাসনের উদ্দেশ্যে এ নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হচ্ছে।
বর্তমানে সক্রিয় অন্যান্য ছাত্র সংগঠনও অভিন্ন মত পোষণ করে। যদিও তাদের মধ্যে অন্য অনেক বিষয়ে মতভিন্নতা রয়েছে। বিএনপিও অনুরূপ মত পোষণ করে। পক্ষান্তরে সরকারের বাইরের তাত্ত্বিক ফরহাদ মজহার ফেসবুকে এক লেখায় ইসকনের সাবেক নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসের মুক্তি দাবি করেন। তার গ্রেপ্তারের সমালোচনা করেন তীব্র ভাষায়। তিনি লিখেন, ‘আমরা একটি অত্যন্ত দুর্বল, অকার্যকর এবং ভাত দেবার মুরোদ নেই কিল মারার গোঁসাই টাইপের অথর্ব সরকার পেয়েছি।’
আরেক ঘটনা; হঠাৎ করে মধ্যরাতে বাস ও মাইক্রোবাস ভরে দূর-দূরান্ত থেকে শত শত নারী-পুরুষ এসে হাজির শাহবাগে। নানাজনের নানা কথা। কেউ বলেন ১ লাখ থেকে ১০ লাখ টাকার ঋণের প্রলোভন দেখিয়ে গ্রামের হাজার হাজার মানুষকে ঢাকায় আনা হয়েছিল সমাবেশ করার উদ্দেশ্যে। বলা হচ্ছিল এটা স্বৈরাচারের ষড়যন্ত্র। যারা এদের ডেকে এনেছে তাদের দলের নাম ফরোয়ার্ড ব্লক। সংশ্লিষ্ট নেতাদের আটক করা হলে জোনায়েদ সাকি ছুটে যান। তাঁর বক্তব্য এটা কোনো সরকারবিরোধী আন্দোলন নয়। দুর্নীতিবিরোধী কর্মসূচি। এর রেশ কাটতে না কাটতেই পুরান ঢাকায় কলেজে কলেজে হামলা। রক্তপাত। ভাঙচুর, লুটপাট। কারণ মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজের ছাত্র বিশ্বজিতের মৃত্যু। সেজন্য প্রথমে হামলা হয়েছে সংশ্লিষ্ট মেডিকেল কলেজে। পরে সোহরাওয়ার্দী কলেজে হামলা। সোহওয়ার্দীর ছেলেরা পাল্টা হামলা চালাল মোল্লা কলেজে। কী ভয়াবহ; কী বিদঘুটে অবস্থা!
আন্দোলন-সংগ্রাম ও সংঘাতের ময়দানে একের পর এক নামছে বিবিধ নামে বিভিন্ন সংঘশক্তি। গার্মেন্ট শ্রমিকরা মাঠ ছাড়ে তো নেমে পড়ে রিকশা শ্রমিকরা। ওরা থামে তো মাঠ কাঁপাতে আসে ৩৫ প্রত্যাশীরা। মাঠে নামে সনাতনী মোর্চা। পর্দার আড়াল থেকে কিংবা কথার মারপ্যাঁচে কে বা কারা উগ্রতা উসকে দেয় কিছু বোঝা যায় না। ক্যামোফ্লেজিং পরিস্থিতি! এ এক অদ্ভুত ধূম্রজাল! এখন আবার প্রতিবেশী দেশটি খোঁচাখুঁচি করতে শুরু করেছে। মমতা ব্যানার্জি বাংলাদেশে জাতিসংঘ শান্তি বাহিনী মোতায়েনের আজগুবি দাবি করে বসেছেন। ত্রিপুরায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে হামলা হয়েছে। বাংলাদেশের পতাকা পোড়ানো হয়েছে। প্রতিবাদে ফুঁসে উঠেছে বাংলাদেশ, বাংলাদেশের হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ-খ্রিস্টান সবাই। গত সোমবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের হিন্দু ছাত্ররাও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন। বরেণ্য কবি নির্মলেন্দু গুণ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলেন, ‘ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে, বাংলাদেশের প্রশ্নে জাতি এক ও অবিচল। এই মনোভাব নিঃসন্দেহে অনুপ্রেরণাদায়ক।’
বিদ্যমান প্রতিকূল পরিস্থিতি রুখে দিতে হবে সবার মিলিত শক্তি দিয়ে। কঠোর হস্তে বিশৃঙ্খলা দমন করার কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। কিন্তু কে দমন করবে? কঠোর তো হতে হবে সরকারকেই। কিন্তু এ জায়গাটায় সরকারের সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে ছাড়ছেন না অনেকেই। কার্যক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সরকার শক্তি দেখাতে পারছে না বা দেখাচ্ছে না। যে সরকারের নিজের কোনো সাংগঠনিক শক্তি নেই, সেই সরকারের সীমাবদ্ধতার বিষয়টিও সহজেই অনুমেয়। এ বাস্তবতায় সরকারের হাতকে শক্তিশালী করতে হবে সাধারণ ইচ্ছার শক্তি দিয়ে। সেই শক্তি সঞ্চয়ের জন্য সরকারপ্রধানের উচিত সব রাজনৈতিক দল, পেশাজীবী সংগঠন, ছাত্র সংগঠন, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ ও এনজিওসমূহের প্রতিনিধিদের সম্মেলন আহ্বান করে জাতীয় সংলাপ অনুষ্ঠান। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, সংবিধান, নির্বাচন, আইনশৃঙ্খলা ইত্যাদি প্রশ্নে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সাধারণ ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করতে পারা অসম্ভব কোনো টাস্ক নয়। সাধারণ ইচ্ছা সংবলিত সনদের মাধ্যমে সরকারের ভিত মজবুত করা দরকার, যাতে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে পারে অন্তর্বর্তী সরকার।
এটা হলে সংস্কার, সংবিধান, নির্বাচন ইত্যাদি প্রশ্নে বিতর্ক থাকবে না। সরকার ও রাজনৈতিক দলসমূহের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিতটি হবে টেকসই ও প্রশস্ত। অভ্যন্তরীণ নৈরাজ্য দমনে কঠোর হতে তখন সরকারের আর কোনো দ্বিধা থাকবে না। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তিশালী অবস্থান গ্রহণ করাও তখন সরকারের পক্ষে সহজ হয়ে যাবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও কথাসাহিত্যিক