মানুষ মরণশীল। তারপরও কিছু মানুষ বেঁচে থাকেন যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী এমনকি সহস্রাব্দের পর সহস্রাব্দ। মানবহিতৈষণামূলক কর্মকাণ্ডই তাঁদের বানিয়ে দেয় চিরঞ্জীব। সেরূপ কর্মপুরুষদেরই একজন প্রিন্সিপাল আবদুল হামিদ। ১৯৮৭ সালের এই দিনে এই মহামনীষী ইহলোক ত্যাগ করেন। ব্রিটিশ ভারতে বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে প্রথম এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাস (১৯৩৬ সালে) পাওয়া ব্যক্তি হওয়া সত্ত্বেও ব্যক্তিগত জীবনের ভোগবিলাস বিসর্জন দিয়ে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও জীবনমান উন্নয়নে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করেন। কর্মজীবনে ১৯৩৬ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত তিনি কিছুকাল আসাম বেঙ্গল রেলওয়েতে অডিটর হিসেবে এবং সরকারি কলেজের শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। অতঃপর তিনি পরাধীন দেশের শোষিত, বঞ্চিত, নির্যাতিত, নিপীড়িত, ভুখা, নাঙ্গা মানুষের সার্বিক কল্যাণচিন্তায় রাজনীতিতে যোগদান করেন এবং তাদের জন্য শিক্ষা বিস্তারের কাজে মনোনিবেশ করেন। ১৯৪১ সালে তিনি পৈতৃক ভূমিতে তাঁর পিতার নামে ‘নারায়ণপুর সরাফত উল্লাহ উচ্চবিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠা করেন। একই সালে তিনি ঢাকার নওয়াব পরিবারের সন্তান নওয়াব খাজা সেলিমকে পরাজিত করে জেলা বোর্ডের মেম্বার নির্বাচিত হন। দ্বিজাতিতত্ত্বভিত্তিক পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধারণার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে তিনি ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে অংশ নিয়ে খাজা সেলিমের কাছে পরাজিত হন। পাকিস্তান দাবি উত্থাপনের পর থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রকে তিনি অবাস্তব বা কাল্পনিক রাষ্ট্র হিসেবে অভিহিত করে আসছিলেন। ১৯৪৬-এর নির্বাচনি প্রচারণায় তিনি বলেন, ‘এই অবাস্তব কাল্পনিক রাষ্ট্র যদিওবা বাস্তবে রূপ নেয় তাহলেও তা কোনোক্রমেই ২৫ বছরের বেশি টিকবে না এবং তা অবশ্যই একটি গোরস্থানে পরিণত হবে।’ পাশাপাশি তিনি বাংলা ভাষাভাষী এলাকা নিয়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদভিত্তিক বাংলাদেশ বা বঙ্গদেশ প্রতিষ্ঠার দাবি তোলেন। খাজা সেলিমের অপকৌশলে ১৯৪৮ সালে তাঁর প্রতিষ্ঠিত ‘নবাব সিরাজউদৌল্লাহ কলেজ’টি সরকারি অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয়। তাঁর দৃষ্টিতে মুসলিম লীগ, আওয়ামী লীগসহ তৎকালীন সব রাজনৈতিক দল গণমানুষের সার্বিক কল্যাণ ও আকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ বিবেচিত হওয়ায় তিনি ১৯৫৮ সালের জুলাই মাসে পাকিস্তান গণমুক্তি পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। যা মাত্র এক মাসের মাথায় আইউবীয় সামরিক শাসনের ফলে অন্য সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে নিষিদ্ধ হয়ে যায়। বাষট্টির পার্লামেন্টে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য থাকাকালে তিনি সরকারি চাকরিজীবীদের ন্যায় কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষের জন্যও বার্ধক্য ভাতার (পেনশন) দাবি তোলেন। স্বতন্ত্র সদস্য হওয়া সত্ত্বেও তিনি পাকিস্তানের যুদ্ধনীতি প্রণয়নে পার্লামেন্টে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। যার ফলে তিনি প্রেসিডেন্ট আইউব খান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব পান কিন্ত মুসলিম লীগে যোগদানের শর্ত যুক্ত থাকায় তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। ১৯৬৬ সালের ১২ এপ্রিল শিবপুরে (রায়পুরা, নরসিংদী) অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান কৃষক সমিতির পঞ্চম বার্ষিক সম্মেলনে বিরাট দূরত্বে অবস্থিত ও বিদেশি রাষ্ট্র দ্বারা বিচ্ছিন্ন দুটি পৃথক ভূখণ্ডের সমন্বয়ে গঠিত একটি রাষ্ট্র কীভাবে অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক এবং এরূপ রাষ্ট্রের পরিণতি কী হতে পারে তা তিনি ‘জাতি ও ভূখণ্ড’ নামক প্রবন্ধের মাধ্যমে সম্মেলনের প্রধান অতিথি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উপস্থিতিতে তুলে ধরেন এবং স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন শুরুর আহ্বান জানান। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণমুক্তি পার্টির পুনর্গঠন উপলক্ষে নারায়ণপুর বাজারে (তৎকালে রায়পুরা, বর্তমানে বেলাব, নরসিংদী) আয়োজিত বিরাট জনসভায় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের দাবি তুলে ধরেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ পাকিস্তানে থাকতে চায় কি চায় না এই মর্মে গণভোট আয়োজনের দাবি জানান। একই জনসভায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট আবদুল জলিল যিনি আবদুল হামিদ কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়েই স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন, তাঁকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল আলোচনায় ব্যস্ত মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান, প্রেসিডেন্ট আইউব খানসহ অন্য নেতাদের পূর্ব পাকিস্তান তথা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও গণভোট বিষয়ে আলোচনার জন্য টেলিগ্রাম বার্তা পাঠান। ১৯৭০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি মাহবুব আলী ইনস্টিটিউটে গণমুক্তি পার্টির কর্মী সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার প্রশ্নে গণভোট দাবির যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। নিবেদিতপ্রাণ এই রাজনীতিক ১৯৮৭ সালের ৬ অক্টোবর ৭৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। দেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে তিনি শুধু ব্যক্তিগত ভোগবিলাসই বিসর্জন দেননি বরং তিনি তাঁর অঢেল পৈতৃক সম্পত্তি এবং সাধনা ও শ্রম সবকিছু মানবকল্যাণেই উৎসর্গ করেছেন। তিনি সারা জীবন অশিক্ষা-কুশিক্ষামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণমুক্ত, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তব রূপ লাভ করলেই কেবল তাঁর আত্মা শান্তি পাবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক