বুধবার, ৯ অক্টোবর, ২০১৯ ০০:০০ টা

মহরতেই ছবি শেষ...

আলাউদ্দীন মাজিদ

মহরতেই ছবি শেষ...

অফিসার রিটার্নস

মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে স্পন্সরের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আদায়সহ নানা অপরাধ করে থাকে মহরতসর্বস্ব ছবির প্রযোজক নামধারী সংঘবদ্ধ একটি চক্র...

 

ঢাকঢোল পিটিয়ে জমকালো মহরত করা হলো। ক্লাপস্টিক দিলেন মন্ত্রী। রীতিমতো হৈচৈ কান্ড, ঘোষণা  দেওয়া হলো বিগ বাজেট আর অ্যারেঞ্জমেন্টের ছবি হবে এটি। দর্শক এবার অন্যরকম একটি ছবি পেতে যাচ্ছে। যা আগে কেউ কখনো দেখেনি। ব্যস, ওই পর্যন্তই। বছরের পর বছর পেরিয়ে গেলেও সেই ছবির আর কোনো খবর থাকে না। মানে ছবিটি আসলেই অন্যরকম[!] হয়ে যায়। কিন্তু কেন?

চলচ্চিত্র বোদ্ধাদের কথায় যারা মহরতেই ছবি শেষ করে তাদের অবশ্যই অন্য কোনো উদ্দেশ্য থাকে। মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে নানা ফায়দা লুটে। এখন তো স্পন্সরের যুগ। যে কেউ চাইলেই নামেমাত্র প্রজেক্ট দাঁড় করিয়ে সহজে স্পন্সর জোগাড় করে পকেট ভর্তি করতে পারেন। চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থা নামধারী এই নির্মাতারাই খারাপ করছেন। প্রযোজককে একদিকে এই ব্যবসায় লাভবান হওয়ার, অন্যদিকে নায়িকা নিয়ে ফুর্তি করার লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছেন। অনেক প্রযোজক আবার নায়িকা নিয়ে কিছুদিন লং ট্যুরে যান, ফুর্তি করেন। এতেই তার মন ভরে যায়। তারপর আর ছবি নির্মাণে কোনো আগ্রহ থাকে না তার।

যেসব ছবি মহরতে শেষ হয়েছে বা নামেমাত্র কিছু শুটিং হয়েছে সেসবের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে- চাইলাম যারে পাইলাম তারে, মন খোঁজে বন্ধন, দেহ, ৬৯ পাতলা খান লেন, মায়ানগর, জলে ভাসা পদ্ম, জালালের পিতাগণ, না মানুষ, হাডসনের বন্দুক, মুন এভিনিউ, এই তুমি সেই তুমি, প্রিয়তমা আমি দাঁড়ি তুমি কমা, টাইম মেশিন, ফিল মাই লাভ, আসব না ফিরে, লাভ ইন কোরিয়া, কিস্তির জ্বালা, ভালোবাসার চাইতে একটু বেশি, বিচার আমি করব, লাইলী মজনু, আমার পিরানের কোনো মাপ নাই, আবার যোদ্ধা হব, তুমি সন্ধ্যারও মেঘমালা, প্রবাসীর প্রেম, সালাম মালয়েশিয়া, এলিয়েন এখন ঢাকায়, নষ্ট ছেলে, কেন আমি আসামি, বউ পাগল, কালো বিড়াল, পাগলের বিয়ে, মন যারে চায়, কাটা দাগ, মিশন সিআইডি, সাহসী কন্যা, নবীন কমিশনার, জনতার ডাক, নীলাঞ্জনা, সুন্দরী গুলবাহার, আদম, সবুজ কেন অপরাধী, আগুনমুখী, রক্তাক্ত প্রেম, প্রেমের নদী, নষ্ট হওয়ার কষ্ট, বিয়ে হলো বাসর হলো না, মধুর জীবন, না বলা ভালোবাসা, এইতো সময় ভালোবাসার, হ্যালো অমিত, পারলে  ঠেকা, আগুনের  চোখে প্রেম, অন্তরে অন্তরে, ভালো লাগার চেয়ে একটু বেশি, প্রেমের কাজল, প্রক্সি চেক, প্রজন্ম এক্স, কর্পূর, টাকার  খেলা, ষোলো আনা প্রেম, নায়িকা, একা একা, আল্লাহ রাখলে মারে কে, যষ্টি মধু, বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা, এক পলকে দেখা, জান্নাত থেকে জান্নাত, স্বজনহারা, আমরাও মানুষ, ভালোবাসা ছাড়া কেউ কী বাঁচে, মন আমার মন, প্রেমের অধিকার, দিঘি, প্রিয়া শুধু আমার, অফিসার, রঙিন পৃথিবী, তুমি কী আমার ভালোবাসা, জটিল বন্ধন, কানামাছি, শতরূপে শতবার, সবকিছু পিছনে ফেলে, নীল মেঘ, অন্যরকম প্রেমকাহিনী, পায়রা মহুয়া, আউলা মন, আদি, মায়া, রাঙামন,  গ্রেফতার, এবার তো হবে প্রেম, মিলন সেতু, নাকফুল, মনের মাঝে ভালোবাসা, তোকে বউ বানাব, তোমার  প্রেমে পড়েছি, সমসাময়িক, অনেক দৃষ্টি কেড়ে তুমি এলে, অসম প্রেম, কাটপিছ ইত্যাদি। এমন ছবির সংখ্যা আরও প্রায় অর্ধশতাধিক হবে। দিন দিন এই তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট পরিচালকদের কাছে কেন ছবির কাজ শুরু হচ্ছে না জানতে চাইলে তারা প্রযোজকের নানা সমস্যার কথা বলে পাড় পাওয়ার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সহসভাপতি মনতাজুর রহমান আকবর বলেন, এগুলো হলো প্রযোজকের টাকা খসানোর জন্য মন্ত্রী এনে পত্রিকায় ছবি ছাপিয়ে প্রযোজককে প্রলুব্ধ করা। এরা হচ্ছেন মহরত ডাইরেক্টর। এমন অসাধু লোকের জন্য সত্যিকারের প্রযোজকের মনে চলচ্চিত্র সম্পর্কে বিরূপ ধারণা জন্মায় এবং লগ্নিকারক পাওয়া যায় না। এদের হাত  থেকে চলচ্চিত্রকে রক্ষা করতেই হবে। চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির মহাসচিব চলচ্চিত্র নির্মাতা বদিউল আলম খোকন বলেন, একটি প্রবাদ আছে, আর তা হলো- খালি কলস বাজে বেশি। যারা মহরতেই ছবি শেষ করে তাদের অবশ্যই অন্য  কোনো উদ্দেশ্য থাকে। মন্ত্রীকে দিয়ে মহরত করিয়ে  সেই ছবি পত্রিকায় ছাপিয়ে যে কোনো ফায়দা লুটে। চলচ্চিত্র শিল্পের অবস্থা নামধারী এই নির্মাতারাই খারাপ করছেন। প্রযোজককে নানা লোভ দেখিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করছে। ফলে ছবি নির্মাণে আর এগিয়ে আসেন না তারা। চলচ্চিত্রকে পুঁজি করে এমন নেতিবাচক কাজ করা মোটেও উচিত নয়। ২০১৭ সালের ২৭ এপ্রিল এফডিসির জহির রায়হান কালার ল্যাব মিলনায়তনে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুকে প্রধান অতিথি করে মহরত করা হয় অচেনা পৃথিবী ছবির। পরিচালক সালমান বিন আকরাম। কিন্তু ওই ছবির শুটিং শুরু না করেই ঠিক চার মাসের মাথায় ২৬ আগস্ট ওই পরিচালক রাজ-দ্য নিউ সুলতান নামে আরেকটি ছবির মহরত করেন। চাঁদনী ছবির মহরত করেন পরিচালক শামিমুল ইসলাম। এফডিসিতে রকিবুল আলম প্রেমিক ছবির মহরত করেন ২০১৭ সালের ৮ আগস্ট। ২০১৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রতিশোধ ও প্রতীক্ষা নামে একসঙ্গে দুটি ছবির মহরত করেন পরিচালক মুস্তাফিজুর রহমান। একই পরিচালকের হৃদয়ছোঁয়া ভালোবাসা ছবিটির মহরত হয় ২০১৭ সালের ২২ অক্টোবর। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে পরিচালক সুমন দে বাপের দোয়া কি কম দামি? নামে একটি ছবির ঘোষণা দেন। সাফিউদ্দিন সাফির পরিচালনায় রাজকুমার চলচ্চিত্রের মহরত হয় ২০১৬ সালের ২৯ মে এফডিসিতে। ২০১৬ সালে আমি শুধু তোর হব চলচ্চিত্রটির মহরত করেন রফিক শিকদার। শাহানূর রিপন শুরু করেন প্রাচীর পেরিয়ে ছবির কাজ। ২০১৬ সালে আবদুল মান্নান মহরত করেছিলেন প্রেমের অনেক জ্বালা ছবির। দোস্ত দুশমন চলচ্চিত্রের মহরত করেন পরিচালক বি কে আজাদ। ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি এফডিসিতে মা ছবির শুটিং করেন কালাম কায়সার। ২০১৬ সালের ৯ মে মগবাজারের শ্রুতি স্টুডিওতে ‘কলঙ্ক’ ছবির মহরত অনুষ্ঠিত হয়। ছবির পরিচালক এম এ আউয়াল পিন্টু। ২০১৭ সালের ১০ সেপ্টেম্বর বুলবুল বিশ্বাস পপিকে নিয়ে ঘোষণা  দেন নতুন ছবি ‘কাটপিছ’-এর। ২০১৬ সালে মাসুম পারভেজ রুবেল এফডিসিতে মহরত করেন ‘মিশন সিক্স’ ছবির। এর নায়ক হিসেবে মহরতে এসেছিলেন জায়েদ খান। লেনিন হায়দার ‘মিশন সিআইডি’র মহরত করেছিলেন ২০১০ সালের ৩১ অক্টোবর।  ২০১৬ সালের ১৯ জুলাই এফডিসিতে মহরত হয় রফিক শিকদার পরিচালিত ‘আমি শুধু তোর হব’র। ২০১২ সালের ২৮ নভেম্বর শ্রুতি রেকর্ডিং স্টুডিওতে মহরত হয় সেলিম রেজা পরিচালিত ‘না বলা ভালোবাসা’র। সাদ্দাম হোসেনের ‘বিয়ে হলো বাসর হলো না’, ‘মন খোঁজে বন্ধন’ নামের ছবির ২০১২ সালে মহরত হলেও পরে থমকে যায়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর