শনিবার, ২০ জুলাই, ২০১৯ ০০:০০ টা

বাবা-মেয়ের আড্ডা

বাবা-মেয়ের আড্ডা
নন্দিত অভিনেতা ও নির্দেশক আবুল হায়াত। নিজেকে ছড়িয়েছেন দুই হাতে; প্রতিটি ক্ষেত্রে দর্প নিয়ে ছুটে চলেছেন সমানতালে। এই দুরন্ত ছুটে চলায় কখন যে ৭৫টি বসন্ত ঘনিয়ে এসেছে, তা মনে হয় তার নিজেরও অজানা! একাধারে তিনি একজন স্বনামধন্য মঞ্চ, টেলিভিশন নাট্যকার। কলাম ও বই লেখালেখির কাজেও দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন তিনি। সাংস্কৃতিক বিনির্মাণে ষাট দশক থেকে বর্তমানের সেতুবন্ধনে তার রয়েছে অসামান্য ভূমিকা। অর্জনের ঝুলিতে জমা রয়েছে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। তারই সুযোগ্য কনিষ্ঠ কন্যা নাতাশা হায়াত। একসময় নিয়মিত অভিনয় করলেও এখন নিজের ফ্যাশন হাউস নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্পেশাল শোবিজ আড্ডা আয়োজনের এবারের অতিথি এই গুণী বাবা ও তার মেয়ে। তাদের সঙ্গে এক বিকালে জমে ওঠে জম্পেস আড্ডা। সেই প্রাণবন্ত আড্ডা পাঠকের জন্য  তুলে ধরেছেন- পান্থ আফজাল,  ছবি : অরণ্য জিয়া

 

বাবা-মেয়ের সঙ্গে আড্ডার পরিকল্পনাটা ছিল দুই মাস আগের। কিন্তু নাট্যজন আবুল হায়াত বিভিন্ন ব্যস্ততার কারণে সময় করে উঠতে পারছিলেন না। তবে শোবিজ টিম ছিল নাছোড়বান্দা, আয়োজনটা বাস্তবায়ন করতে তার পেছনে লেগেছিল ফেভিকল আঠার মতো! পরিশেষে তিনি সময় দিলেন; আসতে বললেন তার বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যেই। যদিও এবারের আয়োজনটা করা হয় একটু ভিন্নভাবে। গতানুগতিক ধারা ভেঙে আড্ডার ভেন্যু নির্ধারিত হয় স্বয়ং এই গুণীজনের বাসায়। গত সোমবার নির্দিষ্ট সময়েই শোবিজ টিম হাজির নাট্যজন আবুল হায়াতের সার্কিট হাউস রোডের বাসায়। ছয় তলার লিফট থেকে নেমে কলিং বেল টিপটেই স্বয়ং শ্রদ্ধেয় আবুল হায়াত দরজা খুলে ভিতরে আমন্ত্রণ জানালেন। তাকে দেখেই চোখে-মুখে কি যে এক মুগ্ধতা খেলে গেল, তা বলে বোঝানো যাবে না! পর্দার রঙিন মানুষ সেই পরিচিত লুকে, সেই চিরচেনা স্নিগ্ধতায়। পরেছেন ক্যাজুয়াল পোশাক। হালকা আকাশি গোলগলার টি-শার্টের সঙ্গে কালো রঙের মোবাইল প্যান্ট। এই বয়সেও কি সুদর্শন! এক চিরসবুজ ব্যক্তিত্ব; সব মিলিয়ে মানানসই! ভিতরে প্রবেশ করার পর একবার চোখ বুলিয়ে নিলাম। বসার কক্ষে তাকজুড়ে থরে থরে সাজানো এই গুণী মানুষের অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা। একটু লক্ষ্য করে চোখ দিতেই নীপবনের পাশেই (তার লেখা বই এসো নীপবনে) ধরা পড়ল জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের চকচকে পদকটি। পাশেই রাখা তার লেখা আরেকটি বই নিশিপ্রান্তে। আরও একটি তাকে সাজানো রয়েছে বেশ কিছু পুরস্কার, সম্মাননা আর বিভিন্ন রকমের বই। রয়েছে কিছু এন্টিক শোপিসও। একাংশের দেয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে এই তারকার পরিবারের সুন্দর মুহূর্তের একটি বড় ফ্রেমে বাঁধাই করা ছবি। অনেকক্ষণ চোখ আটকে রইল দেয়ালে সাঁটানো পারিবারিক ছবিটার দিকে। সাজানো-পরিপাটি ফ্ল্যাটে এই মানুষের সুখের আয়োজন বলা যেতে পারে! এত সব দেখছি কিন্তু খেয়ালই করিনি যে অফুরন্ত প্রাণশক্তি ও হাসিমাখা মুখের সুপুরুষ আবুল হায়াত ফুরফুরে মেজাজে সোফায় বসে আছেন অনেকক্ষণ ধরে।  তার পাশে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ তার সঙ্গে চলল আড্ডা। এরপর কন্যা নাতাশা হায়াতকে নিয়ে ফটোসেশনের কথা বলতেই তিনি কন্যাকে ডাকতে অন্দরে চলে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদেই কন্যাকে নিয়ে ফিরে এলেন। তখন নাতাশা হায়াতের জীবন সঙ্গী শাহেদ শরীফ বাসায় ছিল না। যাই হোক, শোবিজ টিমের সঙ্গে নাতাশা হায়াতের কুশলবিনিময়ের পর ফটোসেশনের জন্য সবাই ছাদে চলে গেলাম। ফটোসেশন শেষে ফিরে এসে তাদের সঙ্গে শুরু হলো জম্পেস আড্ডা। আড্ডার শুরুটা করলেন শ্রদ্ধেয় আবুল হায়াত নিজেই। দুরন্ত যুবা এই নাট্যজন আড্ডাটা শুরু করলেন তার শৈশব স্মৃতি ও বেড়ে উঠা রোমন্থন করে। “জন্মটা মুর্শিদাবাদে। তিন বছর বয়সে অর্থাৎ ’৪৭-এর ডিসেম্বরে আমি এসেছি। চট্টগ্রামের রেলওয়ে কলোনিতে আমার বেড়ে ওঠা। আমার জীবনের এখন ৭৫ বছর শেষ হয়ে আসছে প্রায়। এই শেষ বয়সে এসে যে নস্টালজি আমাকে সব সময় তাড়া করে, স্মৃতিকাতর করে তার মধ্যে একটা হলো রেলগাড়ি আর অন্যটি হলো সমুদ্র। আসলে চট্টগ্রাম শহরের নাম শুনলেই আমি স্মৃতিকাতর হয়ে যাই। আমার প্রফেশনাল লাইফের ব্যাকগ্রাউন্ড খুঁজতে গেলেও চট্টগ্রামকে আনতে হবে। কারণ বাবা রেলে চাকরি করতেন। রেলওয়ে ক্লাবে প্রতিমাসে একটা করে নাটক হতো। নাটকের প্রতি পাগল কিছু লোকজন ছিল রেলওয়েতে, তারা অভিনয় করত। বাবা যেহেতু সেক্রেটারি, তাই সব নাটকই আমি দেখতাম। নাটক হলেই বাবা নিয়ে যেতেন মাকে সঙ্গী করে। সঙ্গে আমি মায়ের হাত ধরে চলে যেতাম। ওই কারণে নাটকের প্রতি আমার আলাদা ভালোবাসা ছিল এবং সেখানে অমলেন্দু বিশ্বাসের মতো একজন অভিনেতাকে চোখের সামনে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করতে দেখেছি। তিনি হলেন আমার ইন্সেপেরেশন। পরবর্তীকালে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেত যে আমি তার মতো  হব।” সে বয়সে তো অনেক মজার মজার খেলাধুলাও করতেন? ‘ওই বয়সে এমন কোনো খেলা নেই যে আমরা সবাই খেলতাম না।’ আবুল হায়াত বললেন, ‘বাড়ির আশপাশে বড় বড় ফাঁকা মাঠ ছিল, ছিল পাহাড়। পাহাড়ে উঠে খেলতাম। বাবা সাইকেল কিনে দেওয়ার পর সাইকেল চালিয়ে পতেঙ্গা চলে যেতাম। গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করা, ভলিবল, কাদার মধ্যে ফুটবল খেলা, দিনভর পানিতে ঝাঁপানো, লাটিম, ডাংগুলিসহ অনেক মজার মজার খেলা খেলতাম সেই সময়। আর সেই সময় চট্টগ্রাম রেলের একটি সাংস্কৃতিক জগৎ ছিল। শুধু নাটকই হতো না, অনেক বিচিত্রা বা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো।’ ১০ বছর বয়সেই তো অভিনয়ে আসা, তাই না? প্রশ্নটি লুফে নিয়ে আবারও বলতে শুরু করলেন। ‘হ্যাঁ, ১০ বছর বয়সেই অভিনয়ে আসা। বন্ধু জামালউদ্দিন, মিন্টু একই পাড়াতে থাকতাম। সেই বয়সে বাড়ির পাশে চৌকি দিয়ে, শাড়ি-চাদর তার দিয়ে ঝুলিয়ে স্টেজ বানিয়ে, বাড়ির থেকে লাইট কানেকশন নিয়ে এসে আমরা সবাই মিলে আমার মামার ডিরেকশনে ‘টিপু সুলতান’ নাটক করি। সেটিই আমার জীবনের প্রথম নাটক ছিল। পরে ক্লাস টেনে পড়ার সময় ‘কলির জ্বিন’ নামে একটি নাটক করলাম। একবার আমাদের পাড়াতে নাটক করলাম। আমাকে হিরোর চরিত্র দিল; ছোটবেলায় চেহারা নাকি সুন্দর ছিল! যদিও আমি লজ্জায় হিরোর পাট করলাম না, করলাম ছোট্ট একটি ভিলেনের (দুষ্ট লোক/কমেডিয়ান) পাট। সেই চরিত্র করেও তখন ফাটিয়ে দিলাম। এরপর থেকেই নাটকের প্রতি একটা নেশা ধরে গেল এবং এক সময় মজাটা আরও বাড়তেই থাকল। ইন্টারমিডেয়েট পাস করলাম চট্টগ্রাম কলেজ থেকে। চলে এলাম ঢাকাতে, বুয়েটে পড়তে। সেটা ’৬২-এর দিকের ঘটনা। এসে দেখলাম সেখানে ভালো ভালো কিছু নাটকের দল আছে। এরপর ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্সটিটিউটে প্রথম নাটকে অভিনয় করলাম। সেই সময় ফার্স্ট ইয়ারে পড়ি। তারপরে তো নাটকের পোকা এমনভাবে মাথায় ঢুকে গেল! যখন থার্ড ইয়ারে পড়ি তখন সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘আমরা ক’জনা’-এর সঙ্গে যুক্ত হই। বুয়েট পাস করে ওয়াসার সরকারি চাকরিতে যুক্ত হলাম ১৯৬৮-এর দিকে। এই সময়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সংসদ নামে একটি সংগঠন ছিল। ওরা যেন কেমন করে আমাকে খুঁজে বের করল। ড. ইনামুল হকের মাধ্যমে আমাকে খুঁজে বের করেছিল। ইনাম সাহেব আমাদের বুয়েটের টিচার ছিলেন। আমার দুই বছরের বড়। ওই সময় সৈয়দ হাসান ইমামের নির্দেশনায় ‘রক্তকরবী’ নাটকে অভিনয় করি। এটি সে সময় ব্যান্ড করে দেওয়া হলেও মিলিটারির কাছ থেকে পারমিশন নিয়ে মঞ্চায়ন করি। ওই যে ঢুকলাম। এরপর ’৬৮-এর শেষের দিক থেকে ’৬৯, ৭০ ও ৭১-একটা দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম। আমরা শহীদ মিনারে, জহুরুল হক হলে, মহসীন হলে, জগন্নাথ হলের অডিটরিয়ামে নাটক দিয়ে সাংস্কৃতিক আন্দোলন চালিয়ে গেলাম। ১৯৬৮ সালে ম্যাক্সিম গোর্কির ‘মা’ও করেছিলাম। মাঝে ১৯৭০ সালে নিজের পছন্দেই বিয়ে করি মাহফুজা খাতুন শিরিনকে।’ এরপর তো নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত হলেন? আবুল হায়াত বলে চললেন ‘সেটা ৬৮-এ বুয়েটে পাস করার পর। ড. ইনাম, গোলাম রাব্বানী আমাকে খুঁজে বের করে নাগরিক নাট্য সম্প্রদায় নামে একটি গ্রুপ তৈরি হবে বলে জানালেন। তখন জিয়া হায়দার, আতাউর রহমান আর্টিস্ট খুঁজছেন। ‘ইডিপাস’ নামে নাটক নামাবেন মঞ্চে। আমি একটি চরিত্রে অভিনয় করে ওই গ্রুপের সঙ্গে ফাউন্ডার মেম্বার হিসেবে যুক্ত হয়ে গেলাম। এখনো গ্রুপের সঙ্গে আছি, যদিও তেমন করে এক্টিভিটিস নেই। মাঝে প্রায় ১২ বছর পর করেছিলাম ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’। স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে আপনার সম্পৃক্ততা একটু খুলে বলবেন কি? ‘মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করতে পারিনি। কারণ, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত একটানা অসুস্থ ছিলাম। ২৩ থেকে ২৯ মার্চ পর্যন্ত কোমাতে ছিলাম। আর এই অসুস্থতা থাকা অবস্থাতেই আমার প্রথম সন্তান বিপাশার জন্ম হয়। সেই সময় স্বাধীনতার যুদ্ধ চরমরূপ ধারণ করে। তাই বাচ্চার জন্ম ও অসুস্থতার কারণে যুদ্ধে যাওয়া সম্ভব হয়ে উঠেনি। তবে ’৬৯, ৭০ ও ৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কিন্তু আমরা দল বেঁধে নাটক করেছি। দুবার মিলিটারি রেট করেছিল। এর মধ্যে একবার মিলিটারিরা আমাকে লাইনে দাঁড় করিয়ে দেয়। তবে সে যাত্রায় অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই।’ বলে চললেন নাট্যজন আবুল হায়াত।

দুজনের কথার মাঝেই ভিতর থেকে নাতাশা এসে বাবার পাশে বসলেন। বড় বোন বিপাশা হায়াতের থেকে সাড়ে ছয় বছরের ছোট তিনি। পড়েছেন ফ্লাওয়ার প্যাটানের সালোয়ার । বাবার মতোই ক্যাজুয়াল লুকে তাকে বেশ লাগছিল। ফটোসেশন করার সময় মেয়ে নাতাশা বাবার নামে অভিযোগ করেছিলেন যে, বাবা আর আগের মতো তাকে ভালোবাসে না। ছোটবেলায় কত চকলেট নিয়ে আসতো তার জন্য-সেটা এখন আর নিয়ে আসে না। শুধু নাতি-নাতনিকেই দেয় এখন। অভিযোগের সত্যত্য কতটুকু তা জিজ্ঞেস করতেই বাবা আবুল হায়াত মুচকি হেসে সায় দিলেন। নাতাশা অভিনয়ের পথে খুব বেশি একটা সময় পথ চলেননি। ফ্যাশন সম্পর্কিত যে কোনো বিষয় তাকে বেশি টানতো। বিপাশা হায়াত যখন অভিনয় শুরু করেন তখন তার পোশাকও ডিজাইন করতেন নাতাশা। অভিনয় করলেও ২০০৮ সালে বিপাশার সঙ্গে পার্টনারশিপে ফ্যাশন হাউস ‘আইরিসেস ডিজাইনার স্টুডিও’র যাত্রা শুরু করেন। কিন্তু মাঝখানে  বিভিন্ন কারণে বিরতি টানতে হয় এই ব্যবসায়। ২০১৩ সালে পুরোদমে আবারও ‘আইরিসেস ডিজাইনার স্টুডিও’র যাত্রা শুরু করেন তিনি। এরপর থেকে এই ব্যবসায় সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করেন তিনি। বড় বোন বিপাশা ‘আইরিসেস ডিজাইনার স্টুডিও’র ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কাজ করছেন। ‘কাপড় আমি সব সময় খুবই পছন্দ করি। ছোটবেলা থেকেই কাপড় কিনে কীভাবে ডিফারেন্ট টাইপের ডিজাইন করে পোশাক তৈরি করা যায় তাই চিন্তা করতাম। আপুর ম্যাক্সিমাম কস্টিউমের ডিজাইন আমিই করে দিতাম। একবার আম্মুর কাছ থেকে ২০ হাজার টাকা নিলাম। ড্রইং রুমটার মধ্যে ২০টি কাপড় তৈরি করলাম, নিমিষেই বিক্রি হয়ে গেল! এরপর আম্মুর সেই ২০ হাজার টাকা কাজে লাগিয়ে আরও বেশ কিছু কাজ করলাম। মনে হলো শুরু করি ভালোভাবে। বন্ধুরাও বলত কেন করিস না! সে সময় ওয়ারিদে চাকরিও করতাম। এরপর ছোট্ট করে শুরু করলাম। এখন দুটি শোরুম। প্রায় ৫০ জন ইমপ্লয়ি কাজ করে দুটো ফ্লোরে। আসলে প্রথম ব্যবসা তো, তাই সাহস কম ছিল।’ আব্বু কি এই ব্যবসাকে সমর্থন করতেন? প্রশ্নটা শুনে একগাল হেসে নাতাশার চটপটে জবাব, ‘না, আব্বু কখনই পছন্দ করতেন না। আব্বু সব সময় চাইতেন যে আমি চাকরি করি। আব্বু চাইতেন পড়াশোনা করি বা অভিনয় করি। তবে এখন এই বিষয়টাকে আব্বু পছন্দ করেন।’ মেয়ের কথা পাশে বসে মনোযোগ দিয়ে শুনছিলেন আবুল হায়াত। তিনি বললেন, ‘আমি চেয়েছিলাম আমার একটি মেয়ে ইঞ্জিনিয়ার বা আর্কিটেক্ট হোক আর আরেকজন ডাক্তার। তো বিপাশা তো আর্কিটেকচার হতে পারল না-সেটা তো ছিল একটা মিরাকেল! ওয়েটিং লিস্টে থেকে শেষ মুহূর্তে হলো না। ৩০০০ জনের মধ্যে ৭০তম ছিল। ও তখন মন খারাপ করে ইংলিশে অনার্স পড়া শুরু করল। কদিন পরে মন খারাপ করে এসে বলে, আমি আর্ট কলেজে পড়ব। সে তখন ওই লাইনেই চলে গেল। নাতাশাকে যখন বললাম তুমি ডাক্তারি পড়, ও তখন ইন্টারমিডিয়েটে বায়োলজি সাবজেক্টই নিল না! ও ডাক্তার হতেই চায়নি। ও কিন্তু ম্যাট্রিকে ছয়টি লেটার পেয়েছিল! এরপর নর্থ সাউথে পড়ল, মাস্টার্সও শেষ করল, ভালো চাকরিও পেল। পরে চাকরি ছেড়ে দিয়ে দর্জির (দোকানদারি) কাজ করল... হা হা হা। তবে সে যাই করুক না কেন আমি কিন্তু খুশি। ওরা দুজনেই এক সময় মঞ্চের দিকে ঝুঁকেছিল। নাতাশা বাদ দিলেও বিপাশা নিয়মিতই সময় দিচ্ছে গ্রুপে।’ অভিনয়কে মিস করেন না? নাতাশার সোজা-সাপ্টা জবাব, ‘নাহ, মিস করি না। আর অভিনয়ের প্রতি কোনো দিনই তেমন করে আগ্রহ জন্মেনি। যতটুকু করেছি আব্বুর আগ্রহেই করেছি। সকালে কাঁদতে কাঁদতে শুটিংয়ে যেতাম, বাবার কাছে বিভিন্ন জিনিসের আবদার করতাম। এই আর কি!’ জানা যায়, ছোটবেলায় বাবার নির্দেশনায় মঞ্চ নাটক বিসর্জন-এ প্রথম অভিনয় করেন নাতাশা। টিভিতে অভিনীত প্রথম নাটক ‘বন্দি’। বাবার ৭৫ বছর পূর্তি সন্নিকটে। ওইদিকে মেয়ে শ্রীষারও অর্থাৎ ৭ সেপ্টেম্বর জন্মদিন। এবার কেক কয়টা কাটা হবে? ‘দুইটাও হয় আবার কখনো দুইটার বেশিও হয়।’ নাতাশার সরল জবাব। বাবার কাছ থেকে কোন ইউনিক বিষয়টি শিখেছেন? ‘সততা। আমরা বাবার কাছ থেকে প্রথম এই জিনিসটিই শিখেছি।’ বাবার এত গুণের মধ্যে অভিনয়টাকেই বেশি পছন্দ মেয়ে নাতাশার। হুমায়ূন আহমেদের সপ্তম প্রয়াণ দিবস ছিল গতকাল। তার প্রচুর নাটকে কাজ করেছেন নাট্যজন আবুল হায়াত। ‘মিসির আলী’ তার মধ্যে একটি স্মরণীয় চরিত্র। করেছেন চলচ্চিত্র শঙ্খনীল কারাগার ও আগুনের পরশমণি। নাতাশাও দুটি নাটকে কাজ করেছিলেন। তার প্রয়াণে স্মৃতি রোমন্থন করে আবুল হায়াত বলেন, ‘তাকে চিনি ’৮৪-৮৫ সাল থেকে। তখন তার লেখা একটি নাটকে প্রথম অভিনয় করেছিলাম। যতদূর মনে পড়ে, নাটকটির নাম ছিল ‘প্রথম প্রহর’। অভিনয় দেখে তার ভালো লেগেছিল বলেই যেই নাটকই লিখত সেখানে আমার একটা চরিত্র থাকত। সেই স্ক্রিপ্টটার উপরে লিখে দিত, এই চরিত্রটা হায়াত ভাইয়ের। কিন্তু এক সময় দেখলাম তার চারপাশে প্রচুর চাটুকার জমে গেছে। এরপর আস্তে আস্তে সরে এলাম। বিশেষ করে হুমায়ূন যখন নুহাশপল্লীতে গেলেন তখন ওইখানে আমার যাওয়া হয়নি। নৌকার করে যেতে হতো। কয়েকবার আমাকে আসতে বলেছিল। আমি বলেছিলাম, হুমায়ূন আই অ্যাম সরি! আমি যেতে পারব না। তার আরেকটা সমস্যা ছিল, শিডিউল ঠিক রাখতে পারত না। আমি তখন দারুণ ব্যস্ত। এই সবের কারণে এরপর তার সঙ্গে তেমন করে কাজ করা হয়নি। দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল। আমি তার এখনো ভক্ত। সে একজন মেধাবী লেখক; বাংলাদেশের নাটকের ধারা সে পাল্টে দিয়েছিল। মানুষের মনকে বোঝার আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। লেখার মধ্যে ছিল সেই লেভেলের পরিমিতিবোধ।’ ১৯৭২ সালে ঋত্বিক কুমার ঘটকের ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ অভিনয় করেন আবুল হায়াত। সুভাস দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী সিনেমাতেও ছিলেন সপ্রতিভ। প্রয়াত অভিনেতা সালমান শাহর প্রথম সিনেমা ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এ বড় মির্জা চরিত্রে অভিনয় করে কেড়ে নেন দর্শক মুগ্ধতা। এরপর অভিনয়ের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০৭ সালে নিজের জামাতা (বিপাশা হায়াতের জীবনসঙ্গী) তৌকীর আহমেদের ‘দারুচিনি দ্বীপ’ চলচ্চিত্রে সোবহান চরিত্রে অভিনয় করে অর্জন করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি মাঝে মাঝে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় কলাম লিখে থাকেন। বইও লিখেছেন কিছু। যেগুলোর প্রচ্ছদ করেছেন আবার নিজের মেয়ে বিপাশা। সব্যসাচী নাট্যজন আবুল হায়াত পেরোচ্ছেন পঁচাত্তরের গন্ডি। হবে ৭৫ বছর পূর্তি আয়োজন। এখনো মঞ্চ, রেডিও, টেলিভিশন এবং চলচ্চিত্রে দাপটের সঙ্গে অভিনয় করছেন তিনি। সংখ্যাসম এ বয়সকে তুড়ি মেরে তিনি এগিয়ে যাবেন জীবনের জয়গানে। জয়তু হে নাট্যজন, জয়তু হে চিরসবুজ!

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর