রবিবার, ২৬ মার্চ, ২০২৩ ০০:০০ টা

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে এগিয়ে ঢালিউড

মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্রে এগিয়ে ঢালিউড

‘মুক্তিযুদ্ধ’ স্বাধীন বাংলাদেশের অহংকার। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি লাভ করেছে একটি স্বাধীন দেশ, স্বতন্ত্র পতাকা ও মানচিত্র। চলচ্চিত্র হচ্ছে যে কোনো দেশের শক্তিশালী প্রধান গণমাধ্যম। চলচ্চিত্রের মাধ্যমে জাতির সামনে তুলে ধরা হয় একটি দেশের পরিচয়, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও যাপিত জীবনের ছবি এবং বাণী। বিজয়ের ৫০ বছরে এ দেশে নির্মিত হয়েছে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অর্ধশতাধিক চলচ্চিত্র। বাংলাদেশে নির্মিত মুক্তিযুদ্ধের ছবি নিয়ে লিখেছেন- আলাউদ্দীন মাজিদ

 ‘মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম চলচ্চিত্র তৈরি হয় ১৯৭১ সালে কলকাতায়। ওই সময় চারটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। এগুলো ছিল জহির রায়হানের স্টপ জেনোসাইড, এ স্টেট ইজ বর্ন, আলমগীর কবিরের লিবারেশন ফাইটার্স ও বাবুল চৌধুরীর ইনোসেন্ট মিলিয়নস। এসব ছবি নির্মাণের উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানিদের গণহত্যা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ত্বরান্বিত করা। জহির রায়হান এ চারটি প্রামাণ্যচিত্রের নামকরণ করেছিলেন ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র’। ১৯৭২ সালে দেশে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু হয়। সেই থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত অসংখ্য চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রথম কাহিনিচিত্র ওরা ১১ জন (১৯৭২) পরিচালনা করেন চাষী নজরুল ইসলাম। ‘ওরা ১১ জন’ ছবিতে মুক্তিযোদ্ধা গেরিলাদের বিভিন্ন অপারেশন চিত্রিত হয়েছে। ছবির নামটি প্রতীকী। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১টি সেক্টর এবং ১৯৬৮-৬৯ সালে ছাত্রদের ১১ দফার অনুসরণে ছবির নামকরণ করা হয়েছে। চাষী নজরুলের আরেকটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হলো- সংগ্রাম (১৯৭৩)। এ ছবির কাহিনি গড়ে উঠেছে সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফের ‘ডায়েরি’ অবলম্বনে। এতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও অন্যান্য বাহিনীর বীরত্বগাথা চিত্রিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আরেক খণ্ডচিত্র সুভাষ দত্তের অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী (১৯৭২)। এর কাহিনি গড়ে উঠেছে পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে বাঙালিদের প্রতিরোধযুদ্ধ এবং এক ধর্ষিত নারীকে একজন অভিনেতা কর্তৃক স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ নিয়ে। আলমগীর কবিরের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক কাহিনিচিত্র ধীরে বহে মেঘনা (১৯৭৩)। এতে প্রামাণ্য ও কল্পনার মিশ্রণ ঘটেছে। যুদ্ধ-উত্তর পরিবেশে সামাজিক বিশৃঙ্খলা ও অবক্ষয় ধরা পড়েছে খান আতাউর রহমানের আবার তোরা মানুষ হ (১৯৭৩) ও নারায়ণ ঘোষ মিতার আলোর মিছিল (১৯৭৪) চিত্রে। মুক্তিযুদ্ধের যে চলচ্চিত্রটির চিত্রভাষা মানবিকতা ও কাব্যিক ব্যঞ্জনায় মূর্ত হয়ে উঠেছে সেটি হলো হারুন-অর-রশীদের মেঘের অনেক রং (১৯৭৬)। একই পরিচালকের আরেকটি ছবি আমরা তোমাদের ভুলব না (১৯৯০) আবর্তিত হয়েছে মতলব নামের এক কিশোর মুক্তিযোদ্ধার আত্মত্যাগের কাহিনি নিয়ে। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু চলচ্চিত্রায়ণ করেছেন একাত্তরের যিশু (১৯৯৩) এবং গেরিলা (২০১১)। দুটো চিত্রই বাস্তবতা ও শিল্পবোধে সমৃদ্ধ হলেও প্রকৃতপক্ষে এগুলো মুক্তিযুদ্ধের খণ্ডচিত্র মাত্র। সাহিত্যিক, নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আগুনের পরশমণি (১৯৯৫) আবর্তিত হয়েছে ঢাকা শহরের রুদ্ধ পরিবেশে একটি পরিবারের আতঙ্ক এবং বদি নামের এক গেরিলার অপারেশন ও শহীদ হওয়ার ঘটনা নিয়ে। মোরশেদুল ইসলাম মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনিচিত্র আমার বন্ধু রাশেদ (২০১১) ও অনিল বাগচীর একদিন (২০১৫) নির্মাণ করেন। তাঁর দুটি চলচ্চিত্রই মুক্তিযুদ্ধের হৃদয়গ্রাহী খণ্ড দলিল। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একেবারে আলাদা ধরনের প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন তারেক মাসুদ মুক্তির গান (১৯৯৫)-এ। এ চিত্রে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটি ভ্রাম্যমাণ গানের দলের কার্যক্রম সার্থকতার সঙ্গে তুলে ধরা হয়েছে। তানভীর মোকাম্মেলের পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নদীর নাম মধুমতী (১৯৯৬) এবং তৌকীর আহমেদের জয়যাত্রা (২০০৫) মুক্তিযুদ্ধের আলোচিত ছবি হলেও তাতে নেই যুদ্ধের পূর্ণ চিত্র। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে একটি নারীবাদী চলচ্চিত্র হচ্ছে শামীম আখতারের ‘ইতিহাস কন্যা’ (১৯৯৯)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরও একটি আলোচিত খণ্ডচিত্র হচ্ছে- বাপজানের বায়োস্কোপ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছবি সম্পর্কে চলচ্চিত্র সমালোচক ও শিক্ষক ফাহমিদুল হক লিখেছেন জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’ (১৯৭১) হলো এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য প্রামাণ্যচিত্র। মুক্তিযুদ্ধের সাদাকালো এ প্রামাণ্য দলিল নির্মিত হওয়ার বহু বছর পর রঙিন মুদ্রণে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে হাজির হয়েছেন তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদ তাদের ‘মুক্তির গান’ (১৯৯৫) চলচ্চিত্র নিয়ে। বিদেশি কিছু নির্মাতা বা টিভি চ্যানেল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য হলো ভারতীয় নির্মাতা এস সুখদেবের ‘নাইন মান্থস টু ফ্রিডম’ (১৯৭২)। দেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার পরপরই মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ চিত্র ধারণ করার আর সুযোগ থাকেনি। ফলে পরের প্রামাণ্যচিত্রগুলো নির্মিত হয়েছে মৌখিক ইতিহাসনির্ভর। এর বড় জায়গাজুড়ে থেকেছে বীরাঙ্গনাদের আত্মত্যাগ ও মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা। এসব ছবির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- ইয়াসমিন কবিরের ‘স্বাধীনতা’ (২০০৩)। ফারজানা ববির ‘বিষকাঁটা’ (২০১৫) নারী-মুক্তিযোদ্ধাদের গল্প বলে। শবনম ফেরদৌসীর ‘জন্মসাথী’ (২০১৭) বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশু উভয় প্রসঙ্গই অন্তর্ভুক্ত করে। তানভীর মোকাম্মেল নির্মিত বায়োপিক তাজউদ্দীন আহমদ : নিঃসঙ্গ সারথী (২০০৭) মৌখিক ইতিহাসনির্ভর। তারেক ও ক্যাথরিন মাসুদের মৌখিক ইতিহাসনির্ভর ব্যতিক্রমী এক প্রামাণ্যচিত্র হলো- মুক্তির কথা (১৯৯৬)।

স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই বেশ কয়েকটি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়। ‘ওরা ১১ জন’-এ (১৯৭২, চাষী নজরুল ইসলাম) মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বগাথা বর্ণিত হয়। অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষীতে (১৯৭২, সুভাষ দত্ত) দ্বিধাগ্রস্ত ও ভীতু এক অভিনেতার যুদ্ধে অংশ না নিতে পারার টানাপড়েন চিত্রায়িত হয়। ‘ধীরে বহে মেঘনা’য় (১৯৭৩, আলমগীর কবির) বন্ধুপ্রতিম প্রতিবেশী দেশের প্রতিনিধি এক নারীর দৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ হাজির হয়, নতুন দেশটিতে এসে ভারতীয় নারীটির দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে থাকে। ‘আবার তোরা মানুষ হ’তে (১৯৭৩, খান আতাউর রহমান) হতাশ মুক্তিযোদ্ধাদের বেআইনি কাজে জড়িয়ে পড়ার পরিবর্তে সঠিক পথে থাকার আহ্বান জানানো হয়। ‘মেঘের অনেক রং’-এ (১৯৭৬, হারুন-অর-রশীদ) দেখা গেছে যুদ্ধের কারণে কীভাবে এক শিশুর জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ১৯৭৭ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ‘কলমিলতা’ (১৯৮১, শহীদুল হক খান) নামের একটিমাত্র চলচ্চিত্রের সন্ধান পাওয়া যায়। ‘আগামী’ (১৯৮৪, মোরশেদুল ইসলাম) মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সময় রাজাকারদের পুনর্বাসন ও মুক্তিযোদ্ধাদের অসহায়ত্বের কাহিনি বর্ণনা করে। দ্বিতীয় চলচ্চিত্র ‘হুলিয়া’ (১৯৮৪, তানভীর মোকাম্মেল) মুক্তিযুদ্ধপূর্ব সময় বামপন্থি এক রাজনৈতিক কর্মীর গল্প বলে। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নির্মাতা তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম ও তারেক মাসুদ পরে বহু পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন এবং বাংলাদেশের চলচ্চিত্রকে একটি উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। তারা প্রত্যেকেই পরে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশ কয়েকটি করে চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তারেক মাসুদের ‘মাটির ময়না’ (২০০২), তানভীর মোকাম্মেলের ‘নদীর নাম মধুমতী’ (১৯৯৫), মোরশেদুল ইসলামের ‘আমার বন্ধু রাশেদ’ (২০১১) এক্ষেত্রে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র। শামীম আখতারের ‘শিলালিপি’ও (২০০২) একটি উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র, যা মূলত মুক্তিযুদ্ধকালীন সাংবাদিক সেলিনা পারভীনের বায়োপিক। ঢাকা শহরে গেরিলা অপারেশননির্ভর চলচ্চিত্র হলো হুমায়ূন আহমেদের ‘আগুনের পরশমণি’ (১৯৯৪) ও নাসিরউদ্দিন ইউসুফের ‘গেরিলা’ (২০১১)। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণে পলায়নপর মানুষের কাহিনি হলো ‘শ্যামল ছায়া’ (২০০৪, হুমায়ূন আহমেদ) ও ‘জয়যাত্রা’ (২০০৪, তৌকীর আহমেদ)। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের মুখে সাধারণ কলেজ শিক্ষকের প্রতিবাদী হয়ে ওঠা গল্প হলো ‘মেঘমল্লার’ (২০১৫, জাহিদুর রহিম অঞ্জন)। রুবাইয়াত হোসেন তার ‘মেহেরজান’ (২০১১) চলচ্চিত্রে বৈপ্লবিক একটি নিরীক্ষা করেন মুক্তিযুদ্ধের কাহিনিতে। ‘লাভিং দ্য আদার’ ট্যাগলাইন ব্যবহার করে এ চলচ্চিত্রে দেখানো হয়, বাঙালি তরুণীর সঙ্গে পাকিস্তানি সৈনিকের প্রেম।

সর্বশেষ খবর