নামে যা-ই হোক কামে ভালো হওয়াটাই আসল। এ রকম বুুলি আওড়ানো মজাদার বটে। তবে তলে তলে আমরা নামের কাঙাল। নাম শুনতে শ্রোতার কান কতটা সুখ অনুভব করবে সে চিন্তা থেকে জন্মদাতা ও জন্মদাত্রী ভেবেচিন্তে, পরামর্শ বুদ্ধির আশ্রয় নিয়ে সন্তানের নাম রাখেন। অনেক ক্ষেত্রে নবজাতকের বাবা-মা নামকরণের ভার তাঁদের জন্মদাতা-জন্মদাত্রীর ওপর চাপিয়ে দেন। সংঘ-সংস্থা-প্রতিষ্ঠান বা আন্দোলনের যেসব নাম হয় তা স্থির করেন মূলমাথা, যাকে ইংরেজিতে কয় মাস্টারমাইন্ড।
নামের প্রতি মুগ্ধতা বা বিরূপতা সম্বন্ধীয় নানা কেচ্ছা আছে যার কতকাংশ সত্য, বহুলাংশ কল্পনাপ্রসূত। আমার বাল্যসখা হেলালউদ্দিন মুহাম্মদ বদরুল ইসলাম নিজ নামের ওপর ছিল খুবই বিরক্ত। তার বাবা শামসুল ইসলাম ছিলেন রেলওয়ের মধ্যস্তরের কর্মকর্তা। সততা, ভদ্রতা ও পরোপকারের জন্য সুনাম অর্জন করেছিলেন। চাকরির কাজে ঢাকায় এলে কমলাপুরে রেলওয়ে রেস্ট হাউসে উঠতেন এবং জ্যেষ্ঠপুত্র সরকারি অডিট ব্যুরোর নন-গেজেটেড কর্মকর্তা হেলালকে সেখানে ডাকতেন। হেলালের সঙ্গে শাজাহানপুরে চারতলা একটি বাড়ির ফ্ল্যাটে পাঁচ বন্ধুর হাতে গড়া মেসে বাস করতাম বলে পিতা-পুত্র সাক্ষাৎকারের প্রতিবেদন সহজেই পেয়ে যেতাম। একবার তো হেলাল জোর করেই আমায় রেস্ট হাউসে নিয়ে গেল।
‘আসলামুআলাইকুম! খালু সাব ভালো আছেন?’ বলামাত্রই সংবাদপত্র পাঠরত হেলালের বাবা চমকে ওঠে আমার দিকে তাকিয়ে গমগম কণ্ঠে বলেন, ‘ওয়ালাইকুম আসসালাম! আছি বাবাজি, আল্লার রহমতে ভালোই আছি। আরও ভালো থাকতাম যদি আমার হেলাল বিসিএস দিয়া পাস কইরা একখান ইমপ্রেসিভ গভর্নমেন্ট জব জোগাড় কইত্তে পাইত্তো।’ হেলাল বলে, ‘আব্বা! একস্ট্রা কথা কন কিয়েল্লাই? হ্যাতে কি আপনারে আরও ক্যামনে ভালো থাকবেন, জিগাইছিল? হ্যাতে তো নন-গভর্নমেন্ট জব করে। বেতন আমার তুনো বেশি, হ্যাতার লাইফ কি ডুম্ড হয়ে গেছে?’
‘তোমার দেখি ডিক্টেটরিয়াল অ্যাটিচিউড!’ পিতা বললেন পুত্রকে, ‘আমার মন কী পাইলে কী দেখলে শান্তি পাবে সেটা প্রকাশ করা আমার মৌলিক ইয়ে... মানে আমার...। শব্দটা কী জানি বাবাজি?’ বললাম, ‘মৌলিক অধিকার।’ তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ, দ্যাটস ওয়ান অব মাই বেসিক রাইটস। তুমি সেই রাইট অস্বীকার করার মানে তুমি সিভিলাইজড না। এটিকেট কারে কয় জানো না। তিন মাস পর বাপের সঙ্গে দেখা, সালাম দিলে না। সালাম দিল কে?’ প্রসারিত ডান হাতে আমাকে দেখিয়ে বলেন, ‘দিল দিস একসেলেন্ট বয় তোমার ডিয়ারেস্ট বন্ধু। এর কাছ থেকে শিখতে তো তোমার বাধা থাকার কথা না।’ রেলকর্তা শামসুল ইসলাম বলেন, ‘একটা কথা মনে রাখবা। যে বিষয় জানা নেই তা স্বীকার করার মধ্যে কোনো অগৌরব নেই। জানবার জন্য শিখতে হয়। দোলনায় দোলা থেকে কবরে যাওয়া পর্যন্ত শিখতে থাকে মানুষ। তবে সবচেয়ে স্বস্তিদায়ক হলো বন্ধুর কাছে শেখা।’ আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু থেমে গেলেন। কেননা জ্যেষ্ঠপুত্র তাঁকে কদমবুসি করছে।
‘উইদাউট সাউন্ড সালাম দিলাম। এবার হইছে?’ সহাস্যে বলে হেলাল। তৃপ্ত পিতা ‘ওরে আমার পাগলা পোলা’ উচ্চারণপূর্বক হেলালকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘এবার বল তো বাবা, আকিকা দিয়া ধুমধামসে মেজবানি কইরা যে নামখান তোর রাখলাম, সেই নামের উপরে তুই এত খ্যাপা ক্যান?’ কারণ ব্যাখ্যা করল হেলাল।
গোটা দশেক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পদের জন্য আবেদন করেছে হেলাল। ইন্টারভিউ দিয়েছে। এর মধ্যে সাতটি প্রতিষ্ঠানের ইন্টারভিউতে বলা হয়েছে- ‘হেলাল উদ্দিন মুহাম্মদ বদরুল ইসলাম। ও মাই গড! এত লম্বা! মনে হচ্ছে একজনের নয় তিনজনের নাম।’ হেলালের ধারণা, লম্বা নামের কারণেই তার উচ্চবেতনের চাকরি জোটে না। কালক্রমে সে বিসিএস অফিসার হয়েছে আর কর্কট রোগে ভুগে অকালে দুনিয়াছাড়া হয়েছে। ওর জন্য আমার বুকের ভিতরটা, ওর চলে যাওয়ার এই ত্রিশ বছর পরও টনটন করে ওঠে।
মাসে দুবার রাতের শিফটে কাজ করতে হয়েছিল। সংবাদপত্রে তখন সাংবাদিকদের কাজ করতে হতো রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত। গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে মেসে ফিরতাম। অন্য তিন বন্ধু ঘুমে, শুধু জেগে আছে হেলাল। কড়া নাড়তেই ছুটে এসে দরজা খুলে দিত সে।
নিঃশ্বাস মানুষের সবচেয়ে প্রিয়। তবু সেই নিঃশ্বাসকে মানুষ সব সময় মনে রাখে না। হেলাল যে আমার সুবিধার জন্য কষ্ট করেছে সেজন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানাতে ভুলে গেছি। পরকালে যদি দেখা পাই তাহলে অবশ্যই তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করার সুযোগ প্রার্থনা করি মহান স্রষ্টার কাছে। ওপরে চকচকে ভিতরটা ফাঁপা কিসিমের চরিত্রধারী ব্যক্তিদের বিষয়ে হেলাল বলত, ডানা থাকলেই বা উড়লেই সেটা পাখি হয় না। তেলাপোকার ডানা আছে, উড়তেও জানে, তেলাপোকার নাম কি পাখি?
নাম থাকলেই বা রাখলেই কাজ শেষ হয় না। নাম সার্থক হওয়া প্রয়োজন। নাম জপা বলে একটা কর্মও করা হয়। আমার জেলা শহরে ‘জালাল’ নামে তিনজন ছিলেন। তাদের একজন আলু জালাল; ইনি আলুর ব্যবসা করতেন। ঠিকাদারি পেশার জন্য আরেকজনকে বলা হতো, জালাল ঠিকাদার। এ পর্যন্ত ঠিকই আছে বলা যায়। খটকা লাগে তৃতীয় মামলায়। উপন্যাস লেখক জালাল আহমেদকে বলা হতো ‘পথহারা জালাল’। গোটা দশেক উপন্যাস লিখেছিলেন তিনি; সেগুলোর কোনোটিরই নাম তাঁর নামের সঙ্গে ল্যাপটালেপটি করল না। ‘পথহারা’ নামে রচিত উপন্যাসটি তাঁকে আমরণ এবং মরোণোত্তর অবস্থায়ও পথহারা জালাল করে রেখেছে।
ভগ্নিপতির বোনঝি সায়মা শিরিন ওরফে জবা এসএসসি পরীক্ষার্থী থাকাকালে কিছুদিন আমাদের বাড়িতে বাস করে। আমরা বলি, জবা ওই সময় মেহমান হয়েছিল কিন্তু জবার ধারণা আমরা তাকে আশ্রয় দিয়েছি। তাই তার ছেলেমেয়েরা ভার্সিটির শিক্ষার্থী হওয়ার পরও ‘আশ্রয়দাতা’ বাড়ির সদস্যদের হাত-ধোয়ানো মানে চব্যচোষ্যলেহ্যপেয় দ্বারা আপ্যায়ন করার প্রশ্নে সে বড়ই উতলা। একবার ঈদ করতে বাড়ি এসেছি জানতে পেয়ে জবা চেপে ধরল, এবার যদি ওর বাড়িতে একটু হাত না ধুই তাহলে চিরজনমের জন্য আড়ি। খুকিসুলভ হুমকি শুনে মজা পেলাম। হোহ্ হো করে হাসলাম। জবা বলে, ‘হেসো না মামু। আই অ্যাম সিরিয়াস। যা বলেছি তা করবোই।’
জবার শ্বশুর সদরুল হক। তাঁর বড় ভাই বদরুল হক। বদরুল সাহেবের বড় যে ভাই তিনি কায়সুল হক। তিন ভাইয়ের কেউই বেঁচে নেই। তাঁদের বাড়ির বউ জবার দাওয়াত কবুল করেছি। গ্রামের রাস্তার তেমাথায় গিয়ে কোন দিকে সোজা যেতে হবে জবা বুঝিয়ে বলেছিল। দরকারি সময়ে ওটা মনে পড়ছিল না। তেমাথায় ছোট ছোট দোকান। এক দোকানির কাছে জানতে চাই, কায়সুল হক সাহেবের বাড়ি কোন দিকে। দোকানি বলে, এই এলাকায় তো ও রকম বাড়ি নেই। আমি সম্ভবত ভুল জায়গায় এসে পড়েছি। তাকে বলি, ঠিক জায়গাতেই এসেছি। দোকানি তখন পাশের দোকানিকে শুধায়, ‘য়্যাই! কায়সুল সাহেবের বাড়ি চিনসনি?’
‘কায়সুল সাহেব কী করেন? চারকি না বিজনেস?’ জানতে চায় পাশের দোকানি। জবাবে বলি, ‘উনি তো উনিশ শ সত্তর সালে মারা গেছেন। সরকারি অফিসার ছিলেন। কলকাতায় চাকরি করতেন।’ শুনে দুই দোকানি একই সঙ্গে বলে, ‘অ! বুঝছি। বত্রিশ সাহেব। পশ্চিম দিকে আগাইয়া যান। বড় বড় তিনটা ছাতিম গাছের পরে যে বাড়ি, ওটাই বত্রিশ সাহেবের বাড়ি।’
কায়সুল হককে পাবলিক ‘বত্রিশ সাহেব’ নামে জানে। ইতিহাস বলছে, বড়শিতে মাছ শিকারের জন্য বিখ্যাত হয়ে ওঠেন অবিভক্ত ভারতের বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তা কায়সুল হক। বড়শির সুদৃশ্য দামি ছিপ ব্যবহার করতেন। গ্রামের বাড়িতে ছুটি কাটাতে এলেও বড় বড় পুকুরে মাছ শিকারে ব্যস্ত থাকতেন। একবার তিনি বাহারি রংশোভিত একটা ছিপ নিয়ে শিকারে চলেছেন দূরের এক গ্রামে। পথিমধ্যে মানুষ তাঁকে সালাম দেয় আর জিজ্ঞেস করে, ‘হুজুর, নতুন ছিপটার দাম কত?’ তিনি বলেন, ‘বত্রিশ টাকা।’ প্রশ্ন শুনতে শুনতে উত্তর দিতে দিতে কায়সুল হক ত্যক্তবিরক্ত। মাছ ধরার পর ফিরতি পথেও প্রশ্ন, ‘হুজুর দাম কত?’ এবার তিনি সংক্ষিপ্ত জবাব দিতে থাকেন, ‘বত্রিশ’। এভাবে বত্রিশ বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে বাড়ি ফিরলেন। ব্যস, পাবলিক তাঁর নাম দিল ‘বত্রিশ সাহেব।’
পাবলিক বলেছে বলুক, নিজের লোকরাও? ছাতিম গাছগুলো অতিক্রম করে পুবমুখো হতেই পেয়ে যাই কাক্সিক্ষত বাড়ি। হাতের ডানেই পারিবারিক কবরস্থান। পাকা করা বেশ কয়েকটি কবর। একটি কবরে শ্বেতপাথরের ফলকে কালো হরফে লেখা- ‘কায়সুল হক (বত্রিশ সাহেব)।’ বাড়ির লোকরা ব্র্যাকেটে নামটা লিখেছে। কাজটা কি উচিত হলো? প্রশ্ন করি জবার স্বামী দানিউল হককে। ভাগ্নিজামাই বলে, ‘জ্যাডারে মাইনষে যে নাম দিছে সেই নামই তো লেখা হইছে। না লেখলে ওরা কইতো, আংগোরে বেইজ্জতিকরণের সাহস এরা কোনাই পাইছে। পাবলিক কত খতরনাক জানেন না মামু।’
সবশেষে প্রসঙ্গ নাম জপা। সুবিধা অšন্ডে¦ষণের পর্যায়ে মানুষ যা যা করে তার অন্যতম হচ্ছে ভক্তির সঙ্গে নামোচ্চারণ। যেমন ফুল দিছে কে? উত্তর : মজনু ভাই। রাস্তা দিছে কে? মজনু ভাই। স্কুল দিছে কে? মজনু ভাই। কলেজ দিছে কে? মজনু ভাই। মাদরাসা দিছে কে? মজনু ভাই। খাল কাটছে কে? মজনু ভাই। নদী খনন করবে কে? মজনু ভাই। শয়নেস্বপনে নিশিজাগরণে মুখে ফুটছে ‘মজনু ভাই মজনু ভাই মজনু ভাই।’
মজনু ভাই যে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখিয়েছিলেন তা যখন চিরকালের ভবিষ্যৎ হয়ে ধরা দেয়, তখন আফসোসের আর সীমা থাকে না। মর্মাহত ভক্ত তখন স্বগতোক্তি করেন, মজনু মজনু করে যত সময় নষ্ট করেছি, তত সময় ঘুম পাড়লে শরীরের উপকার হতো। এ রকম আফসোস করতেন রাজনীতিক শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। এরশাদ সরকারের উপপ্রধানমন্ত্রী ছিলেন তিনি। ছিলেন রসময় রাজনৈতিক মন্তব্যের জন্য স্বনামখ্যাত। এরশাদের পতনের পর তাঁর সঙ্গীদের মধ্যে যাঁরা তাঁদের ‘মহান নেতা’র বিবিধ দুরাচার বর্ণনা করে আমোদ পেতেন তাঁদের লাইনে ঢুকে পড়েন শাহ মোয়াজ্জেম। বলেন, ‘ডিক্টেটরের সঙ্গে যোগ দেওয়াটা আমার ভুল হয়ে গেছে। জীবনের নয়টা বছর অপচয় করলাম। নয়টা বছর যেভাবে এরশাদের নাম জপেছি, সেভাবে আল্লাহর নাম জপলে আল্লাহর অলি হয়ে যেতাম।’
♦ লেখক : সাংবাদিক