‘তুরঙ্গমী রেপার্টরি ডান্স থিয়েটার’-এর আর্টিস্টিক ডিরেক্টর ও নৃত্যশিল্পী পূজা সেনগুপ্ত। বিশ্বের অন্যতম বৃহত্তম নাচের প্যারেড দক্ষিণ কোরিয়ার ‘দেইগু কালারফুল ফেস্টিভাল’-এ অংশ নেওয়ার জন্য প্রথমবারের মতো আমন্ত্রণ পেয়েছিল তার নাচের দল। সেখানে দলটির দুটি পরিবেশনা মুগ্ধ করে সবাইকে। দেশীয় নাচের এমন বৈচিত্র্যময় পারফরম্যান্স সোশ্যাল মিডিয়াতেও হয়েছে ভাইরাল। এসব প্রসঙ্গে পূজা সেনগুপ্তের সঙ্গে কথা বলেছেন- পান্থ আফজাল
বিদেশের মাটিতে বিশ্বের বৃহত্তম ডান্স প্যারেডে বিশ্ববাসীর কাছে বাঙালি সংস্কৃতিকে রিপ্রেজেন্ট করেছেন। নাচের জার্নিটা বিস্তারিত বলবেন কি?
প্রথমবারের মতো বৃহত্তম ডান্স প্যারেডে নিজের দেশের সংস্কৃতি উপস্থাপন করতে পেরে অনেক ভালো লাগছে। আসলে আমি যখন ছোট ছিলাম, তখন থেকেই নাচ শিখেছি। ভরতনাট্যম শিখেছি। নাচের প্রতি ভালোবাসার টানে জার্মানি সরকারের স্কলারশিপ ফিরিয়ে দিয়ে ভারত সরকারের স্কলারশিপ নিয়ে পাড়ি জমাই পশ্চিমবঙ্গের রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন এক সময় বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানকার এক অনুষ্ঠানে পারফরম করেছিলাম ভরতনাট্যম। খুবই প্রশংসিত হয়েছিল আমার নাচ। সে সময় ইতালীয় একজন জিজ্ঞেস করেছিল, নিজের দেশের নাচ কি আছে? তখনই আমি সিদ্ধান্ত নেই, দেশে ফিরে নিজের দেশের নানারকম নাচ নিয়ে কাজ করব। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভরতনাট্যমে মাস্টার্স শেষ করে দেশে ফিরে আসি ২০১৩ সালের নভেম্বরে। ঠিক তার দুই মাস পরেই ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে গড়ে তুলি দেশের প্রথম রেপার্টরি ডান্স থিয়েটার ‘তুরঙ্গমী’। এরপর সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের অনেক স্থানের নৃত্য নিয়ে কাজ করা শুরু করি। ২০১৭ সালে আরতি নাচ বা ধুনুচি নাচ আমার কোরিওগ্রাফিতে প্রয়োগ করি। ২০১৯ সালেই অংশ নেওয়ার জন্য কোরিয়া সরকারের আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। এরপর তো করোনা চলে এলো। আবারও ওরা আমন্ত্রণ জানায়। ৮-১১ জুলাই দেইগু শহরে বসেছিল ‘দেইগু কালারফুল ফেস্টিভাল’। এই উৎসবে প্রথমবারের মতো আমন্ত্রণ পায় বাংলাদেশ।
সেখানে তো দুটি প্রযোজনায় অংশ নিয়েছিলেন...
হুমম... এর মধ্যে একটি ৫ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ‘নন্দিনী’, যা হলো ধুনুচি বা আরতি নৃত্য। অন্যটি ১০ মিনিট দৈর্ঘ্যরে ‘পাঁচফোড়ন’। দুটির ভাবনা, নকশা, নৃত্যনির্মাণ ও নির্দেশনা আমারই। দুই রকমের আয়োজন হয়েছে। সেখানে অনেক বড় খোলা রাস্তা দেখে ধুনুচি নৃত্যের চিন্তা মাথায় এলো। মনে হলো, যদি রবীন্দ্রনাথের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’ গানের সঙ্গে ধুনুচি নৃত্য করি, তবে ভালো হবে। ‘নন্দিনী’ প্রোডাকশনে আমরা দেখিয়েছি আমাদের নাচ, সাহিত্য, গানসহ অনেক কিছু। একেবারেই আমাদের ফোক যে ট্র্যাডিশন, ধূপ-ধোঁয়া হাতে ধুনুচি নিয়ে নাচ করা। এটা যে শুধু পূজায় হয় এমন না। এটা একেবারেই এই ভূখন্ডের একটা আদি সংস্কৃতি। যখন মানুষ আগুন আবিষ্কার করল, তখন থেকেই নিজের চারপাশের পরিবেশকে পবিত্র রাখতে এই ধূপ কিংবা ধোঁয়ার প্রচলন হয়েছে। এই নাচটায় ছিল একেবারেই আমাদের নিজেদের সংস্কৃতির প্রতিফলন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে’র লয়টা শুধু পরিবর্তন করেছি, মূল সুর অপরিবর্তিত।
‘পাঁচফোড়ন’ কীভাবে মঞ্চায়ন করেছেন?
বাংলাদেশের রান্নায় ব্যবহার হয় ‘পাঁচফোড়ন’। এটি পাঁচ রকমের মসলা। আমি প্রতীকী অর্থে নামটি ব্যবহার করেছি। সেখানকার স্টেজে ‘পাঁচফোড়ন’ মঞ্চায়ন করেছি। একটি সড়কের মধ্যেই স্টেজ তৈরি করা হয়েছে। এই নাচে আমরা বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষকে চিত্রায়িত করেছি। যেমন আমাদের কৃষক, শ্রমিক, গার্মেন্ট কর্মী, মাঝি, মৌয়াল।
বাঙালি সংস্কৃতিকে এমন মনোমুগ্ধকর উপস্থাপনে কোরিয়ার মানুষদের অনুভূতি কেমন ছিল?
কোরিয়ায় যখন প্রথম গেলাম, তারা স্বাগত জানিয়ে বলল, প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ এসেছে। তখন মনে হলো, এই সুযোগ বাংলাদেশকে তুলে ধরার। সেখানকার মেয়র, অর্গানাইজারসহ সবাই খুবই আগ্রহ প্রকাশ করল বাঙালি নাচ দেখার। এরপর যখন বিশাল প্যারেডে আগুন নিয়ে ঢুকলাম, সবাই দেখে অবাক হলো। মুগ্ধ হয়ে দেখল। হাতে আগুন, সঙ্গে ধোঁয়া আর ধূপের সুগন্ধিতে চারদিকে একটা অপরূপ আবহ তৈরি হলো। এটি সেখানকার মানুষের কাছে নতুন কিছু ছিল। প্যারেডে পরিবেশনার সময় আমরা যেটা অনুভব করেছি, ধুনুচি নাচ দেখে আশপাশের সবাই চুপ হয়ে গেছে। সবার মধ্যে এক ধরনের মুগ্ধতাও কাজ করেছে। গানের তালে তালে সবাই তালি দিচ্ছিল। ছোট বাচ্চা, ফটোগ্রাফার ও ডান্সাররা ছবি তুলতে আসছিলেন। টিভি চ্যানেল ধুনুচি নাচ সম্পর্কে জানতে চাচ্ছিল। এটা ছিল বেশ মুগ্ধতার। এটা সত্যিই আমাদের জন্য আনন্দের, গর্বের।
দেশীয় নাচ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কীভাবে পরিচিত করা যায়? আপনার অভিজ্ঞতা কী বলে?
আমি আমার অভিজ্ঞতায় দেখেছি, আমরা যেমন বিদেশিদের নাচ দেখে মুগ্ধ হই, শিখতে চাই, বিদেশি নৃত্যশিল্পীরাও তেমনি আমাদের নাচ শিখতে আগ্রহ প্রকাশ করে। আমি ২০১৮ সালে ফিলিপাইনে আরতি নাচের ওপর কর্মশালা পরিচালনা করেছিলাম। এক হাজার বিদেশি নৃত্য প্রশিক্ষক সেখানে অংশ নিয়েছিলেন। আমি আমার কোরিওগ্রাফিতে আরতি, ধামাইল, লাঠিখেলা, বৌ নাচ ইত্যাদি দেশীয় ফরম প্রয়োগ করেছি। আমাদের নাচে দেশীয় সংস্কৃতিকে তুলে ধরার মাধ্যমেই আমরা বিশ্বে আমাদের দেশকে সুন্দরভাবে তুলে ধরতে পারব।
নতুন প্রযোজনা মঞ্চায়নের পরিকল্পনা আছে?
আমরা কয়েকটি প্রযোজনা নিয়ে কাজ করছি। তবে প্রযোজনাগুলো ব্যয়বহুল। এ বছর নতুন একটি প্রোডাকশন সামনে আনতে চাই। তেমন প্ল্যানিং চলছে। আর ‘ওয়াটারনেস’ প্রযোজনার মহড়া চলছে এ মুহূর্তে। এটি সবার কাছে খুবই জনপ্রিয়। উপযুক্ত হল পেলে এর প্রদর্শনী করব। ‘হো চি মিন’ খুব বেশি প্রদর্শনী হয়নি। ইচ্ছে আছে এর প্রদর্শনী করার। ‘অনামিকা সাগরকন্যা’র মঞ্চায়ন হচ্ছে বহুদিন ধরে। কিছু গবেষণার কাজ করছি। সে সব নিয়েও ব্যস্ত আছি। ‘তুরঙ্গমী রেপার্টরি ডান্স থিয়েটার’ এ পর্যন্ত ১৫টি প্রযোজনা করেছে। কোনোটা ৫ বা ১০ মিনিটের আবার কোনোটা এক ঘণ্টা ব্যাপ্তির। এগুলো কিন্তু প্রডোকশন হিসেবেই ট্রিট করেছি।
এগুলোর মিউজিক, সেট, প্রপোজ, কস্টিউম সব নিজেদের করা। তবে এক-দুইটায় বাইরের গান ব্যবহার করেছি।
এমন সাফল্যে শিল্পীদের উৎসাহ কতটুকু জরুরি?
আমি মূলত কাজটাই করতে চাই। কে কীভাবে মূল্যায়ন করল- সেটা নিয়ে ভাবি না। নতুন প্রডাকশন যখন তৈরি করি তখন আমি শূন্য থেকেই সৃষ্টি করতে চাই। টিম ক্রিয়েটিভ প্রসেসে করি। চাই কাজটা যেন ভালো হোক। অনেকেই এপ্রিসিয়েট করে। অনেক তরুণ কাজ করতে চায়। সুযোগও দিয়েছি অনেককে। আমাদের নাচের ভিডিও নিয়ে সবার উৎসাহ দেখে ভালো লাগছে। আমার ও আমার দলের পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।