উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগে স্থবিরতা এবং কর্মসংস্থানের ধীর পুনরুদ্ধারের মতো আর্থিক চাপে নিম্ন আয়ের মানুষ যখন বেশি ক্ষতিগ্রস্ত, তখন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে দারিদ্র্যমোচনের ব্যয় কমানো হয়েছে। এতে অর্থনীতিবিদ ও উন্নয়ন বিশেষজ্ঞদের মাঝে দুশ্চিন্তা দেখা দিয়েছে।
প্রস্তাবিত বাজেটে দারিদ্র্য নিরসনে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা, যা চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটে নির্ধারিত ৪ লাখ ৬১ হাজার টাকার তুলনায় কম। ফলে বাজেটের দারিদ্র্যকেন্দ্রিক ব্যয়ের অনুপাত ৫৭ দশমিক ৯ শতাংশ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৫৬ দশমিক ৭৭ শতাংশে। অর্থের হিসাবে এটি এক অর্থবছরে ১২ হাজার ৯৯৪ কোটি টাকা কম; যা আনুপাতিক হিসাবে ১ দশমিক ১৩ শতাংশ পয়েন্ট কমে যাওয়া নির্দেশ করে। দীর্ঘমেয়াদি পরিসংখ্যান আরও উদ্বেগজনক। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে দারিদ্র্যমোচনে বরাদ্দ ছিল ৪ লাখ ৩৩ হাজার টাকা; যা ছিল মোট বাজেটের ৬০ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সে হিসেবে দুই বছরে দারিদ্র্যসংক্রান্ত ব্যয়ের অংশ কমেছে ৩ দশমিক ৮৯ শতাংশ পয়েন্ট। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এ সময়ে বাজেটে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীর সহায়তা কমিয়ে আনা সময়োচিত নয়। এ বিষয়ে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তাফা কে মুজেরী বলেন, ‘উচ্চ মূল্যস্ফীতি, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের মন্দার সময় যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, তাতে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সহায়তা কমে গেছে; যা খুবই হতাশাজনক।’ তিনি আরও বলেন, ‘বরাদ্দের একটি বড় অংশ সঠিক উপকারভোগীদের কাছে পৌঁছায় না, যার মূল কারণ দুর্বল বাস্তবায়ন এবং লক্ষ্য নির্ধারণের ত্রুটি।’ সরাসরি আর্থিক সহায়তা, নগদ হস্তান্তর ও ভর্তুকিযুক্ত খাদ্য বিতরণ কার্যক্রমের পরিধি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন তিনি। ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট অনুযায়ী, সরাসরি দারিদ্র্য নিরসনে বরাদ্দ ৩ লাখ ১ হাজার টাকা (মোট বাজেটের ৩৮ দশমিক ১০ শতাংশ) এবং পরোক্ষভাবে দারিদ্র্য হ্রাসে সম্ভাব্য প্রভাব রয়েছে এমন খাতে বরাদ্দ ১ লাখ ৪৭ হাজার কোটি টাকা (১৮.৬৬ শতাংশ)। আগের অর্থবছরের তুলনায় এ অনুপাত কমেছে।
অর্থ বিভাগ জানায়, পরিচালন বাজেটের মধ্যে ৫৩ দশমিক ০৬ শতাংশ (২ লাখ ৮৪ হাজার টাকা) ও উন্নয়ন বাজেটের ৬৬ দশমিক ৪৬ শতাংশ (১ লাখ ৬৩ হাজার কোটি টাকা) দারিদ্র্য নিরসনসংক্রান্ত ব্যয় হিসেবে চিহ্নিত। নথি অনুযায়ী, খাদ্য মন্ত্রণালয় মোট বরাদ্দের ৯৮ দশমিক ০১ শতাংশ দারিদ্র্য নিরসনমুখী কার্যক্রমে ব্যয় করবে। এরপর রয়েছে সেতু বিভাগ (৯৪ দশমিক ০৪ শতাংশ) এবং পরিসংখ্যান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ (৯০ দশমিক ৪৪ শতাংশ)। অন্যান্য উচ্চ বরাদ্দপ্রাপ্ত সংস্থার মধ্যে রয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় (৮৮ দশমিক ৪৩ শতাংশ), রেল মন্ত্রণালয় (৮৭ দশমিক ৬৬শতাংশ) এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় (৮৭ দশমিক ২২ শতাংশ)। অন্যদিকে, রাষ্ট্রপতির কার্যালয় ও মহাহিসাব নিরীক্ষক কার্যালয়ের দারিদ্র্য নিরসন বরাদ্দ ০ শতাংশ, আর জাতীয় সংসদের বরাদ্দ মাত্র ০ দশমিক ২৫ শতাংশ। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্ট, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনও রয়েছে নিম্ন বরাদ্দপ্রাপ্তের তালিকায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক, গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বাজেট শ্রেণীকরণ নিয়ে সমালোচনা করে বলেন, ‘এ শ্রেণীকরণ কার সন্তুষ্টির জন্য করা হচ্ছে?’ কেবল সরাসরি সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমকেই দারিদ্র্য নিরসনের ব্যয় হিসেবে গণ্য করা উচিত। অবকাঠামো বা অন্যান্য উন্নয়নমূলক বিনিয়োগ যদিও গুরুত্বপূর্ণ, সেগুলোকে দারিদ্র্য নিরসন হিসেবে দেখানো ‘স্বেচ্ছাচারী ও অস্থায়ী’ পদ্ধতি বলে মনে করেন তিনি।
তিনি সতর্ক করে বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর প্রবৃদ্ধি নিম্ন আয়ের মানুষের আয়ে প্রত্যাশিত মাত্রায় প্রতিফলিত হয়নি, ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের হারও সন্তোষজনক নয়। ‘যতক্ষণ না বাজেটের দারিদ্র্য ব্যয় সুনির্দিষ্টভাবে পুনর্গঠন ও লক্ষ্যভিত্তিক করা হয়, ততক্ষণ এ বাজেট প্রকৃতপক্ষে যাদের জন্য তা প্রণয়ন করা হয়েছে, তাদের সেবায় ব্যর্থ হওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাবে,’ বলেন তিনি।