যাপিত জীবনেও সবকিছু নিয়ে হেলাফেলা, মশকরা খাটে না। স্থান-কাল-পাত্রের একটা মাত্রা থাকা চাই। এ মাত্রাহীনতায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতীক ও প্রহরী সেনাবাহিনী নিয়েও গুজবের গজব নামিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কদিন ধরে তা বেশির চেয়েও বেশি হয়ে যাচ্ছে। সোশ্যাল মিডিয়া এবং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স এআইর অপব্যবহার মাত্রা ছাড়ানো আগ্রাসন চলছে সেনাবাহিনীকে নিয়ে।
আমাদের মূলধারার গণমাধ্যমকেও নাস্তানাবুদ করে মারাত্মক চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে উপরোক্ত প্রযুক্তিনির্ভর মাধ্যম দুটি। কিছু একটা বলে বা লিখে দিলেই হয়। আজগুবি কিচ্ছায় কোনো কনটেন্ট দাঁড় করিয়ে দিতে পারলে তো কথাই নেই। সামনের দিনগুলোতে বিশেষ করে নির্বাচন পর্যন্ত এর জের তীব্রতা কোথায় গিয়ে ঠেকবে কে জানে। এরই মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ এম এম নাসির উদ্দিনও তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছেন। সরকারের কয়েকটি সংস্থা থেকেও কিছু শঙ্কার কথা জানানো হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত প্রায় ১২ মাসে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কাক্সিক্ষত উন্নতি না হলেও চেষ্টা আছে। উন্নতির লক্ষণও আছে। কিন্তু গুজববাজরা দিন দিন যেভাবে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে তা বড় রকমের শঙ্কা জাগাচ্ছে। নির্বাচন পর্যন্ত এরা কোন অবস্থা করে ছাড়ে বলা যায় না। মন মতো না হলে এরই মধ্যে যাকে-তাকে নাস্তানাবুদ করে মানইজ্জত ধুলায় মিশিয়ে দিতে শুরু করেছে। যাচ্ছেতাই শব্দ-ভাষা। লেখা বা উচ্চারণের অযোগ্য হলেও তারা তা দিব্বি করে যাচ্ছে। তাদের অবস্থান দেশে-বিদেশে দুই খানেই। তবে নির্দিষ্ট ঠিকঠিকানা নেই। কোনো আড়ত বা মোকাম নেই। থাকলে সেখানে ভোক্তা অধিকার বা কোনো সংস্থাকে দিয়ে অভিযান চালিয়ে গুজব কারখানায় জড়িতদের হাতেনাতে ধরা যেত। উদ্ধার তৎপরতা চালিয়ে সিলগালা করে দেওয়া যেত গুজবের ফ্যাক্টরি। সেই সুযোগ না থাকায় তারা অধরা, বেপরোয়াও।
হালে তাদের স্পেশাল টার্গেট সেনাপ্রধান ও তার বাহিনী। টার্গেট মতো প্রতিদিনই সেনাবাহিনী সম্পর্কে অসত্য, অরুচিকর, নিম্নমানের গুজব ছড়াচ্ছে। এক্ষেত্রে তাদের ভরসা ফেসবুকসহ কিছু সোশ্যাল মিডিয়া। রাষ্ট্রপতি, প্রধান উপদেষ্টা, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠক নিয়ে কল্পিত-বানোয়াট তথ্য সাপ্লাইয়ের কাজে মত্ত। এগুলোর কাস্টমার প্রচুর। ভিউ-রিচ, লাইক শতে শতে। এর সুবাদে সফল তারা। বিপরীতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের অতন্দ্র প্রহরী, আমাদের গৌরব, চব্বিশের ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের অন্যতম স্টেকহোল্ডার সেনাবাহিনীর জন্য অপমানের। এমন সময় সেনাপ্রধান খোদ প্রধান উপদেষ্টাকেও গুজব অগ্রাহ্য করার আহ্বান জানিয়েছেন। ভরসা দিয়ে আবারও বলেছেন, সেনাবাহিনী সরকারের পাশে আছে, থাকবে। গুজববাজদের এটিও সহ্য হচ্ছে না। তারা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের বিরোধ আবিষ্কার করছে। জরুরি অবস্থা জারির হাইপ তুলছে। ড. ইউনূস সরে যাচ্ছেন, তত্ত্বাধায়ক সরকার হচ্ছে, নির্বাচন হচ্ছে না- এ ধরনের গুজবে দেশ গরম করে দিচ্ছে। মূলধারার কিছু গণমাধ্যমও এসব গুজবকে সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করছে। একে সুযোগ হিসেবে ঢাকা-কলকাতাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী ইউটিউবাররা যা ইচ্ছা ছড়াচ্ছে। এতে দেশের কী হলো, তা তাদের বিবেচ্য নয়। হিট বা ভাইরাল হওয়া দিয়ে কথা। নিজেদের চ্যানেলে ও ফেসবুকে ‘লাইক-ভিউ’ বাড়িয়ে কিছু ডলার প্রাপ্তির প্রশ্নে তারা লাভবান। নির্বাচন যখন দোরগোড়ায় তখন কেউ নির্বাচন বানচাল করতে, কেউ নির্বাচন পেছাতে তৎপর। এ বিভাজন তাদের কাছে কড়া আইটেম। শেখ হাসিনা পালানোর পর থেকেই আওয়ামী লীগের অলিগার্করা কোমর বেঁধে নেমেছে অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে ভার্চুয়ালি অপপ্রচারে। দেশের একটি মহলও এতে শামিল হয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণায় বেশ পুলক তাদের। তাদের ভালো ফান্ড দেওয়া হচ্ছে-হয়েছে, বলে কথাবার্তা আছে।
মুখে মুখে নানান সমালোচনা থাকলেও সোশ্যাল মিডিয়াকে অগ্রাহ্য করার সুযোগ আপাতত নেই। এ ছাড়া বর্তমানে ইউটিউব আয়ের একটি প্ল্যাটফর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। এক হিসাব বলছে- বিশ্বের লাখ লাখ মানুষ ইউটিউবে কনটেন্ট তৈরি করে মাসে হাজার হাজার ডলার আয় করছে। ইউটিউবে ১ হাজার ভিউ থেকে আয় হয় ০.৫০ থেকে ৫ মার্কিন ডলার পর্যন্ত, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৫৫ টাকা থেকে ৫৫০ টাকার মতো। গুজব বা ট্রইস্ট করে ভিডিওর থাম্বনেল যত আকর্ষণীয় হচ্ছে, মানুষের আগ্রহ তত বেশি জাগছে। বাড়ছে ভিউ। দর্শক বেড়ে কনটেন্ট ক্রিয়েটরের আয়ও বাড়ে। এখানে নীতি-নৈতিকতা, সত্য-মিথ্যার বালাই নেই। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ওপর জনআস্থায় চিড় ধরাতে পারলে কার লাভ হবে? চব্বিশের গণ অভ্যুত্থানে সামরিক বাহিনী জনগণের পাশে না দাঁড়ালে দেশের কী অবস্থা হতো? সেনাবাহিনীর ওপর জনগণের আস্থাহীনতা সৃষ্টি করে অরাজক পরিস্থিতির মুখে দেশকে ঠেলে দেওয়া প্রকারান্তরে আরেক ফ্যাসিজম। ঢালাওভাবে সেনাবাহিনীকে টার্গেট করে বিষোদ্গার বিশেষ কারও কারও মধ্যে পুলক জাগাচ্ছে। বছর দেড়েক আগে কী দশা-দুর্গতিতে ছিলাম, কার অসিলায় কীভাবে এখন মুক্ত বাতাসে দম-নিঃশ্বাস নিচ্ছি; দিব্যি ভুলে যাওয়ার প্রবণতা। সন্তুষ্টির বদলে যার-তার সমালোচনা। বুকে বুক, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দুঃসাধ্য বিজয় অর্জনের ঘটনাগুলো এত দ্রুত তলিয়ে যাওয়া সবার জন্যই দুর্ভাগ্যের। নিজ দেশের সেনাবাহিনী সম্পর্কে হালকা-তাচ্ছিল্যপনায় স্মার্টনেস দেখানো তাদের কাছে অসহ্য। সশস্ত্র বাহিনী কেবল সার্বভৌমত্বের প্রতীকই নয়, একটি দেশের স্থিতিশীলতায়ও কত বলীয়ান তা জুলাই-আগস্ট বিপ্লবে বাস্তব করেছে সেনাবাহিনী। বিচারিক ক্ষমতা নিয়ে মাঠে থাকা এ বাহিনীর সদস্যরা কোথাও শোআপ করছেন না। যাচ্ছেন না বল প্রয়োগে। সহায়কের মতো কাজ করছেন পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীর সঙ্গে।
সেনাসদস্যদের মাঠ থেকে সরালে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির কী দশা হবে, কারও কারও ধারণায় না থাকলেও সাধারণ বুঝ-জ্ঞানের মানুষ তা যথাযথ উপলব্ধি করে। যে কোনো দেশের সশস্ত্র বাহিনীকে উদ্দেশ্য করে হালকা কথা বললে তাদের মনোবলে টোকা পড়ে। বহির্শত্রুদের মাঝে এতে তৃপ্তির ঢেকুর আসে। তারা সুযোগ নেওয়ার সাহস পায়। এতে অনিবার্যভাবে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়ার শঙ্কা দেখা দেয়। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ববিরোধী ষড়যন্ত্রকারীরা সেই অপেক্ষাই করছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত পেশাদার, দক্ষ, প্রত্যয়ী। উঁচু মনোবলে কেবল নিজেরা নয়, জনতাকে নিয়েও ঐক্যবদ্ধ। বাহিনীপ্রধানের ক্যারিশমা-বিচক্ষণতা-পেশাদারিত্বে মুগ্ধ। অফিসার, সৈনিক, এমনকি সেনাপ্রধানের একসূত্রে গাঁথার এ নজিরের মাঝে যে কোনো একজনের প্রতি কেউ অসম্মান করলে তার আঁচড় সবার গায়ে লাগে। তাদের কাছে এটি পুরো বাহিনীর প্রতি অসম্মান বলে মনে হয়। সাম্প্রতিক অপতথ্যের ফের বা মতলব কে না বোঝে? পোস্টদাতারা অনেকেই আন্ডারগ্রাউন্ড কিংবা ফেক আইডি থেকে গুজব ছড়ায়। তার ওপর আছে অশোভন মন্তব্য, খিস্তিখেউড়, ট্রল। আবার অনেকেরটা নাম দেখেই বোঝা যায় এগুলো সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানের মানুষের পক্ষে হজম অযোগ্য।
দেশে এখন একটা বিশেষ পরিস্থিতি। নির্বাচন নিয়ে কথা হচ্ছে। কোনো কোনো দল তো নির্বাচনের জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে কথা হচ্ছে। কেউ কেউ বলছেন, সংস্কার করবে নির্বাচিত সরকার। পরীক্ষিত সেনাবাহিনীকে সম্পৃক্ত করে একটি ঐতিহাসিক নির্বাচনের উচ্চাশা ঘুরছে। আশা-ভরসার মাঝেও আলোচনা-সমালোচনা হতে পারে। সমালোচনার ভালো দিকও থাকে। এ ছাড়া সমালোচনার অধিকার সবার আছে। তাই বলে সেনাবাহিনী বা বাহিনীটির প্রধানকেও সমালোচনার জন্য সমালোচনা করা কাম্য নয়। দেশে একান্নবর্তী পরিবারের মতো রাজনীতি-অর্থনীতি-সমাজনীতিতে সম্পৃক্তরাও বুঝে, অবুঝে বা অতিবুঝে, ফাঁসে-বেফাঁসে সেনাবাহিনীর ইমেজে আঘাত করে বসা বড় অপরিণামদর্শী। জুলাই আন্দোলনের ফ্রন্টলাইনার হাসনাত আবদুল্লাহ বয়স দোষে তা করে দেরিতে হলেও বুঝেছেন। বয়সি-বুঝবান রাজনীতিকদের কেউ কেউও মাঝেমধ্যে এ পথ মাড়াচ্ছেন অবিবেচকের মতো।
সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এ বিষয়ক ঘোষণা আরও পরিষ্কার। মনেপ্রাণে তার একটি বিশ্বাসের কথাও বলেছেন, রাজনীতিবিদদের বিকল্প রাজনীতিবিদরাই। তাদের বিকল্প সেনাবাহিনী নয়। এভাবে বলার পর আর কথা থাকে না। কিন্তু মহলবিশেষের কাছে কথার পিঠে কথা থেকেই যায়। তা-ও কথার কথা নয়। কদাকার, নোংরা, কটুকথা। যার পুরো উদ্দেশ্যই বিভ্রান্তি তৈরির অপচেষ্টা। শুরু থেকে যে কোনো ত্যাগ স্বীকার করে অন্তর্বর্তী সরকারের পাশে থাকার অঙ্গীকার বারবার ব্যক্ত করেই চলছেন সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। তাকে যেন কাদম্বিনীর মতো ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে’ যে তিনি মরেননি। তিনি যে বেঁচে আছেন সেটাও ঘটনা। ৫ আগস্ট পূর্বাপরে গান পয়েন্টেই ছিলেন জেনারেল ওয়াকার। পুলিশ ও তখনকার ক্ষমতাসীনদের বিভিন্ন দলের লাঠি-গুলির মাঝে সেনাবাহিনীকে ফিরিয়েছেন ‘নো ফায়ার’ নির্দেশে। এর আগ পর্যন্ত কী দশা-দুর্গতিতে ছিল বাংলাদেশ। কারণ অসিলায় কীভাবে এখন মুক্ত বাতাসে দম-নিঃশ্বাস নিচ্ছেন এখন যারা শিনা টান করে ঘুরছেন? আর রটাচ্ছেন-ছড়াচ্ছেন নানা আকথা? মানবসৃষ্ট বা প্রাকৃতিক বড় রকমের বিপর্যয় ঘটলে সেনা ডাকতে মন চায়। দ্রুত এবং মানসম্পন্ন নির্মাণকাজ চাইলে আবশ্যক মনে করা হয় সেনাবাহিনীকে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অর্ধেক খরচে সেনাবাহিনী ঘর বানিয়ে দিলে মন্দ লাগে না। ঝিল, লেক, খাল মজে গেলে তা উদ্ধার ও খননে ডাক পড়ে সেনাবাহিনীর। জাতিসংঘ মিশনে গিয়ে সেনাবাহিনী দেশে টাকা পাঠালে তা রেমিট্যান্স নামে অর্থনীতিতে যোগ করতেও চমক বলে মনে হয়। জুলাই-আগস্ট আন্দোলনে আহতদের সেনা ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত হাসপাতালে চিকিৎসায়ও যারপরনাই আস্থা জাগে।
এসবের প্রতিদানে তাদের গুজবের আইটেম বানানো? রাজনীতিতে কারণে-অকারণে কোনো কিছু নিয়ে লঘু-গুরু মন্তব্যকে দোষণীয় মনে করা হয় না। বলে দেওয়া হয়- রাজনীতির মাঠে কত কথাই হয়, সব ধরতে নেই। এ ছাড়া রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। কিন্তু ধর্ম, বিজ্ঞান, সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে রাজনীতির মতো মন যা চায় তা বলতে নেই। সরকারের উচিত একটি কেন্দ্রীয় ফ্যাক্টচেকিং ইউনিট গঠন করা। কোনো কোনো দেশে ভুল তথ্য যাচাইয়ে রাষ্ট্রীয়ভাবে একটি ওয়েব পোর্টাল রয়েছে। যেখানে প্রতিদিনের ভুল তথ্য যাচাই করে সঠিক তথ্য জানানো হয়। এখানেও সেই ধাঁচের কিছু কি ভাবা যায় না?
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট